[ প্রবন্ধটি ৩রা জুলাই ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত এবং জনস্বাস্থ্য মোর্চা কর্তৃক ইংরিজি থেকে অনুদিত। জনস্বাস্থ্য মোর্চা ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকার প্রতি কৃতজ্ঞ । ]
জনস্বাস্থ্যবিদ বা মহামারী বিশেষজ্ঞদের পান্ডিত্য ও দক্ষতা, ডাক্তার এবং সংশ্লিষ্ট পেশাদারদের মধ্যে সবচেয়ে কম। তবে এই জ্ঞানের অভাবই জনসাধারণের স্বাস্থ্য সমস্যা এবং স্বাস্থ্যের সামগ্রিক অবস্থা বোঝার ক্ষেত্রে সুবিধা করে দিতে পারে; কারণ জনমানুষের স্বাস্থ্যের সামগ্রিক অবস্থা বোঝার জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান এবং জটিলতা নিরপেক্ষ মানসিকতা। অত্যধিক পাণ্ডিত্য পক্ষপাতদুষ্ট এবং তা আমাদের সাব্জেক্টিভ বা বিষয়ীগত পর্যবেক্ষণের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
জনস্বাস্থ্যবিদদের তুলনা করা যেতে পারে, অপরাধের পরে ঘটনাস্থলে হাজির হওয়া পুলিশ কনস্টেবলদের সাথে। যারা অপরাধ বা মৃত্যুর তদন্তের প্রাথমিক "বয়ান" তৈরী করে, অর্থাৎ সাক্ষীদের সাক্ষ্য নেয় ও তা রেকর্ড করে। তদন্তের এই সবচেয়ে প্রাথমিক ধাপে যা কিছু তথ্য পাওয়া যায় তা শুধু রেকর্ড করা হয়। কিছু প্রমাণ বা অপ্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় না।
এই প্রাথমিক বয়ান পরের ধাপের বিস্তারিত অনুসন্ধানের দিক নির্দেশ করে। যদিও পরবর্তী অনুসন্ধান এবং পদক্ষেপ, ক্ষমতার অলিন্দের উপর নির্ভর করে। কেসের গুনাগুন এবং কিছু অন্যান্য প্রভাবের ওপরও নির্ভর করে ঠিক করা হয় কেসটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে না বন্ধ করা হবে।
বেশি বেশি উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে, বিরল থেকে বিরলতম রোগের চিকিৎসার জন্য নিজেদের চিকিৎসা দক্ষতাকে আরও তীক্ষ্ণ করে তোলার বিলাসিতার সুযোগ চিকিৎসকদের রয়েছে। কিন্তু মহামারী বিশেষজ্ঞদের, পুলিশের কনস্টেবলদের মতো, বাস্তববাদী হতে হয়। এবং জনগনের স্বাস্থ্যের বিষয়ে সমাজ বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ এবং নাগরিক সহ অন্যান্যদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে হয়।
জনগণের পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য কিছু দেওয়া এবং কিছু নেওয়ার ভিত্তিতে তাদের একটা ভারসাম্য রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হয়। প্রায়শই এই ভারসাম্যগুলো চটকদার হয় না।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ভারতে, অপুষ্টির পটভূমিতে, ডায়ারিয়া এবং কোভিড-১৯ ব্যতীত শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য সংক্রমণের মতো প্রতিরোধযোগ্য রোগের কারণে, প্রতিদিন ২০০০-এরও বেশি শিশু মারা যায়। নিরাপদ পানীয় জল, জঞ্জাল সাফ, শৌচাগার, আবাসন, সকলের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই সব মৃত্যুর বেশিরভাগই প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
কিন্তু এসব কোনো ঝা চকচকে কাজ নয়। নিত্যদিনের, নিরস, ম্যাড়মেড়ে নিত্য কাজ দিয়ে এসব করা যেতে পারে। এর তুলনায়, কোভিড-১৯-এর জন্য, রেকর্ড সময়ে তৈরী করা একাধিক (৩৬টি রয়েছে তালিকায়) ফাস্ট ট্র্যাক ভ্যাকসিন তৈরী, সেলিব্রিটি চিকিৎসক, ক্রীড়াবিদ, চলচ্চিত্র তারকা এবং বলিউড গায়কদের দ্বারা সেসবের প্রচার, ঝা চকচকে নতুন গাড়ি চড়ার মতই অনেক বেশি গ্ল্যামারাস।
আজকে, সারা দুনিয়ায়, সামাজিক বিপণন নিরস বিজ্ঞানের জায়গা দখল করেছে। নিরস পরিসংখ্যানের চেয়ে চটকদার স্লোগান জনসাধারণের কাছে অনেক বেশি আবেদন তৈরী করে। কিন্তু এই নিরস পরিসংখ্যানই খুব কম মৃত্যুহার সম্পন্ন একটি রোগের জন্য বিরাট আর্থিক সংস্থানের বিষয়কে প্রশ্ন করার সাহস রাখে।
এমনকি সংক্রমণের ফলে জনসাধারণের মধ্যে শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির হওয়ার মতো মৌলিক বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলোও, চটকদার না হওয়ায়, কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে "সকলের জন্য টিকার", "যুদ্ধের ডাক"-এর তুলনায় কম আকর্ষক হয়। কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সার্বজনীন টিকা নিয়ে সন্দেহ আছে এমন যে কাউকে অ্যান্টি-ভ্যাক্সার হিসাবে চিহ্নিত করা হতে পারে।
অন্য দিকে, সারা বিশ্বের ভ্যাক্সিন এবং করোনা সংক্রমণের তথ্য ভাণ্ডার থেকে উদ্ভূত, গণটিকাকরণের এক বছর পর থেকেই যে প্যাটার্ন এবং প্রবণতাগুলি দেখা গেছে, তা এই যুদ্ধ জিগিরকে খাটো করার জন্য যথেষ্ট। গণটিকাকরণ শুরুর আগে এবং পরে কিছু দেশের সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হারের প্রবণতাগুলি চার্টের মাধ্যমে দেখানো হোলো। এগুলির থেকে পাঠকরা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, কোভিড এর ক্ষেত্রে সংক্রমণ হওয়াকেই রোগ হওয়া বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।
ইন্টারনেটে, সবার জন্য উন্মুক্ত ওয়েবসাইট, ওয়ার্ল্ডোমিটার এবং ভ্যাকসিন ট্র্যাকার, থেকে পাওয়া তথ্য থেকে সংকলিত এই সব চার্টগুলো বেশ হতাশাজনক। গনটীকাকরণের যুক্তি অনুযায়ী আশা করা উচিত যে গণটিকাকরণ, রোগ এবং মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনবে। কিন্তু চার্টগুলো উল্টো হিসেব দেখাচ্ছে। প্রায় সমস্ত গ্রাফের ডান দিকে, যা টিকাকরণ পরবর্তী সময়ের, তা বেশি রোগ এবং বেশি মৃত্যুর হার দেখাচ্ছে বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলিতে। এই আপাত বৈপরীত্যের তদন্ত প্রয়োজন।
ইউরোপিয়ান জার্নাল অফ এপিডেমিওলজিতে প্রকাশিত একটি আরও বিস্তৃত গবেষণায় ৬৮টি দেশ এবং ২,৯৪৭টি মার্কিন কাউন্টিতে গণটিকাকরণ এবং রোগ বৃদ্ধির মধ্যে কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি। (https://www. ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/ PMC8481107/)
এই মহামারীতে সবচেয়ে দুঃখজনক ভুল হল এই যে মহামারী বিশেষজ্ঞদের পরিবর্তে বড় বড় চিকিৎসকেরা জনস্বাস্থ্য নীতি নির্ধারণ করে চলেছেন, যার মধ্যে রয়েছে লকডাউন, মাস্ক সম্পর্কিত নির্দেশিকা এবং গণটিকাকরণ।
মিডিয়া হাইপ এবং চিকিৎসা প্রযুক্তিতে অগ্রগতির ফলে বেশিরভাগ সফল চিকিৎসক আজকাল সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস উপভোগ করেন। তাঁরা জনগণ ও নীতিনির্ধারকদের আস্থাভাজন। এর নেতিবাচক দিকটি হল এই যে নিজস্ব বিষয়ে পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও, বা এর কারণেই, জনগণের সার্বিক স্বাস্থ্য এবং রোগ সম্পর্কিত জন সমাজের সামগ্রিক চিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা এনাদের নেই।
মহামারীর সময়ে নীতি নির্ধারণের নেতৃত্বে থাকা একজন চিকিৎসককে এমন একজন ব্যক্তির সাথে তুলনা করা যেতে পারে যিনি সারাজীবন কেবলমাত্র টু হুইলার চালিয়েছেন এবং হঠাৎ একদিন হাইওয়েতে একটি ভারী ট্রাকের চালক হয়ে বসেছেন।
মহামারীর তথ্য ভাণ্ডার হল কনস্টেবলের তৈরি করা সেই বয়ান, যা নিয়ে নিরপেক্ষ এবং সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন গবেষকদের গভীর গবেষনা প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশত, করা হচ্ছে একটা উল্টো কাজ। জটিল এবং বিমূর্ত (বাস্তব তথ্যের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত) কিছু গাণিতিক মডেল ব্যবহার করা হচ্ছে, লকডাউন, স্কুল বন্ধ, মাস্ক নির্দেশিকা এবং গণটিকাকরণের মত পদক্ষেপগুলিকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য। এবং এইসব সামাজিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বিরাটাকারে এবং তার ফলে সরকারী কোষাগার থেকে বিপুল পরিমানে খরচও হচ্ছে।
ল্যানসেটে প্রকাশিত এরকম একটি সাম্প্রতিক মডেল অনুমান করেছে যে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রদানের প্রথম বছরে ১৪.৪ থেকে ১৯.৮ মিলিয়ন মৃত্যু প্রতিরোধ করা গেছে ( https://www.thelancet.com/journals/ laninf/article/PIIS1473-3099(22)00320-6/fulltext)। এই মডেলটি তৈরি করতে অর্থ সাহায্য করেছিল জি এ ভি আই (GAVI), বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, ডব্লু.এইচ.ও(W.H.O) এবং অন্যান্য অংশীদাররা!
এটি পাঠকদের উপর নির্ভর করছে যে তারা গাণিতিক মডেলিং-এর বিজ্ঞান, যা অপার্থিব বাস্তবতা তৈরি করে, তার উপর বিশ্বাস রাখবে নাকি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত তথ্য ("কনস্টেবলের নেওয়া বয়ান") থেকে পাওয়া জ্ঞান কে বিশ্বাস করবে।
আশা করি এই "কনস্টেবল স্তরের" বয়ানটি আমাদের "চৌকিদার" বা চৌকিদারেরা নোট করে রাখবেন এবং বিশদ বৈজ্ঞানিক তদন্তের নির্দেশ দেবেন।
(ডাঃ অমিতাভ ব্যানার্জী, এম.ডি.,
বর্তমানে ডি.ওয়াই. পাটিল মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন-এর অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এবং পূর্বে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মহামারী বিশেষজ্ঞ ছিলেন।)