গত দুই বছর যাবৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তোড়জোড় চালাচ্ছে তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে মহামারীর অজুহাতে চুক্তিবদ্ধ করতে। জনস্বাস্থ্যের দোহাই দিলেও এই চুক্তি আদতে মানুষকে সংক্রামক রোগের ভয় দেখিয়ে হরেক রকম বিধি নিষেধের আওতায় বেঁধে ফেলার এক আইনি ফিকির। সরকারের One Health Policy নীতিগত অবস্থানে খাদ্য, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য পরিষেবাকে জনস্বাস্থ্যের পরিধি হিসেবে নির্দিষ্ট করেছে। অথচ সরকারি স্বাস্থ্য বাজেট বরাদ্দ হয় মূলত স্বাস্থ্য বীমা এবং সংক্রামক রোগের চিকিৎসা এবং প্রতিষেধকের খাতে। এমত অবস্থায় আমরা, জনস্বাস্থ্য মোর্চা, মনে করছি যে প্যান্ডেমিক চুক্তি ও IHR 2005 সংশোধনীগুলি জনস্বাস্থ্যের সার্বিক পরিসরকে আরও সঙ্কুচিত করবে। দেশবাসীর সার্বিক পুষ্টি, অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা, বিনামূল্যে সরকারি আউটডোর স্বাস্থ্য পরিষেবা, ওষুধের দাম ও মান নির্ণয়, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত স্বাধীন গবেষণার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি অবহেলিত থেকে যাবে আরও বেশি।
স্ফিয়ার ইন্ডিয়া, শ্ব: ও Climate Action Resources Network - এশিয়া প্যাসিফিকের যৌথ উদ্যোগে গত ১৮ই মে, ২০২৪ প্যান্ডেমিক চুক্তি বিষয়ে একটি অনলাইন আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সভায় বক্তা ছিলেন ডা: অমিতাভ সরকার। তিনি জেনেভা গ্র্যাজুয়েট ইন্সিটিউটে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষণারত। আলোচনা সভার বক্তা ডা: অমিতাভ সরকার এবং আলোচনায় উপস্থিত আরো কয়েকজন ব্যক্তি WHO প্যান্ডেমিক চুক্তির ড্রাফ্ট তৈরির কনফারেন্সে সে সময় জেনেভায় উপস্থিত ছিলেন। আমরা জনস্বাস্থ্য মোর্চা সেই আলোচনা সভায় ডাঃ সরকারের কাছে কিছু প্রশ্ন রেখেছিলাম। আমাদের প্রশ্নগুলোর সঙ্গত উত্তর পাওয়া গেল কিনা তা ভিডিও দেখলে বুঝবেন...
Pandemic Preparedness Conversation with PAPH - জনস্বাস্থ্য মোর্চা ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিওটি দেখুন।
ডাঃ সরকারের বক্তব্যের বিষয় ছিল 'Pandemic Preparedness and Public Health Treaties'। আমরা ডাঃ সরকারকে ধন্যবাদ জানাবো Global Constitutionalism বা বিশ্ব নিয়মতন্ত্রের বিষয়টিকে পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরার জন্য। WTO, GATT প্রভৃতি চুক্তির সাথে প্যান্ডেমিক চুক্তির সম্পর্ক ঠিক কিরকম তা ডাঃ সরকার পরিষ্কার ভাবে তাঁর আলোচনার শুরুতেই বুঝিয়েছেন। WTO, GATT, International Health Regulations (IHR2005), সম্ভাব্য প্যান্ডেমিক চুক্তি - এই প্রতিটি ধাপে একটু একটু করে আমরা এগিয়ে চলেছি এক বিশ্ব নিয়মতন্ত্রের দোরগোড়ায়। তিনি আরও বলেন যে অতিমারী প্রস্তুতি সংক্রান্ত WHO চুক্তিগুলি সাধারন মানুষকে ব্যবসা-বাণিজ্যের কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য তৈরি করা হচ্ছে। এই চুক্তি নাকি আদতে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জনস্বাস্থ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার হাতিয়ার।
এই বিশ্ব নিয়মতন্ত্রের দুনিয়া ডাঃ সরকার যেভাবে দেখছেন আর আমরা, জনস্বাস্থ্য মোর্চা, যেভাবে দেখি তার মধ্যে ফারাক আশা করি, আপনি আলোচনাটি শুনলে বুঝতে পারবেন।
ডাঃ অমিতাভ সরকারের কাছে আমাদের প্রথম প্রশ্ন :
ভারতবর্ষে WTO ও গ্যাট চুক্তি সই হয়েছিল নব্বই এর দশকের শুরুতে। তার বছর কুড়ির মধ্যে আমাদের দেশ আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনামে এসেছিল কৃষক আত্মহত্যার কারণে। অবাস্তব কৃষি পরিকল্পনা, সবুজ বিপ্লব পরবর্তী ঋণনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা, জি এম শস্য নিয়ে অপরিকল্পিত পরীক্ষা নিরীক্ষা, ইত্যাদিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল কৃষক আত্মহত্যার অন্যতম কারন হিসেবে। অতিরাষ্ট্রিক চুক্তিগুলি সেদিন মানুষকে বাঁচাতে পেরেছিল কি, নাকি সেগুলির জন্যই সমাজ এবং অর্থনীতির এই বেহাল দশা হয়েছে ?
ডাঃ অমিতাভ সরকারের কাছে আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন :
ভারতে ২০১১ - ২০১২ সালে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফউন্ডেশন ও PATH এর বিরুদ্ধে আদিবাসী শিশুদের ওপর অনৈতিকভাবে HPV টিকার ক্লিনিকাল ট্রায়াল চালানোর অভিযোগ ওঠে। ২০১৩ সালে সংসদে এই বিষয়ে আলোচনা হয় এবং সেই আলোচনার রিপোর্টে উঠে এসেছিল ট্রায়ালের নিয়ম ভাঙার এবং প্রশাসনিক দুর্নীতির ভায়াবহ চিত্র। ২০১৩ সালে এই সংস্থাগুলিকে আমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ২০২১ সালে বকলমে সেই একই কর্পোরেট সংস্থা আবার ফিরে আসে আমাদের দেশে তাদের অপরীক্ষিত বিতর্কিত করোনা টিকার ঝুলি নিয়ে। এবারেও ক্লিনিকাল ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা ঘুষ দিয়ে এমারজেন্সি ব্যবহারের ছাড়পত্র আদায় করে। লোকসভা ভোটের আগে নির্বাচনী বণ্ডের তথ্য সামনে আসার ফলে একথা আজ সকলের কাছে সুস্পষ্ট। WHO অতিমারী চুক্তি কি আদৌ সাধারন মানুষকে এইভাবে গিনিপিগ হওয়ার হাত থেকে বাঁচাবে?
ডাঃ অমিতাভ সরকারের কাছে আমাদের তৃতীয় প্রশ্ন :
বিগত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক সারণীতে ভারতের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নানান মহল থেকে। দেখা যাচ্ছে শিশু অপুষ্টি, শিশু মৃত্যু, প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভারতের হাল অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। এমত পরিস্থিতিতে অতিমারী চুক্তির কারণে যদি আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেটে অতিমারী প্রস্তুতির জন্য সবসময় টাকা বরাদ্দ রাখতে হয় তাহলে পুষ্টির মতো অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবহেলিত হবে। ভারতের মতো একটি দেশের স্বাস্থ্য বাজেটের ফোকাস পুষ্টি এবং গঠনমূলক বা বুনিয়াদি সুস্বাস্থ্য নির্মাণের জন্য প্রকল্প হওয়া উচিত নয় কি? সকলের কাছে বিনামূল্যে সার্বিক সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া জাতীয় লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় কি?
ডাঃ অমিতাভ সরকারের কাছে আমাদের চতুর্থ প্রশ্ন :
টি বি রোগের প্রাদুর্ভাব আজকেও আমাদের দেশে আশঙ্কাজনক। অপুষ্টি এই রোগের অন্যতম প্রধান কারন। আমাদের দেশ বহু বছর আগেই BCG বা টি বি র টিকাকরণ প্রক্রিয়া সমাপ্ত করেছে। এখন জাতীয় স্তরে শোনা যাচ্ছে দেশের পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিদের আবার টিবির টিকা দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন - টিবি টিকা নাকি পুষ্টিকর খাদ্য ও প্রোটিন সমৃদ্ধ মিড ডে মিল - দেশবাসীর জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন কোনটি ?
ডাঃ অমিতাভ সরকারের কাছে আমাদের পঞ্চম প্রশ্ন :
মৎস্য প্রেমী বাঙালিরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এধরনের চুক্তি নিয়ে খুব চিন্তিত। WHO এর ওপর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানের চাপ রয়েছে বিশ্বজুড়ে জীবন্ত জন্তুর বাজার বন্ধ করার। আমাদের দেশের মাছ মাংসের বাজার সম্পূর্ণ ভাবে এর আওতায় পড়ে। আমাদের মতো দেশে স্থানীয় জীব বৈচিত্র্যের ওপরে মানুষ নির্ভরশীল থাকে খাদ্যের জন্য। হরেক রকম সংক্রামক রোগের ভয় দেখিয়ে এইসব বাজার তুলে দিলে সাধারন মানুষ তাদের পুষ্টির চাহিদা মেটাবে কিভাবে?
ডাঃ অমিতাভ সরকারের কাছে আমাদের শেষ প্রশ্ন :
WHO একটি অতিরাষ্ট্রিক সংস্থা। WHO এর নিজস্ব ওয়েবসাইট বলছে যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় $1 বিনিয়োগ করলে, দশ বছরে আয় হবে $35 । সদস্য রাষ্ট্রগুলির অনুদান ছাড়াও WHO তে বহু নামজাদা কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে । WHO এর সর্ববৃহৎ বেসরকারি বিনিয়োগকারী হল বিল আন্ড মেলিন্ডা গেটস ফউন্ডেশন, GAVI ও রকেফেলার ফাউন্ডেশন। এধরনের কর্পোরেট অনুদানপুষ্ট WHO কি আদৌ আমাদের দেশের সাধারন মানুষকে ব্যবসা - বাণিজ্যের কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে বলে আপনি মনে করেন?
ডাঃ অমিতাভ সরকার জোরের সাথে বলছেন যে এধরনের চুক্তি মানুষকে ব্যবসা - বাণিজ্যের কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করবে। তিনি বলছেন এইসব চুক্তির বিষয় টিকাকরন নয়। জীবন্ত জন্তুর বাজার এবং জীব বৈচিত্র্যের বাজারগুলিতে সংক্রমণের যথেষ্ট ভয় রয়েছে। তাই সতর্কতার প্রয়োজন আবশ্যিক।
আমরা, জনস্বাস্থ্য মোর্চা, বলছি যে প্যান্ডেমিক চুক্তি ও IHR 2005 সংশোধনী বা তদানুসারি আমাদের জাতীয় One Health নীতি আমাদের খাদ্য, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, প্রভৃতি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে অতিরাষ্ট্রিক সংস্থার নজরদারিতে বেঁধে দিতে চাইছে। ২৭শে মে থেকে ১লা জুন ২০২৪, জেনেভায় ৭৭তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশে প্যান্ডেমিক চুক্তি পাশ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু কায়দা করে অতিমারী সংক্রান্ত বেশ কিছু সংশোধনী পাশ হয়ে গেছে এই সমাবেশে। ভারত সহ সদস্য রাষ্ট্রগুলি সম্মতি জানিয়েছে যে তারা অতিমারীর জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকবে। তারা ভ্যাক্সিন পাসপোর্ট, বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ক্ষেত্র বিশেষে Informed Consent বা অবহিত অনুমতি তুলে দেওয়ার বিষয়ে সম্মতি প্রদান করেছে। গত কয়েক মাসে আমরা জেনেছি যে করোনা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিষয়ে অবগত থাকা সত্ত্বেও ভ্যাক্সিন প্রস্তুতকারী কোম্পানি আর সরকার আমাদের একযোগে বলেছিল যে 'টিকা ১১০% নিরাপদ'। এমত অবস্থায় ভ্যাক্সিন পাসপোর্ট, বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ক্ষেত্র বিশেষে Informed Consent বা অবহিত অনুমতি তুলে দেওয়ার মতো আইনি পরিবর্তনকে আমরা সাধারন মানুষের জীবন জীবিকার অধিকারের ওপর কর্পোরেট হস্তক্ষেপ বলেই মনে করছি।
তথ্যসূত্র :
১) সম্পূর্ণ আলোচনাটি শুনুন - https://www.youtube.com/watch?v=OJ0Sa0ZPBBY
২) https://www.who.int/news/item/01-06-2024-world-health-assembly-agreement-reached-on-wide-ranging--decisive-package-of-amendments-to-improve-the-international-health-regulations--and-sets-date-for-finalizing-negotiations-on-a-proposed-pandemic-agreement