বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশবাদ, ভৌগোলিক ভাবে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদ তাদের শোষন চালাত অধিগৃহীত দেশগুলোতে কৃষি ও খনিজ সম্পদ এবং শ্রমশক্তি শোষণের মাধ্যমে পুঁজির পুঞ্জীভবন করে। সেই সময়ে, সাম্রাজ্যবাদীরা মানবজাতির শোষণের অন্য কোনও উপায় জানত না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই সাম্রাজ্যবাদের অগ্রসর হওয়ার ধারা থমকে যায় এবং উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতা সংগ্রাম তীব্রতর হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, অনেক উপনিবেশকে তথাকথিত স্বাধীনতা প্রদান করতে হয়েছিল, এবং সেইজন্য পূর্বতন শাসকদের দ্বারা তাদের পরোক্ষ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়েছিল বিভিন্ন জোট, কমনওয়েলথ ইত্যাদি শব্দের আড়ালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, কিছু কিছু উপনিবেশ, যারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল, তারা সেই লড়াইয়ের মাধ্যমেই প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নিজেদের আর্থ-সামাজিক কাঠামো পরিবর্তন করেছিল। এসব থেকে সাম্রাজ্যবাদ বড় ধাক্কা খেয়েছে। তারা বেগতিক বুঝে প্রকাশ্য ভৌগোলিক আধিপত্য পরিত্যাগ করে সামাজিক আধিপত্যে মনোনিবেশ করে, এবং পুঁজিবাদকে সামাজিক কাঠামোর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার পথ নেয়। তারা নাৎসিদের কাছ থেকে পাওয়া বিদ্যাকে পুঁজি করে, নতুন সাম্রাজ্যবাদী বিস্তারের প্রথম লগ্নে, সংবাদমাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। যখন সংবাদমাধ্যম পুঁজির সাথে মিশে যায় এবং সাম্রাজ্যবাদীদের অধীনে দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রিত রাখা সম্ভব হয়, তখন থেকে সাম্রাজ্যবাদীরা, সংবাদমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে, অন্যান্য সামাজিক ক্ষেত্রগুলিতে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বৃদ্ধির কাজ শুরু করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, শিল্পকলা, সরবরাহ, সব ক্ষেত্রকে এই অক্ষে টানা হয় এবং পুঁজি সঞ্চয়ের কাজে লাগানো হয়। জন্ম হয় পরিষেবা ক্ষেত্রের।
এই নিবন্ধে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করব, কিভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্র পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে ব্যবহৃত হচ্ছে। ধরে নিচ্ছি পাঠকরা একথা বুঝবেন যে, যে কোনও ব্যবসা, তা উৎপাদন খাতে হোক বা পরিষেবা খাতে, একটি উদ্বৃত্ত মূল্য (লাভ) তৈরি করে এবং এটিই হল মূলধন সঞ্চয় করার প্রক্রিয়া বা সামাজিক উদ্বৃত্তের ব্যক্তিগত আত্মসাতের প্রক্রিয়া।
আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের বিকাশ ইউরোপে শুরু হয়েছিল একটি উত্তরাধিকারকে বহন করে; এ বিদ্যা ইয়োরোপে আসে মধ্যে প্রাচ্য থেকে এবং মধ্যপ্রাচ্যে এ বিদ্যার উৎপত্তি ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করে। সেই যুগের ইউরোপীয় দেশগুলির সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় জন স্বাস্থ্যের বিকাশ শুরু হয়েছিল, তাদের নিজস্ব দেশে নিকাশি ব্যবস্থা বজায় রাখা, ট্রপিক্যাল দেশগুলো থেকে ছড়িয়ে পড়া সংক্রমণ এড়ানো এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদী সেনাবাহিনী ও অন্যান্য ক্যাডারদের উপনিবেশগুলোর সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার মূল লক্ষ্য নিয়ে। সাম্রাজ্যবাদীরা উপনিবেশগুলোকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে অবহেলা করেছে, তেমনই এই উপনিবেশগুলোর বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশকে অবহেলা ও দমন করেছে, যদিও এই একই ঐতিহ্য থেকে শিক্ষা নিতে তারা কসুর করেনি। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এই একই ঘটনা ঘটেছে।
রাশিয়া, (যা পরে ইউএসএসআর-এ বিবর্তিত হয়েছিল), চীন ও অন্যান্য বিভিন্ন দেশে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই, জনগণের চিকিৎসা বিদ্যা (তা সে যে বর্ণেরই হোক না কেন), জনগণের বিজ্ঞান এবং জনগণের সংস্কৃতি সারা বিশ্বে বিকশিত হতে শুরু করেছিল। তার আগে নয়। কিন্তু সে আলোচনা ভিন্ন।
সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে আধুনিক চিকিৎসা কখনই জনগণের জন্য এবং জনগণের দ্বারা চিকিৎসা বিদ্যা হয়ে ওঠেনি। জনগণের অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও, আধুনিক চিকিৎসা প্রায়শই জনগণের অভিজ্ঞতার উপর ভর করে নিজের বিকাশ ঘটিয়েছে। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল এডওয়ার্ড জেনারের দ্বারা গুটিবসন্তের (স্মল পক্স) টিকা উদ্ভাবন। যে দুধ বিক্রেতারা কাউপক্সের সংস্পর্শে আসত, তারা গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা লাভ করত, জনগণের এই অভিজ্ঞতা থেকে জেনার তার গবেষণা শুরু করেন। যদিও এই গবেষণা জনগণের অংশগ্রহণ বর্জিত ছিল।
কয়েক দশক আগে পর্যন্ত আধুনিক চিকিৎসা সরকারী আর্থিক সাহায্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সেই সময়ে যে বিজ্ঞান অনুসৃত হত, তাতে কিছু বিচক্ষণতা ছিল এই অর্থে যে সমস্ত জ্ঞানার্জন কেবল লাভের উদ্দেশ্য মাথায় রেখে করা হত না। সে সময়ে, ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের সবে উদ্ভব হচ্ছিল এবং এই শিল্প তখন শুধুমাত্র স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থার মধ্যে ব্যবহৃত ওষুধের বিক্রী থেকে মুনাফা করত। আজকের তুলনায়, সে মুনাফা ছিল অল্পই। মেডিকেল যন্ত্রপাতি শিল্পও তখন একেবারেই শিশু। ওষুধের চর্চা সেকালের চিকিৎসা নৈতিকতার দ্বারা চালিত হত। যদিও মেডিকেল যন্ত্রপাতি এবং ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের অনৈতিক প্রভাব স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রের উপর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু তখনও তা খুব বেশী মাত্রায় পৌঁছায়নি।
অতি মুনাফার চাপ, সাম্রাজ্যবাদীদের চাপে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। সাম্রাজ্যবাদীরা জনগণের পছন্দ নির্ধারণে বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব শিখেছিল। বিজ্ঞাপন, যা জনমত তৈরি করতে সাহায্য করে। সাম্রাজ্যবাদীরা, বিভিন্ন মতামত, অসমর্থিত তথ্য ও পরিসংখ্যান, অর্ধসত্য এবং নির্লজ্জ মিথ্যার মাধ্যমে জনমত তৈরিতে মিডিয়ার হিটলারি ব্লিতজক্রিগ এর গুরুত্ব আগেই দেখেছিল। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরের দশকগুলিতে সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়া ও অর্থনৈতিক 'বিশেষজ্ঞ'-দের (বলা ভাল "অর্থনৈতিক ঘাতক”) ব্যবহার করে এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় অনেক বিরোধী সরকারের পতন ঘটানো হয়েছিল এবং আরও অনেক জায়গায় পুতুল শাসনের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই দেশগুলির অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পরিকল্পনা তৈরিতে এই সব অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা যে দারুণ দক্ষ সে সম্পর্কে সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়া জনমননে এক বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। এর ফল হয়েছিল এই যে এই সব অর্থনৈতিক ঘাতকেরা পূর্বতন উপনিবেশ এবং বেশ কিছু সদ্য স্বাধীন দেশকে সাম্রাজ্যবাদী ঋণের জালে বেঁধে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। এই ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থার জন্য, বা বলা ভালো যে কোনো পরিষেবাকে বেসরকারিকরণ করার জন্য, রাষ্ট্রগুলোকে প্রস্তুত করা হোলো।
এছাড়াও আরো একরকম সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। অপ্রয়োজনীয়, এমনকি ক্ষতিকারক, শিশুর খাদ্য, হেলথ টনিক, মাল্টিভিটামিন, অপ্রয়োজনীয় কাশির সিরাপ ইত্যাদির প্রচলন শুরু করা হোলো, বিজ্ঞাপন এবং খ্যাতনামা ব্যক্তিদের দ্বারা অনৈতিক অনুমোদন ব্যবহার করে। ফার্মা শিল্পের দ্বারা স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থার উপর এ ছিল এক পরীক্ষা - একটা পাইলট প্রোজেক্ট। বিজ্ঞাপনগুলো কেবল সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন এবং বিল বোর্ডগুলিতেই দেওয়া হয়নি, ফার্মা কোম্পানির প্রতিনিধিরা ব্যক্তিগতভাবে পৌঁছে যাওয়া শুরু করলেন চিকিত্সকদের কাছে এবং চিকিৎসা শাস্রের ইউনিভার্সিটির বিদ্যার বাইরেও তাদের কিছু পড়াতে শুরু করলেন। চিকিৎসকদের তারা উত্সাহিত করতে শুরু করলেন কিছু অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে এই সব অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকারক ওষুধগুলো প্রেস্ক্রিপশানে লিখে দিতে। এইসব পাইলট প্রোজেক্টগুলো দুর্দান্ত সাফল্য লাভ করল। স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থায়, প্রয়োজনীয় ওষুধের তুলনায়, অপ্রয়োজনীয় পণ্যের প্রচারের মাধ্যমেই বেশি মুনাফা আসা শুরু হোলো। এই মুনাফা আরও উচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফার্মা শিল্পের অভ্যন্তরে চাপ বাড়তে শুরু করল।
পাশাপাশি কিছু ব্যক্তি চিকিৎসক এবং কিছু চিকিৎসকদের গ্রুপ এই অনৈতিক মুনাফার বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠে, এই ধরনের অনৈতিক অনুশীলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং একটি সংগ্রামের ধারার জন্ম দেয়। ‘র্যাশনাল চিকিৎসা’- র ধারা সৃষ্টি হয়। যদিও এটা 'জনগণের চিকিৎসা' ছিল না, তবু একথা অনস্বীকার্য যে এটা চিকিৎসকদের আন্দোলন হিসাবে অনৈতিক অনুশীলনের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল। এই আন্দোলনগুলো প্রধানত ইউরোপে গড়ে উঠেছিল কিন্তু বাংলাদেশের ডাঃ জাফরুল্লা চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি ছোট ক্ষেত্রের কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এই আন্দোলনগুলো সারা বিশ্বে একটি উল্লেখযোগ্য গতি অর্জন করেছিল। প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে, সার্ব্বজনীন সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার দাবির আন্দোলনের সাথে একসাথে আল্মা আটায় ১৯৭৭ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধিবেশনে "সকলের জন্য স্বাস্থ্য" ঘোষণা করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (WHO) প্রভাবিত করেছিল এই র্যাশনাল চিকিৎসার আন্দোলন। এই র্যাশনাল চিকিৎসার আন্দোলনগুলো WHO কে অপরিহার্য ওষুধের তালিকা তৈরিতেও চাপ দিয়েছিল; এবং তা প্রথম তৈরী হয় ১৯৭৮ সালে। এত কিছুতে, ফার্মা শিল্পের মুখ ভার হওয়াটাই স্বাভাবিক!
এবার, ফার্মা এবং মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্টেশন শিল্পের মধ্যে জোট তৈরির জন্য প্রস্তুতি শুরু হোলো। পূর্বতন উপনিবেশগুলোতে স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থার, বড় আকারে বেসরকারীকরণের প্রস্তুতিও শুরু হোলো। একটি নতুন ক্ষেত্র মুনাফাখোরদের সঙ্গী হোলো, স্বাস্থ্য বীমা। এই প্রস্তুতিগুলো ১৯৮০-র দশকে পুরোদমে চলছিল এবং এরই ফল স্বরূপ পরবর্তী দশকের মধ্যে বাজারে একটি নতুন সত্তার আবির্ভাব হোলো, মেডিকেল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স (এমআইসি) অর্থাৎ ফার্মাসিউটিক্যাল, মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্টেশন, স্বাস্থ্য বীমা, বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার জোটের একটি নতুন পুঁজি লগ্নীর ক্ষেত্র। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ক্ষেত্রের একটি অংশও এতে পরে যোগ দিয়েছে। এই জোটগুলোর ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের ফলে বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা ছোট ব্যবসায়ীদের ব্যবসা হস্তগত হয় এবং সারা বিশ্বে কয়েকটি মাত্র কর্পোরেট সংস্থার হাতে পুঁজি পুঞ্জীভূত হয়। একই ঘটনা অন্যান্য শিল্পেরও গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাতে গোনা কিছু সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা এখন বহু কর্পোরেট সংস্থার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে পুঁজি নিয়ন্ত্রণ করছে।
এমআইসি-র উত্থানের প্রাথমিক পর্যায়ে, সাম্রাজ্যবাদীরা একটি বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিল, তা হোলো বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা প্রচলিত চিকিৎসা শাস্ত্রের ধারনাগত মৌল পরিবর্তন। যা চিকিৎসক এবং জনগণের মননের মধ্যে, সামাজিক কাঠামোর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল, যাতে ফার্মাসিউটিক্যাল, মেডিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টেশন, বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য বীমা ক্ষেত্রের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সমগ্র সরকারী ব্যবস্থাপনার পরিবর্তনগুলো নিয়ে মানুষ কোনো প্রশ্ন না তোলে।
এরই সাথে সাথে, ১৯৯০-এর দশক থেকে বিশ্বজুড়ে নির্বাচিত সরকারগুলি দ্বারা জনস্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থাকে দুর্বল করার জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা দেখা গেছে, এবং এই প্রচেষ্টা বেশি দেখা গেছে পূর্বতন উপনিবেশগুলিতে, নয়া সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা পরিচালিত স্ট্র্যাটেজিক এডজাস্টমেন্ট কর্মসূচীর অধীনে। একই সময়ে বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলো এই প্রাক্তন উপনিবেশগুলিতে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। এই বেসরকারি হাসপাতালগুলো যে কত ভালো এবং সরকারী হাসপাতালের অবস্থা কতটা খারাপ তা নিয়ে মিডিয়া হঠাতই খুব সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করে। ১৯৯০-এর আগেই চিকিৎসা পরিষেবা পূর্বতন অনেক উপনিবেশগুলোতেই পণ্য হিসাবে আইনত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮৬ সালে ভারতে উপভোক্তা সুরক্ষা আইন পাস করা হয়েছিল এবং এতে চিকিৎসা পরিষেবাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটিই ছিল চিকিৎসার ধারনায় প্রথম মৌল পরিবর্তন। সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা যে তুলনায় বেসরকারী কর্পোরেটদের ধারে কাছে আসার যোগ্য নয় সে বিষয়ে জনমতের পরিবর্তন তৈরী করা শুরু হোলো।
বেসরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব স্বাস্থ্য বীমা ক্ষেত্রের প্রচারকদের দ্বারাও প্রচার করা হচ্ছিল, এবং এই স্বাস্থ্য বীমা ক্ষেত্র এমআইসি-র একটি অংশের অংশীদার। পরিবর্তনটি এই ধারণার উপর ভিত্তি করে ছিল গড়ে উঠেছিল যে এটি আপনার নিজের স্বাস্থ্যের জন্য করা একটি বিনিয়োগ। এবং কে না জানে যে একটি ভাল বিনিয়োগ আপনাকে প্রয়োজনের সময়ে ভাল রিটার্ন দেয়? এটি সম্ভবত পণ্য হিসাবে স্বাস্থ্যের সবচেয়ে গভীর মৌল পরিবর্তন ছিল। অথচ এর বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীর জনগণের সচেতন অংশ থেকে আপত্তি এবং প্রতিবাদ কিছু কম হয়নি। এমনকি, স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের চলচ্চিত্রগুলিতে কিউবা, ইউরোপীয় দেশগুলো, এমনকি কানাডার সরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবার বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বীমা ভিত্তিক স্বাস্থ্য পরিষেবার দুর্বলতাগুলো দৃঢ়ভাবে তুলে ধরা ধরা রয়েছে। জনগণের এইসব "ছোটখাটো" সমালোচনা অগ্রাহ্য করে এবং এই মৌল পরিবর্তনের মিডিয়া ব্লিতসক্রীগ দ্বারা এসব সমালোচনা এবং গনআন্দোলনকে উড়িয়ে দিয়ে, পূর্বতন উপনিবেশগুলোতে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো, স্ট্র্যাটেজিক এডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রামের অধীনে বীমা ভিত্তিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা প্রণয়নে বাধ্য করেছিল।
১৯৯০-এর দশক থেকে অনেকগুলো অনুদান নির্ভর পেশাদার চিকিৎসক সমিতির উদ্ভব হোলো এবং বেশ কয়েকটি পুরানো পেশাদার চিকিৎসক সমিতিকে সাম্রাজ্যবাদী অনুদান নির্ভর করে তোলা হোলো। ট্রাস্ট ফান্ডগুলো, যা আসলে সাম্রাজ্যবাদীদের হোল্ডিং এজেন্সি, বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল গবেষণাগুলোর পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে, পেশাদার সমিতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করল। এইভাবে, অনুদান নির্ভর পেশাদার চিকিৎসক সমিতি, বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা, অনুদান নির্ভর ক্লিনিক্যাল গবেষণাগুলোর মাধ্যমে একমুখী এক বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী জীবনধারায় চিকিৎসকদের বেঁধে ফেলা হোলো; যে জীবনধারায় মুনাফাই একমাত্র চালিকা শক্তি।
একটি পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে এই সব চিকিৎসকদের "ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে"র মতো সাম্রাজ্যবাদী প্রচারের আঙিনায় নিয়ে আসা হোলো এবং তারা খুব সহজেই এর শিকার হোলো। ক্যান্সার এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে যেন জনগণের মধ্যে থেকে ক্যান্সার নির্মূল করতে পারবেন তাঁরা! ক্যান্সার মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিদ্যার একটি প্রাচীন অথচ সদা ব্যবহৃত নীতিকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সেই নীতি হোলো - ফার্স্ট ডু নো হার্ম বা প্রথমত কোনো ক্ষতি কোরো না। ক্যান্সার চিকিৎসা করতে গিয়ে কিভাবে এরকম বহু ক্ষতি হয়ে গেছে, এ সম্পর্কে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই শত শত বই প্রকাশিত হয়ে গেছে। রোগী বা তার পরিবারের অজান্তেই, কত কত অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকারক চিকিৎসা করা হয়েছে, প্রচুর গবেষণা রয়েছে তা নিয়ে। ব্রিটেন এর NICE (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ক্লিনিক্যাল এক্সিলেন্স), সহ বহু পেশাদার সংস্থা এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যেও এই বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণাপত্র পাওয়া যেতে পারে।
সংক্রামক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু মৌল পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এমন কিছু সংক্রামক রোগ, যা নির্মূল করা যায় না, তাদের নির্মূলযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। বেশ কিছু গবেষণার ফলে আসল সত্য প্রকাশ হওয়ার আগেই সরকারী কোষাগার থেকে একটি বিরাট অঙ্কের টাকা এই তথাকথিত যুদ্ধের জন্য খরচ হয়েছিল।
হ্যাঁ, ভারতের তৎকালীন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচীর কথাই আমি এখানে বলতে চাইছি।
ডায়াবেটিস মেলিটাস এবং উচ্চ রক্তচাপের ধারণায় মৌল পরিবর্তন আনা হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে যে এই দুটি রোগের নির্ণয়ের জন্য রক্তে শর্করার এবং রক্তচাপের মাত্রাকে কিছু পেশাদার সমিতি দ্বারা নির্ধারিত করা হয়েছিল অবৈজ্ঞানিকভাবে, যার ফলে আরও বেশি মানুষকে এইসব রোগের ওষুধ কিনতে বাধ্য করা যায়, যা ফার্মা শিল্পের মুনাফা বাড়িয়ে দিয়েছিল প্রায় ১০ গুণ।
পুষ্টির ধারণার ক্ষেত্রেও মৌল পরিবর্তন ঘটেছিল; খাদ্যে স্নেহপদার্থ (ফ্যাট) দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতি এবং কিছু বিশেষ ধরণের রান্নার তেলের উপকারিতা সম্পর্কে পেশাদার সমিতিগুলির পেশাদারি উপদেশ দানের মাধ্যমে তা সম্ভব হয়েছিল। পরে, এগুলো ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছিল, এবং সেই অ্যাসোসিয়েশনগুলো এই ভুল স্বীকার করে নিয়েছিল, কিন্তু ভুল উপদেশ এর থেকে উদ্ভূত স্বাস্থ্যের ক্ষতির জন্য দায় স্বীকার কিন্তু করা হয়নি।
ভারতে হিমালয়ের পাদদেশে, মানুষের শরীরে আয়োডিনের ঘাটতির উপর কিছু ছোট গবেষণার ফল থেকে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে কিছু মৌল পরিবর্তন ভারতের সমগ্র জনসাধারণের মননের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে সারা ভারতের মানুষের শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি রয়েছে। এবং লবণের সাথে আয়োডিনকে মিশ্রিত করার শিল্পকে লাভজনক করে তোলার জন্যই জনস্বাস্থ্যের মূল নীতিকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। অথচ দেখুন, এমন একটি গবেষণা, যা লবণকে আয়োডিনযুক্ত করার পদক্ষেপের গুনাগুণ নির্ধারণ করবে, আজও কেউ করে উঠতে পারেননি।
মৌলিক বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যহীন ধারনা পরিবর্তনগুলো এখন চিকিৎসা জগতে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নতুন নীতিমালার সাহায্য নিয়ে, সাম্রাজ্যবাদীরা সেই কাজ শুরু করেছিল, যাকে তারা নিজেরাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বলে অভিহিত করেছে। আমি এটাকে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা বলতে চাইছি না, যেমন অন্য অনেকেই বলছেন। নতুন বিশ্বব্যবস্থা, বলতে আশাব্যঞ্জক কিছু বোঝায়। এটি আসলে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের একটি পুরানো রূপ, একটি ফ্যাসিবাদী শোষণ, যদিও আজ এটি বিশ্ব ফ্যাসিবাদে বিকশিত হয়ে উঠেছে।
১৯৭৮ সালে WHO একটি অপরিহার্য ওষুধের তালিকা (Essential Drug List - EDL) প্রকাশ করতে বাধ্য হওয়ার পরে, ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প এটির প্রভাব কমানোর জন্য তোড়জোড় শুরু করে। WHO-এর অপরিহার্য ওষুধ তালিকার সাথে সঙ্গতি রেখে সদস্য রাষ্ট্রগুলির জন্য তাদের নিজস্ব EDL ঘোষণা করা বাধ্যতামূলক করা হয়নি, এই ফার্মা শিল্পের চাপেই। WHO-এর EDL এ প্রতি বছর নতুন নতুন অপ্রয়োজনীয় ওষুধের অন্তর্ভুক্তি হতে শুরু করে। EDL কমিটি ফার্মাসিউটিক্যাল হাউসের প্রতিনিধিদের দ্বারা ভরে যেতে শুরু করে, নিজস্ব ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ হিসাবে পরিচয় জাহির করে। এছাড়াও WHO, ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি শিল্প, বেসরকারি হাসপাতাল এর কোম্পানি এবং ট্রাস্ট ফান্ড থেকে আরও বেশি করে অর্থ সাহায্য পেতে শুরু করে। বর্তমানে WHO হল MIC-এর একটি পোষিত সংস্থা, এবং তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। বর্তমান দুনিয়ায়, সাম্রাজ্যবাদীরা MIC-এর মাধ্যমে এবং MIC-এর পোষিত WHO-এর মাধ্যমে এবং আরো কিছু সমান্তরাল চ্যানেলের দ্বারা সমগ্র বিশ্বকে পুঁজির পুঞ্জীভবনের একক ব্যবস্থায় পরিণত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তাদের স্বঘোষিত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে এবং ২০২০ সালে প্রথম সফল ভাঁওতা অতিমারী জনগণের সামনে হাজির করেছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, বার্ড ফ্লু এবং সোয়াইন ফ্লু দিয়ে অন্যান্য ভাঁওতা অতিমারী সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু সেগুলো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে ব্যর্থ হয়েছিল। ক্লাউস শোয়াবের কথায় যা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, তাই হোলো প্রথম সফল ভাঁওতা অতিমারী, কোভিড অতিমারী।
এটি ঘটানোর জন্য, চিকিৎসার ধারণাগুলিতে যে মৌল পরিবর্তনগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল তাও অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে WHO দ্বারা মহামারীর সংজ্ঞা চুপচাপ পরিবর্তন করা হয়েছিল। মেডিসিন এবং কমিউনিটি মেডিসিনের সমস্ত পাঠ্যপুস্তক, এখনও আমাদের শেখায় যে একটি রোগ হওয়ার জন্য সংক্রামক জীবাণু, শারীরিক অবস্থা এবং পরিবেশগত কারণগুলির একটি ত্রিকোনকে কোনো এক ব্যক্তির উপর একই সাথে কাজ করতে হবে। কোভিড এর ভাঁওতা অতিমারী চলাকালীন এই ধারণাটি একটি রিডাকশানিস্ট দৃষ্টিকোণে পরিবর্তিত করা হয়েছিল যে SARS CoV2 সংক্রমণের উপস্থিতি মানেই ধরে নিতে হবে যে ব্যক্তিটি একটি কোভিড রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি। এইভাবে প্রথম ঢেউয়ে কোভিড রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছিল।
কিন্তু, তথাকথিত প্রথম ঢেউয়ে, সমগ্র জনগণের মনে ভয়ের মনোবিকার জাগানোর জন্য এটি যথেষ্ট ছিল না। তাই তথাকথিত দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতে, WHO থেকে আরো একটি পরামর্শ পাঠানো হয়েছিল। যে কোনও ব্যক্তির যদি কোভিড পজিটিভ টেস্ট রিপোর্ট থাকে, তাহলে তিনি মারা গেলে তাকে কোভিড এর কারণে মৃত ঘোষণা করতে হবে। সঙ্গে তার, আর যে রোগই থাকুক না কেন। অন্য যেকোনো রোগেই তিনি ভুগুন না কেন, কোভিড রিপোর্ট পজিটিভ হলে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে কোভিড লিখতেই হবে। অর্থাৎ কিডনির রোগ, ক্যান্সার থাকলেও রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে লিখতে হবে কোভিড। এইভাবে দ্বিতীয় ঢেউয়ে কোভিড মৃত্যুর সংখ্যা আকাশচুম্বী হয়েছে এবং এই মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে ভয়ের অতিমারী তৈরি করা গেছে। উল্লেখ্য, যে SARS CoV 2-এর জন্য WHO দ্বারা অনুমোদিত ডায়াগনস্টিক পরীক্ষাকে বিশ্বব্যাপী বহু বিজ্ঞানী প্রতারণামূলক বলে অভিহিত করেছেন। এবং এও উল্লেখ্য, যে কোভিডের মতো উপসর্গ বলে কোনো উপসর্গ থাকতেই পারে না, কারণ স্বাসতন্ত্রের সংক্রমণকারী যেকোনো ভাইরাসের সংক্রমণেই লক্ষণগুলি সব একই রকম। এভাবেই, মৌল ধারনার পরিবর্তন দ্বারা পুষ্ট হয়ে, মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম সফল ভাঁওতা অতিমারী জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া গেল। আর তাই সাম্রাজ্যবাদীদের সেনানায়ক ক্লস শোয়াবের এত উল্লাস যে এটি ছিল চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের হাতিয়ার।
জাল অতিমারীর নেপথ্যে ছিল, মানুষের উপর আক্রমণের হাতিয়ারের তাত্ত্বিক কাঠামো। কিন্তু সেই হাতিয়ারটা কি? যে হাতিয়ারের সাহায্যে সাম্রাজ্যবাদীরা জনগণের ওপর হামলা চালিয়েছে, মানুষকে কর্মচ্যুত করেছে এবং ব্যবসা থেকে ছোট পুঁজি, ক্ষুদ্র পুঁজিকে ঠেলে বের করে দিয়ে সেই জায়গা দখল করেছে, শ্রমিক-কৃষকদের ওপর কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে, সমস্ত আন্দোলন, সকল ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ করেছে, স্বাধীন তথ্য প্রবাহ বিঘ্নিত করেছে। সেই হাতিয়ার হোলো লকডাউন।
লকডাউনকে বুঝতে গেলে, মানুষের অর্থনৈতিক সর্বনাশের ঘটনা ছাড়াও, সেই ভয়ের অতিমারী, সর্বজনীন কোভিড ভ্যাকসিনেশন ড্রাইভ এবং ভ্যাকসিনের উপাদানগুলোর প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে। তবেই সাম্রাজ্যবাদীদের সামগ্রিক গেমপ্ল্যানের সম্পূর্ণ তাৎপর্য বোঝা যেতে পারে।
লকডাউন মানুষকে ঘরবন্দী করে রেখেছিল, সমস্ত অর্থনৈতিক কার্যকলাপ থেকে সাধারণ মানুষকে লকআউট করে রেখেছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী অশ্বমেধের ঘোড়া সমগ্র বিশ্বে অবাধে বিচরণ করছিল। এ ঘটনা তো আমরা সবাই আমাদের চোখের সামনেই দেখেছি। কিন্তু যে কথা আমাদের মনে করে রাখতে হবে, তা হোলো এই যে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সমগ্র জনগণের উপর নজরদারি করার অভিযোগ আসার পরে, আবারও অভিযোগ উঠেছে যে সাম্রাজ্যবাদীরা কোভিড-এর মাধ্যমে জনমানুষের উপর নজরদারি করার আরও ভাল উপায় খুঁজে পেয়েছে। আর সেই মাধ্যম হোলো কোভিড এর ভ্যাক্সিন। কর্পোরেটরা নিজেরাই ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম থেকে দাবি করেছে যে তাদের কাছে একধরনের প্রযুক্তি রয়েছে যার সাহায্যে একধরনের তরল মাইক্রোচিপ ভ্যাকসিনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব, এবং তারপরে সেই মাইক্রোচিপের সিগন্যালের মাধ্যমে একজন মানুষের গতিবিধির উপর নজর রাখা সম্ভব। এই বিষয়ের উপর একটি পাইলট প্রকল্প বাংলাদেশে শিশুদের উপর নাকি ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। সমগ্র জনগনকে ট্র্যাক করার এর থেকে ভালো আর কি পদ্ধতি হতে পারে, যদি ট্র্যাকিং এর সংকেত নজরে থাকা ব্যক্তির ত্বকের নীচে থেকেই আসে? মানুষ আজ সেলফোন এর দ্বারা ট্র্যাকিং সহজেই ফাঁকি দিতে পারে, আর এর জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য এডওয়ার্ড স্নোডেন এর।
এই পটভূমিতে আমরা একবার চোখ রাখব আজকের দুনিয়ার কার্ড রাজত্বের ওপর, যা সারা বিশ্বেই চলছে কিন্তু বিশেষ জোরের সাথে চলছে পূর্বতন উপনিবেশগুলোতে। ভারতে তো মানুষকে এখন অনেক কার্ড বহন করতে হয়। যেমন, প্যান কার্ড, আধার কার্ড, ভ্রমণ কার্ড (শহুরে রেলের জন্য), রেশন কার্ড, স্বাস্থ্য বীমা কার্ড, কর্মচারীদের আই ডি কার্ড, ইত্যাদি। সবই বায়োমেট্রিক তথ্যের সাথে সংযুক্ত। এই ব্যবস্থা, নিরাপদ হওয়া তো দূর অস্ত, বরং সরকার নিজেই তাদের কোষাগার পূরণের জন্য জনমানুষের এই সব বায়োমেট্রিক তথ্য লেনদেন করার অধিকারী এবং সেরকম লেনদেন করার ঘোষণা পর্যন্ত্য করেছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে, যে লোকেরা আমাদের এই নজরদারি পুঁজিবাদ থেকে সতর্ক করেছে, তারা আসলে সাম্রাজ্যবাদ এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে ছোট করে দেখিয়েছে! তারা ভেবেছে শুধুই নজরদারির কথা, কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনা বহুদুর বিস্তৃত। এই সমস্ত কার্ডের সাথে আবার সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য স্বাস্থ্য বীমা কার্ড এসেছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে রাষ্ট্র তার নিজের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই একটি পূর্ণ মাত্রার বেসরকারি শিল্পের অনুমতি দিয়েছে। আংশিক ব্যবহারের অনুমতি অবশ্য এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকেই দেওয়া হয়েছে, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ এর নামে। এর মাধ্যমে ভারতে, পশ্চিমবঙ্গ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, কারণ এখানে, সমস্ত সরকারি হাসপাতালের জন্য স্বাস্থ্য বীমা কার্ড বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
অভিযোগের এখানেই শেষ নয়! বেশিরভাগ ভ্যাকসিন, বিশেষ করে যেগুলো সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত হয়েছিল, সেগুলো হোলো mRNA ভ্যাকসিন, যা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে পাওয়া। এই ভ্যাক্সিন, ভ্যাক্সিন গ্রহীতার শরীরে একটি জিনগত পরিবর্তন শুরু করার ক্ষমতা রাখে। আপনি আপনার শরীরে এই জিনগত পরিবর্তন ঘটতে দেবেন কিনা, এটি আপনার ব্যক্তিগত বিষয়, তবে আগে আপনাকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে তো। আপনার সামনে এই ভ্যাক্সিন সংক্রান্ত গবেষণার সমস্ত তথ্য প্রকাশিত হয়ে থাকতে হবে, তবেই আপনি সেই সক্ষমতা অর্জন করার চেষ্টা করতে পারেন। এবং তারপরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়াও প্রয়োজন। সার্বজনীন টীকাকরণ অভিযানে এই সব প্রক্রিয়াগুলো রাষ্ট্র বা কর্পোরেটদের কাছে ছিল বিলাসিতা, এবং অপ্রয়োজনীয়। সার্বজনীন টীকাকরণে জনগণকে বাধ্য করা হয়েছিল প্রশাসনিক নোটিশ, মিডিয়ার তৈরী ভয়ের অতিমারী এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর চোখ রাঙানির মাধ্যমে।
বিজ্ঞানীরা, পরে এমআরএনএ ভ্যাকসিনের খারাপ প্রভাবের তথ্যপ্রমাণ হাজির করেছেন। এর মধ্যে একটি হোলো মায়োকার্ডাইটিস (হৃদযন্ত্রের প্রদাহ), যা আজকাল সম্ভাব্য খারাপ প্রতিক্রিয়া হিসাবে ভ্যাকসিনের লেবেলে লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এরকম আরো অনেক খারাপ প্রতিক্রিয়া এখনো প্রকাশ্যে আসেনি বলেই আমার ধারণা। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞরা এই ভ্যাকসিনগুলির কারণে রক্তপাত এবং রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে চলেছেন। বহু মানুষ অভিযোগ করেছেন যে ইউজেনিক্সের সমর্থকদের (নাৎসিবাদের তাত্ত্বিক বংশধরদের মধ্যে একটি ধারা), এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বের জনসংখ্যা হ্রাস করার একটি অশুভ পরিকল্পনা রয়েছে। বিল গেটস সম্পর্কে এই অভিযোগ প্রায়শই করা হয়ে থাকে যে তিনি ইউজেনিক্সের সমর্থকদের একটি পরিবারের সদস্য।
এসব কথা যদি কষ্টকল্পনা মনে হয়, তবে আমি সুধী পাঠকদের অনুরোধ করবো, ইতিহাস খুঁড়ে ইহুদি হত্যাকাণ্ড, সম্পর্কে একটু পড়ে নিতে। গোটা নাৎসি সংগঠন ব্যবহার করে একজন মানুষকে কত বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহার করা যায় (জীবিত অবস্থায় তার শ্রমকে, এবং তার সম্পত্তিকে, এবং তাকে হত্যা করার পরে তার দেহের বিভিন্ন অংশকে), সেই ইতিহাস। তাদের সাম্রাজ্যবাদী পারমাণবিক বোমা দ্বারা হত্যাকাণ্ড, নাপাম বোমাবর্ষন দ্বারা হত্যাকাণ্ড এবং বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেব। যে যুদ্ধ শত সহস্র, মিথ্যার উপর ভিত্তি করে মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আজও হয়ে চলেছে। যে যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষকে যূপকাষ্ঠে চড়ায় সাম্রাজ্যবাদ। আমি অবশ্যই তাদের উইনস্টন চার্চিলের কথা মনে করিয়ে দেব, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলা থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে তাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাদ্য সরবরাহ করেছিলেন এবং এই ঘটনা এককভাবে ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের এবং হাজার হাজার নরনারীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল; সেই উইনস্টন চার্চিল যিনি মন্তব্য করেছিলেন যে ভারতের মানুষ শয়ে শয়ে মারা যায় কারণ ভারতীয়রা ডজন ডজন বাচ্চা পয়দা করে।
তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে পালস পোলিও টিকার ডোজ বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট নন পোলিও অ্যাকিউট ফ্ল্যাসিড প্যারালাইসিসসের মাধ্যমে বহু শিশুর মৃত্যুর কথা । এবং তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে AZT দ্বারা সৃষ্ট মৃত্যুর কথা, যে ওষুধটি এইডসের চিকিৎসা হিসাবে একসময় চালু হয়েছিল। আমি অবশ্যই তাদের HPV টিকা দিয়ে অনৈতিক ক্লিনিকাল ট্রায়ালের কথা মনে করিয়ে দেব যা ভারতে বহু অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের মৃত্যু ঘটিয়েছে। এবং আমি তাদের করজোড়ে অনুরোধ করবো এইসব তথাকথিত চিকিৎসার ফলে, এই সমস্ত মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী তা খুঁজে বের করতে। প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা। আমি আমার সুধী পাঠক বন্ধুদের বলতে চাই, আমার কথায় প্রভাবিত হওয়ার দরকার নেই, শুধু মানবিক হও, কারণ মানবিক হলেই তুমি সাম্রাজ্যবাদীদের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করার স্পর্ধা অর্জন করবে।
সাম্রাজ্যবাদী এবং ফ্যাসিস্টদের দৃষ্টিকোণ থেকে, লকডাউনের একটি গুরুতর ত্রুটি ছিল এই যে, বিশ্বের অনেক দেশে এর কোনো আইনি অনুমোদন ছিল না। অনেক দেশে তাদের সংসদীয় রাজনৈতিক গঠন এতটাই জটিল ছিল যে আংশিক লকডাউনের পক্ষে তাৎক্ষণিক একটি আইন পাশ হলেও তা ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন অস্বস্তিকর প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিল। যেমন ভারত। সরকার কর্তৃক আনা তিনটি কৃষি বিল এর তীব্র বিরোধিতা এবং লকডাউনের সময়ে কাজ হারিয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে যাওয়ার জন্য শ্রমিকদের 'লং মার্চ'-এর তাজা স্মৃতি এদেশে ক্ষমতাসীন দল, রাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্যবাদীদের ভাবমূর্তি বেশ খারাপ করে তুলেছিল।
সাম্রাজ্যবাদীরা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারেনা, তাদের খুব তাড়া। সময়ই তাদের কাছে অর্থ বা পুঁজি। তারা নিজেরাই স্পষ্ট ভাষায় বলছে যে তারা এক ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ শুরু করেছে। আর বিপ্লবের সময় কেই বা অপেক্ষা করতে চায়! তাই সাম্রাজ্যবাদীদের তাড়নায়, পূর্বতন উপনিবেশের রাষ্ট্রগুলো, নয়া বিশ্বের নব্য উপনিবেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে WHO-এর কাছে একটি চুক্তির দাবি করল, এমন একটি চুক্তি যা সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে তাদের নিজ নিজ দেশে আইন পাশ করতে বাধ্য করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী পুরো দেশে বা তার কোনো অংশে লকডাউন করতে বাধ্য করবে। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদীরা, ফ্যাসিবাদীরা, আনুষ্ঠানিকভাবে, জাতিসংঘের একটি সংস্থা, WHO-কে সমগ্র বিশ্বের স্বৈরাচারী কর্তৃপক্ষ হিসাবে স্থাপন করার চেষ্টা করছে। তারা WHO কে একটি অতিরাষ্ট্রিক সংস্থা হিসেবে তৈরি করতে চাইছে।
এখানে, আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে এমনকি জাতিসংঘও ধারণাগতভাবে একটি অতিরাষ্ট্রিক সংস্থা নয়। সাম্রাজ্যবাদীরা অবশ্য, এই শতাব্দীর শুরু থেকেই গোপনে অতিরাষ্ট্রিক সংস্থার ক্ষমতাগুলোকে WHO-এর সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে এবং গোপনে গোপনে সেই ক্ষমতাকে আরো আরো শক্তিশালী করে চলেছে। এরকমই একটি শক্তিশেল হল ইন্টারন্যাশনাল হেলথ রেগুলেশনস (IHR) ২০০৫। উল্লেখ্য যে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদের দ্বিতীয় বিশেষ অধিবেশনে, একটি মহামারী চুক্তি তৈরির জন্য একটি ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছিল যা IHR, ২০০৫-এর মাধ্যমে সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক করার কথা ছিল।
এই চুক্তিটি সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রকে WHO-এর উপদেশ মতো (বলা ভালো, আদেশ) লকডাউন, বলপূর্বক রোগ নির্ণয়, বাধ্যতামূলক চিকিৎসা এবং অন্যান্য কঠোর বিধিনিষেধমূলক ব্যবস্থা বৈধ করার আইন আনতে বাধ্য করবে। ভারতে, এরকম যে আইনটি চালু করার চেষ্টা চলছে, তা দেশটিকে এক চিরস্থায়ী জরুরি অবস্থা, একটি চিরস্থায়ী পুলিশ রাষ্ট্রের মধ্যে বেঁধে ফেলবে। এটি পাশ হলে জনগণের ওপর অন্য কোনো বিধিনিষেধমূলক আইনের আর প্রয়োজন হবে না।
তবে সব দেশ সাম্রাজ্যবাদীদের হুকুম তামিল করেনি। রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে এই বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ চিকিৎসার জন্য সম্মতির প্রশ্নকে গুরুত্বপূর্ন বলে মত ব্যক্ত করেন।
নুরেমবার্গ ট্রায়াল, আমাদের মনে আছে। এই বিচার প্রক্রিয়া সারা বিশ্বের দরবারে হাজির করেছিল নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিক এবং যুদ্ধবন্দীদের উপর নাৎসি মেডিকেল টিমের অমানবিক আচরণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা । এরই ফলস্বরূপ তৈরী হয়েছিল নুরেমবার্গ কোড, যা সর্বকালের জন্য একটা মীমাংসা হাজির করেছে চিকিৎসা বিদ্যার আঙিনায়। তা হোলো এই যে, কোনও ব্যক্তির শরীরের ওপর তার নিজের অধিকার কোনও ভাবেই লঙ্ঘনীয় নয়। কোনো ব্যক্তির শরীরের ওপর কোনো চিকিৎসাই বাধ্যতামূলক করা যায় না।
আন্তর্জাতিক স্তরে অতিমারী চুক্তি এবং ভারতে-এর অনুবর্তী আইন এখনও মুলতুবি রয়েছে। কিন্তু তা চিরতরে অমীমাংসিত থাকবে একথা বলা যাচ্ছে না। সুতরাং গণতন্ত্রের প্রতি ন্যূনতম দায়বদ্ধতা আছে এমন সকল ব্যক্তি ও সংগঠনকে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলিতে মহামারী চুক্তি এবং অনুবর্তী আইনের ভয়ঙ্কর খবর দিলেই খারাপ খবরের শেষ হয় না। আমরা কয়েক দশক ধরে জীববৈচিত্র্যের ধ্বংসের সাক্ষী হয়েছি, যার ফলে আমাদের খাদ্যেও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, অতিরিক্ত উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় শতাধিক প্রজাতির ধান চিরতরে হারিয়ে গেছে। কারণ এই প্রতিযোগিতার জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়োজন ছিল এবং তার ফলে মাটির চরিত্রই পরিবর্তন হয়ে চলেছে। একটু ভাবলেই বুঝতে পারব যে, জীববৈচিত্র্যের এই ক্ষতির ফলে মানুষের পুষ্টিতে অনেক ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের অভাব ঘটছে এবং তাই আমাদের প্রধান খাদ্যগুলোকে ভিটামিন ও খনিজ দিয়ে শক্তিশালী করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এই অভিযান আমাদের আরও বেশি করে অভিন্ন চাষ এবং অভিন্ন খাদ্যের প্রবণতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। খাদ্যের উপর নিয়ন্ত্রণের অর্থনৈতিক উপায় ছাড়াও, খাদ্য নিয়ন্ত্রণের এটিও একটি পদ্ধতি, খাদ্য পছন্দের উপর একটি নিয়ন্ত্রণ, একটি সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ, যা ফ্যাসিবাদের সাথে খুব ভালভাবে খাপ খেয়ে যায়।
পরিবেশের নিয়ন্ত্রণও অনেকদিন ধরেই এক রূঢ় বাস্তবতা। 'অপারেশন পপআই' ছিল একটি সামরিক ক্লাউড সিডিং প্রকল্প যা ১৯৬৭-৭২ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন বিমান বাহিনী দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। ক্লাউড সিডিং করে, বর্ষা এবং বর্ষাকাল বাড়িয়ে দিয়ে, রাস্তার উপরিভাগ নরম করে এবং ভূমিধ্বস ঘটিয়ে উত্তর ভিয়েতনামের সামরিক সরবরাহ ব্যাহত করার জন্য এই প্রোগ্রামটি হো চি মিন ট্রেইলের নির্দিষ্ট এলাকায় পরিচালনা করা হয়েছিল। সেদিন থেকে আজ পাঁচ দশক অতিক্রান্ত এবং পাঁচ দশকে সামরিক গবেষণা থেমে থাকেনি। ভারতের একজন নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন যে তার প্রদেশে অত্যধিক বৃষ্টিপাত মানুষের তৈরি এবং দেশের বাইরের কোনো সংস্থার কারসাজি। দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্ব ফ্যাসিস্টদের দ্বারা পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনাও আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না।
আক্রমণের এই তিনটি অংশের সাথে (অতিমারী বা অতিমারীর অজুহাতে রাষ্ট্র দ্বারা আইনি আক্রমণ, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ), বিশ্ব ফ্যাসিবাদ এখন দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত। ভবিষ্যত আমাদের সামনে কি নিয়ে হাজির হবে? আমরা কি পারব পৃথিবী থেকে এই ফ্যাসিবাদকে নির্মূল করতে? আমরা কি বিশ্বের অন্তত কিছু অংশে কিছু শ্বাস ফেলার জায়গা তৈরি করতে পারব? আমরা কি এর বিরুদ্ধে একটি কার্যকর সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারব?
মানুষ জাগবে, তবেই কাটবে অন্ধকারের ঘোর।