পাশ হল না প্যান্ডেমিক চুক্তি। কিন্তু IHR 2005 সংশোধনী পাশ করিয়ে অতিমারী সংক্রান্ত যাবতীয় নতুন আইন বলবৎ করা হল! এর সর্বাঙ্গীণ বিরোধিতা করুন।
২৭শে মে থেকে ১লা জুন ২০২৪, জেনেভায় ৭৭তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশে প্যান্ডেমিক চুক্তি পাশ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু কায়দা করে অতিমারী সংক্রান্ত বেশ কিছু সংশোধনী (Amendments) পাশ হয়ে গেছে এই সমাবেশে। ভারত সহ সদস্য রাষ্ট্রগুলি সম্মতি জানিয়েছে যে তারা অতিমারীর জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকবে। তারা ভ্যাক্সিন পাসপোর্ট, বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ক্ষেত্র বিশেষে Informed Consent বা অবহিত অনুমতি তুলে দেওয়ার বিষয়ে সম্মতি প্রদান করেছে। গত কয়েক মাসে আমরা জেনেছি যে করোনা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিষয়ে অবগত থাকা সত্ত্বেও ভ্যাক্সিন প্রস্তুতকারী কোম্পানি আর সরকার আমাদের একযোগে বলেছিল যে 'টিকা ১১০% নিরাপদ'। এমত অবস্থায় ভ্যাক্সিন পাসপোর্ট, বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ক্ষেত্র বিশেষে Informed Consent বা অবহিত অনুমতি তুলে দেওয়ার মতো আইনি পরিবর্তনকে আমরা সাধারন মানুষের জীবন জীবিকার অধিকারের ওপর কর্পোরেট হস্তক্ষেপ বলেই মনে করছি।
আমরা এক ঝলকে দেখে নেব মহামারী বা অতিমারী সংক্রান্ত নিয়মবিধি বা আইনকানুন এখন কি দাঁড়ালো:
ক) জাতীয় IHR কমিটি গঠন
WHO এর তত্ত্বাবধানে ভারত সহ অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলি দুই বছরের মধ্যে নিজেদের দেশে জাতীয় IHR কমিটি গঠন করবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য নির্দেশিকা বা International Health Regulations 2005 এবং তার সংশোধনীগুলি যথাযথ ভাবে নিজেদের দেশে প্রয়োগ করছে কিনা তা দেখভালের দায়িত্বে থাকবে জাতীয় স্তরের এই IHR কমিটি। জাতীয় স্তরের IHR কমিটি দেশের সরকারের থেকে সংক্রামক রোগ, সংক্রমণ এবং জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় সংক্রান্ত দৈনিক তথ্য সংগ্রহ করবে। সেই তথ্য দৈনিক পাঠানো হবে WHO এর সদর দপ্তরে। সদস্য দেশগুলির ক্ষেত্রে অতিমারী / মহামারী / সংক্রমণ / সংক্রমণের সম্ভাবনা ইত্যাদির কারণে জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা জারি করার সিদ্ধান্ত নেবে WHO এর মুখ্য নির্দেশক। অর্থাৎ জনগণের করের পয়সায় তৈরি জাতীয় IHR কমিটি জনগণের তথ্য সরবরাহ করবে অতিরাষ্ট্রিক সংস্থা WHO কে আর সেই কর্পোরেট অনুদান পুষ্ট অতিরাষ্ট্রিক সংস্থা দেশের আভ্যন্তরীণ জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করবে।
খ) সর্বদা অতিমারীর জন্য প্রস্তুতি
সংক্রামক রোগ, সংক্রমণ, আন্তর্জাতিক ভিসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভ্যাক্সিনের প্রয়োজনীয়তা, বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে অবাধ সংক্রমণ রুখতে নিয়ামাবলী ইত্যাদি বিষয়ে বিষদ আলোচনা প্রথম থেকেই IHR 2005 এ ছিল। নতুন সংশোধনীতে এর সাথে যুক্ত হয়েছে 'অতিমারী তৎপরতা' বা Pandemic Preparedness এর বিষয়। WHO এবং তার পেটোয়া বিশেষজ্ঞ বাহিনী প্রতিনিয়ত আমাদের বার্ড ফ্লু, ইবোলা, মাঙ্কি পক্সের মতো নতুন নতুন মহামারীর ভয় দেখিয়ে চলেছে। এইসব সম্ভাব্য মহামারীর জন্য প্রতি মুহূর্তে নাকি প্রস্তুত থাকতে হবে পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সরকার এবং জনগণকে। আসলে মহামারী বা মহামারীর অজুহাতে বহু অপ্রয়োজনীয় / অপরীক্ষিত ওষুধ ও ভ্যাক্সিন ভয় দেখিয়ে / ভুল বুঝিয়ে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব। এতে কর্পোরেটদের ডবল লাভ : অপ্রয়োজনীয় / অপরীক্ষিত ওষুধ ও ভ্যাক্সিন বিক্রির মুনাফা আর সেইসব বিতর্কিত চিকিৎসা পদ্ধতির কারণে বাড়ে উচ্চরক্ত চাপ / ডায়াবেটিস / হৃদরোগ / অন্যান্য অসংক্রামক রোগ। এভাবে জনতাকে রুগ্ন বানিয়ে ওষুধ নির্ভর ও চিকিৎসা নির্ভর করে তুললে লাভ ঘুরিয়ে আবার সেই ফার্মা কোম্পানি, বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোম, ডায়াগোন্সটিক সেন্টার, বীমা কোম্পানিদের। এই পুরো চক্রটা করোনাকালে এবং করোনা পরবর্তী দুই বছরে আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
এই প্যান্ডেমিক চুক্তি বা IHR 2005 সংশোধনী আসলে জনস্বাস্থ্যকে এই মুনাফার ঘেরাটোপে বেঁধে ফেলার আইনি ফন্দি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ভারত সহ সদস্য রাষ্ট্র গুলো যে One Health Policy নিয়েছে তার সং্যা অনুসারে জনস্বাস্থ্যের পরিধি হল খাদ্য, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য পরিষেবা। কিন্তু বর্তমানে যে অতিমারী তৎপরতার কথা বলা হচ্ছে তা দেশের স্বাস্থ্য বাজেটকে সম্পূর্ণ অকারণে সংক্রামক রোগ এবং তার চিকিৎসার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের সার্বিক উদ্দেশ্য এতে বিঘ্নিত হতে বাধ্য।
গ) সংক্রামক রোগের পরীক্ষা (ক্ষেত্রবিশেষে বাধ্যতামূলক) ও চিকিৎসা ( ক্ষেত্রবিশেষে বাধ্যতামূলক) :
জাতীয় IHR কমিটি সংক্রামক রোগ, সংক্রমণ এবং জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় সংক্রান্ত দৈনিক তথ্য সংগ্রহ করবে। কোথা থেকে আসবে এইসব তথ্য? আমাদের সমস্ত যাতায়াত, ঘর বাড়ি, চাষের ক্ষেত, গৃহ পালিত পশু, পরিবেশ আসবে সেই নজরদারির আওতায়। যাতায়াতের সময় যাত্রীদের সংক্রামক রোগের জন্য বিবিধ বিধি সম্মত উপায়ে প্রয়োজনে / অপ্রয়োজনে পরীক্ষা করা হবে। সংক্রমণ ধরা পড়লে তার নিরাময়ের ক্ষেত্রেও প্রয়োজনে বাধ্যতামূলক চিকিৎসা পদ্ধতি ও ভ্যাক্সিনের কথা বলা হয়েছে।
ঘ) ভাক্সিন পাসপোর্ট
আন্তর্জাতিক যাত্রা এবং ক্ষেত্র বিশেষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যাতায়াতের জন্য ভ্যাক্সিন পাসপোর্ট চালু করার সুপারিশ রয়েছে IHR 2005 সংশোধনীতে এবং প্যান্ডেমিক চুক্তির ড্রাফটে।
ঙ)ক্ষেত্র বিশেষে অবহিত অনুমতি (Informed Consent) এর বিলোপ
অপরীক্ষিত বা স্বল্প পরীক্ষিত ওষুধ / ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে বর্তমানে ব্যক্তির অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য কর্মী ওষুধ / ভ্যাক্সিনের সম্ভাব্য ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়া - পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া - অজানা প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে ব্যক্তিকে বিষদে জানাবেন। তবেই ব্যক্তি ওষুধ / ভ্যাক্সিন প্রয়োগের সম্মতি দেবেন। এই নিয়মকে বলে অবহিত অনুমতি বা Informed Consent। করোনার সময় এই নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে। এখন সেই বেআইনকে আইনসিদ্ধ করার জন্য IHR 2005 সংশোধনীতে বলা হচ্ছে প্রয়োজন পড়লে অবহিত অনুমতির আর কোন দরকার নেই।
চ) বিশেষজ্ঞ তালিকা
সদস্য রাষ্ট্রগুলির সাথে পরামর্শ করে WHO একটি বিশেষজ্ঞ তালিকা প্রস্তুত করবে। জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ে তাঁদের কথাই হবে এই পৃথিবীতে শেষ কথা। স্বাধীন মতামতের জন্য একচুল জায়গাও কর্পোরেটরা ছাড়তে নারাজ।
ছ) দেশবাসীর তথ্যের গোপনীয়তা আজ বিঘ্নিত
জাতীয় IHR কমিটি দেশের জনগণের যেসব তথ্য দৈনন্দিন WHO কে পাঠাবে তা গোপনীয় থাকবে দেশের জনগণের কাছে। কিন্তু তথ্যগুলি উন্মুক্ত থাকবে কর্পোরেট চালিত অতিরাষ্ট্রিক সংস্থা WHOএর কাছে।
করোনার সময় থেকে আমরা বারে বারে দেখছি যে সংক্রামক রোগের অজুহাতে দেশের গণতান্ত্রিক পরিসরকে হত্যা করা হচ্ছে। ২০২০ সালে করোনার ভয় দেখিয়ে দেশজুড়ে NRC CAA বিরোধী আন্দোলনকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মহামারীর ডামাডোলে নয়া শ্রম কোড, নয়া শিক্ষা নীতি, প্রভৃতি অনেক জনবিরোধী আইন পাশ করিয়ে নেওয়া গেছে অনেক সহজে। তবে করোনার সময় দীর্ঘ অবস্থান ও লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে দেশের কৃষকরা আমাদের সঠিক পথ দেখিয়েছেন। কর্পোরেট মিডিয়া যে সংক্রামক রোগের নামে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রচার চালিয়েছিল তা সংগ্রামী কৃষকদের জমায়েতগুলি দেখে সেদিন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই কৃষক আন্দোলনের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আজ আমাদের সচেতন হতে হবে। আগামী দিনে গণতন্ত্র যেন আবার সম্ভাব্য অতিমারীর ফাঁদে না পড়ে তার জন্য ধারাবাহিক প্রচার আমাদের আশু কর্তব্য। পাশাপাশি দেশের নতুন নির্বাচিত সরকার এবং বিরোধী দলের নেতৃত্বকে আমাদের বক্তব্য জানানোর লাগাতার প্রচেষ্টা আমরা চালিয়ে যাব। এই দায় আমাদের সকলের।
পর্ব ১ পড়ুন আমাদের ওয়েবসাইটে।