গ্রাফ ওয়েবসাইটে পূর্ব প্রকাশিত
(চতুর্থ কিস্তি)
২০০৮ সালে ‘করোনাক্রাইসিস’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। লেখক রবিন ডি রুইটার। তার ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, একদিন বিশ্বব্যাপী লকডাউন হবে। তিনি যা লিখেছিলেন তেমনই আজ আমাদের চোখের সামনে হচ্ছে, মজা পেয়ে প্রকাশক আবার বইটি প্রকাশ করেছেন।
রকফেলার ফাউন্ডেশনের একটি বিখ্যাত দলিলে বিশদভাবে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে বিশ্বব্যাপী মহামারী হবে। লকডাউন, অর্থনীতির পতন এবং কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ (ডিক্টেটরশিপ) চাপিয়ে দেওয়া হবে। এই পরিস্থিতিতে সমগ্র বিশ্বের জনগণের এমন একটি ডিজিটাল আইডি থাকা দরকার যা বলে দেবে কে ভ্যাকসিন নিয়েছে, কে নেয়নি। টিকা ছাড়া স্কুল, কনসার্ট, গীর্জা, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে প্রবেশ নিষিদ্ধ হবে। প্রখ্যাত অনুসন্ধানী গবেষক হ্যারিভক্স, রকফেলার ফাউণ্ডেশনের এই দলিলের কথা আমাদের জানান। কবে? ১১ বছর আগে, ২০১০ সালে। রকফেলার ফাউন্ডেশন একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করেছিল। মহামারী চলাকালীন কীভাবে নতুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে হবে। যখন সমস্ত প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ নেটওয়ার্কগুলো ঠিকঠাক কাজ করবে কেবল তখনই পৃথিবী আবার সচল হতে পারে। একসময় রকফেলার ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডাঃ রাজীব শাহ। তিনি আগে ছিলেন গেটস ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ম্যানেজারিয়্যাল স্টাফ।
আবার জুরাসিক পার্ক। ওই একই বছরে ‘ডেড প্লেগ’ নামে একটি ফিল্মে করোনভাইরাসযুক্ত একটি বিশ্বব্যাপী মহামারীর গল্প ছিল। এমনকী, এই রোগের একমাত্র ওষুধ হিসেবে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের কথাও বলা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। পরের বছর আর একটা ফিল্ম। নাম কনটেজিয়ান, মানে সংক্রমণ। প্রিমিয়ার হয়েছিল ইতালির ভেনিসে। গল্পে দেখানো হয়েছিল বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা ধ্বংস করার সম্ভাবনাসহ একটি মারাত্মক ভাইরাস এসেছে। সেই কাল্পনিক ভাইরাসের নাম এমইভি ১। সার্স কোভিড-২এর মতো এটাও অভিনব। আগে কখনও মানুষের মধ্যে ছিল না, তাই কারওর ইমিউনিটি নেই। এটারও শুরু চিনে। তবে প্রাকৃতিক, ম্যানুফ্যাকচার্ড নয়। কোনও এক সংক্রমিত প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে এসেছিল। এর মৃত্যুর হার অবশ্য সার্স-কোভিড -২ এর ১০ গুণ। সার্স-কোভ-২-এর বেশিরভাগ আক্রমণই শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু এমইভি -১ ফুসফুস এবং মস্তিস্ক উভয়কেই আক্রমণ করে, কাশি এবং জ্বর ছাড়াও মাথা ব্যথা এবং খিঁচুনিও হয়। ভাবলে অবাক হতে হয়, আজকের মহামারীর নয় বছর আগে একটি শীর্ষস্থানীয় ফিল্ম হয়েছিল যা আজকের অভিজ্ঞতার সাথে অবিকল মিলে যায়! শারীরিক দূরত্ব রাখতে হবে, ভিড় এড়াতে হবে এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হাত ধুতে হবে, মুখ স্পর্শ করা যাবে না, সব আছে। বর্ডার সিল করার দৃশ্য আছে, স্কুল বন্ধ, ব্যবসা বন্ধের দৃশ্য আছে। সুপারমার্কেটগুলোয় আতঙ্কিত মানুষের কেনাকাটি, তীব্র ভিড়ের জায়গা জনশূন্য, জিমনেসিয়ামগুলো অস্থায়ী হাসপাতালে পরিণত, নেতারা রোগ ছড়ানো আটকাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকিত্বের শিকার কিশোরী কন্যার দীর্ঘায়িত বন্দী জীবন কাটিয়ে ওঠার জন্য লড়াই, স্কুলে যেতে বা তার প্রেমিককে দেখতে যেতে অক্ষমতা। চিত্রটির স্ক্রিপ্ট লেখক স্কট জেড বার্নস। পরিচালক, স্টিভেন সোডারবার্গ।
২০১৭ সাল। সেই অ্যান্টনি ফাউচি পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে ঘোষণা করেছিলেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদকালেই একটি আশ্চর্য সংক্রামক রোগের প্রকোপ হবে।
২০১৮ সাল। ইনস্টিটিউট ফর ডিজিজ মডেলিং একটা ভিডিও তৈরি করল। ভিডিওতে দেখানো হল, একটি ফ্লু ভাইরাস চীনে জন্ম নিয়েছে। আরও আশ্চর্য, সেটা উহান থেকে এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল, লক্ষ লক্ষ লোক সেই ভাইরাসের হাতে মৃত্যুবরণ করল। বলল এটা ‘এ সিমুলেশন ফর এ গ্লোবাল ফ্লু প্যানডেমিক’। এতটা কোয়েন্সিডেন্স, কাকতালীয়?
বিল গেটস স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল যে কেবলমাত্র কোভিড-১৯-এর ভ্যাক্সিনেটেড লোকেদেরই বেড়াতে যাওয়া, স্কুলে যাওয়া, সভায় যোগ দেওয়া, কাজ করার অনুমতি দেওয়া উচিত। ডিজিটাল ভ্যাকসিন আইডির কাজ এগোচ্ছে। গেটসের পেটেন্ট রয়েছে। এছাড়াও গেটস বিশ্বব্যাপী পর্যবেক্ষণ আন্তর্জাল বিছানোর কাজ করতে চায়, যা কোভিড -১৯-এর সংস্পর্শে আসা প্রত্যেককে ট্র্যাক করবে।
মহামন্দার সঙ্গে মহামারীর খুব যোগাযোগ। যে কোনও মহামন্দার পরেই এই ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী হতে শুরু করে। ১৯৩০ এর দশকের মহামন্দার পরে বিশ্ব সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। ২০০৭ সালে সাব-প্রাইম ক্রাইসিস। ২০০৮ সালে লেইম্যান ব্রাদার্সের পতনের সাথে সাথে আন্তঃ ব্যাংক ঋণের বাজারে একটি বড় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তীব্র ঘাটতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং পণ্যের দাম হ্রাসে মারাত্মক মন্দা শুরু হয়ে যায়। অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান "দ্বিতীয় মহামন্দার"র শুরু বলেছিলেন।
বিল গেটস, ওয়ারেন বাফে, রকফেলারসহ বেশ কিছু কর্পোরেট জিলিয়নেয়ার নিউইয়র্কে একটা গোপন বৈঠকে বসেছিলেন ২০১৪ সালের মে মাসে। অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে কথা বলার জন্য। কীভাবে এই মন্দা কাটানো যায়? একটা উপায় হল জনসেবার পিছনে খরচ বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে হবে। সমস্ত বড় কর্পোরেটদের, গেটস, রকফেলারদের, ফিলানথ্রপি বাড়াতে হবে। নানা ‘এনজিও’দের ভালো অর্থ সরবরাহ করতে হবে। এই গোপন বৈঠকের খবরও ফাঁস হয়ে গেল। বাজারে একটা নতুন শব্দ চলে এল। এতদিন, ক্যাপিট্যাল ছিল, ক্রোনি ক্যাপিট্যাল ছিল, কম্প্রাডর ক্যাপিট্যাল ছিল, সোশ্যাল ক্যাপিট্যাল ছিল। ক্যাপিট্যালের সংসারে নতুন শিশু জন্ম নিল। ফিলানথ্রো-ক্যাপিট্যাল (philanthrocapital) যার কাজ শুধু চ্যারিটি বা জনসেবা করা। দারুণ, না? প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে ভারতে রেজিস্টার্ড এনজিও ছিল ৩৩লক্ষ।
এবার দেখি এই প্যানডেমিকে অর্থনীতির কি হাল হল। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি নিবন্ধে দেখা যায় যে গত বছরের কঠোর লকডাউন, ১০০ কোটিরও বেশি মানুষকে বেকার করে দিয়েছে। কোভিড -১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত মানুষের স্বপ্ন শেষ। ভারতেই প্রায় তিন কোটি মধ্যবিত্ত মানুষ দারিদ্র্যের কবলে পড়েছিল। চারদিকে মৃত্যু এবং হাজার হাজার মৃতদেহ নদীতে ভাসমান।
অন্যদিকে, বিজনেস ইনসাইটস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত চূড়ান্ত লকডাউন সময়কালে ভারতীয় বিলিয়নিয়ারদের নিট সম্পদ ৩৫% বৃদ্ধি পেয়ে ৪২৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির ব্লুমবার্গ ইন্ডেক্স জানিয়েছে যে এই কোভিড বছরে আদানির সম্পত্তির পরিমাণ ৩২.৭ বিলিয়ন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬.৫ বিলিয়ন; অর্থাৎ কোভিড / লকডাউনের সময় মাত্র এক বছরে প্রায় ১০০% বৃদ্ধি। মুকেশ আম্বানি ৩৩ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৮৮.৭ বিলিয়ন ডলার নিয়ে এখন ভারতীয় বিলিয়নেয়ারদের তালিকার শীর্ষে। এই বৃদ্ধি এমন সময়ে যখন কোটি কোটি লোক মারা যাচ্ছিল অথবা মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে জীবিকা হারিয়েছিল।
অর্থাৎ বৃহৎ পুঁজির জয়জয়াকার চলছে, এমনটা পুঁজির জন্মের পর থেকে আর হয়নি। মধ্যবিত্ত আর গরিবদের জীবন এমন দুর্বিষহও এর আগে কখনও হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি, অতীতে দুর্ভিক্ষে বহু মানুষ মারা গেছে। কিন্তু দুর্ভিক্ষ এখন সারা বিশ্বজুড়ে ইকুয়্যালি ডিস্ট্রিবিউটেড। সঙ্গে ভাইরাস-যুদ্ধের অজুহাতে মানুষের সমস্ত স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এটা নাকি ডিসাস্টার এমার্জেন্সি। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষ বন্দি। হাউস অ্যারেস্টের মত। সবাই ভয়ে কুঁকড়ে আছে কখন কোন ফাঁকে একটা অজানা ভাইরাস তার নাক, চোখ মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে যাবে। শুধু আতঙ্ক আর আতঙ্ক। আজও এই ভাইরাসের উৎস জানা গেল না। জানার চেষ্টাও করা হচ্ছে না। চিকিৎসা প্রোটোকল রোজ রোজ বদলে যাচ্ছে। আজ যে ওষুধ লাইফ-সেভার, কাল সেটা লাইফ-টেকার হয়ে যাচ্ছে। ‘ভ্যাক্সিন দিতেই হবে, নিতেই হবে’র চিৎকারের আড়ালে পারস্পরিক দোষারোপের মজার খেলা, হাডুডুর মত। এ বলছে ওই সরকার দায়ি, ও বলেছে এই সরকার দায়ি। অথচ, রোগটাকে ম্যানুফ্যাকচার্ড বললেই একদল তেড়ে আসছে চক্রান্ত-তাত্ত্বিক বলে। তাদের মধ্যে অনেক আগুনখেকো বামপন্থীও আছে। (তারা হয়তো জানেই না, এই কনস্পিরেসি থিওরির উদ্গাতা সিআইএ। কিম্বা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হয়ত সিআইএও একটা এনজিও।)
তবে ক্ষুদ্র হলেও এই চক্রান্ত-তাত্ত্বিকদের ঠেলায় বাইডেন প্রশাসন এবং হু অতি সম্প্রতি এই ভাইরাসের উৎস সন্ধানে ফের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। তবে তদন্তকারীরা সেই পুরনো দলেরই সদস্য।
যে অন্ধকার টানেলে আমরা ঢুকে পড়েছি, আশা করি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই টানেলের শেষে গিয়ে আলোর জগতে পৌঁছে যাবে। ততদিন কিন্তু আমাদের এই ম্যানুফ্যাকচার্ড অন্ধকারে হাতড়ে বেরানো চলবে না। মাদুলি বা ভ্যাক্সিন যাই হোক না কেন শুধু বিশুদ্ধ বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করলে আমাদের পরের প্রজন্ম পঙ্গু হয়ে যাবে, যেমন পাঁচ লক্ষ শিশু পোলিও ভ্যাক্সিনে পঙ্গু হয়ে গেছিল। এক এবং একমাত্র উপায় যুক্তি, যুক্তি আর যুক্তি। কারণ কারণ আর কারণ। বিজ্ঞানের প্রথম শর্ত হল সন্দেহ করা। ডাউট। প্যারানইয়া নয়। সন্দেহ “কেন” প্রশ্ন করতে শেখায়। আমরা প্যানডেমিকের মুখোমুখি হয়ে চোখে চোখ রেখে বারবার প্রশ্ন করে যাব।
(শেষ)