গ্রাফ ওয়েবসাইটে পূর্ব প্রকাশিত
আমন্ত্রিত সম্পাদকীয়।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাইকোলজি। ভলিউম ৩০, সাপ্লিমেন্ট ইস্যু ১, অক্টোবর ২২, ২০২১
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে নভেল করোনাভাইরাস চিন থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। ২০২০ সালের ১১-ই মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাল, অতিমারী শুরু হয়ে গেছে এবং এই ভাইরাসের মারণ ক্ষমতা সাংঘাতিক।(১) মারণ ক্ষমতা নিয়ে তাদের হিসেবটা যে ভুল তা কিছুদিন পরে অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়ে দিলেন।(২) কিন্তু ততদিনে সংবাদ মাধ্যমের অনিবার প্রচারের ফলে জনমানুষের মনে আতঙ্ক জন্ম নিয়ে ফেলেছে। যারা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের দুর্দশার অন্ত নেই, কেননা ততদিনে এমন ধারণা জনমনে গেড়ে বসেছে যে, ভাইরাস মানেই কলঙ্কবিশেষ।(৩) অথচ ততদিনে একথাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এই ভাইরাস মারাত্মক কিছু না, যারা আক্রান্ত হন তাদের অধিকাংশই অল্প দিনের মধ্যে সেরে ওঠেন; তবে এও ঠিক যে, কখনও কখনও, কারোর কারোর বেলায় অসুখটা মারাত্মক হয়ে যেতে পারে।(৪)
ভাইরাসের প্রতি একটা অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়ল। ভাইরাস থেকে বাঁচবার আশায় এমন এমন বিধিনিষেধ রচিত হল যা এককথায়, ভয়ংকর। সব দেশই তখন ভাইরাসকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আর তার ফলে জনমানুষের হয়রানি আরও বাড়ল, ডাক্তারি পরিষেবা, সমাজ এবং মানুষের জীবন আর জীবিকার উপর অদৃশ্য খাঁড়ার ঘা নেমে এল। বিশেষজ্ঞরা জানালেন, এভাবে চললে অচিরেই বিশ্বের পঞ্চাশ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে নেমে যাবেন।(৫) ক্রমশ দেখা গেল, পরিবারে মহিলা এবং শিশুদের উপর(৬) এবং এমনকী, বৃদ্ধদের উপরেও(৭) জুলুম বাড়ছে। অথচ বৃদ্ধরাই ছিল এই ভাইরাসের আক্রমণের প্রধান অভিমুখ, তাই তাদেরকেই সবচেয়ে যত্নে রাখবার কথা ছিল। সবচেয়ে পরিতাপের কথা, একই সঙ্গে দেখা গেল, আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে, কেননা প্রচার হয়েছে যে, যারা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে তারা সমাজের কলঙ্ক, কেননা তারাই নিজের পরিবারে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়।(৮)
২০১২ সালের জুলাই মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের বলেছিল, মানুষের জীবৎকাল বাড়াতে হবে।(৯) কিন্তু জীবৎকাল মানে তো বেশিদিন বেঁচে থাকা না; জীবৎকাল উপভোগ্য হতে হবে। যে-জীবনে আনন্দ নেই, অন্যের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ নেই, শরীরচর্চা নেই সেই জীবন মৃত্যুরই সমান। কেউ এমন জীবন্মৃত থাকতে চায় না; অথচ তেমন অসহনীয় পরিস্থিতিই তৈরি করে দেওয়া হল। একাকীত্বের যন্ত্রণা নিয়ে বৃদ্ধেরা মরমে মরে থাকলেন। একই অবস্থা শিশুদেরও। তাদের মেলামেশা বন্ধ, স্কুল বন্ধ, বাইরে যাওয়াই বন্ধ, তারা মনের ভাব জানাতে পারে না, তাই শোকস্তব্ধ, যেন। ‘ইউনিসেফ’ জানাল, বিশ্বব্যাপী শিশুদের অবস্থা মর্মান্তিক।(১০) তারা আজ যা হারাল, আর কোনওদিন তা ফিরে পাবে কিনা কেউ জানে না।
আমাদের সমাজ এমনিতেই জাতপাত এবং শ্রেণী দিয়ে বিভক্ত এবং ভঙ্গুর। সেই অসাম্য এবার আরও বাড়ল।(১১, ১২, ১৩) এই অসাম্যে বিত্তশালীরাই বেশি সুবিধে পেয়ে গেল। বাড়িতে বসে রোজগারের বন্দোবস্ত, লেখাপড়ার ব্যবস্থা, পরিবারের সকলের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ তাদেরই বেশি।(১১) সমাজের এই অংশটা সংখ্যায় সামান্যই; কিন্তু দেশের রীতিনীতি তারাই তৈরি করে। উল্টোদিকে, বিশেষ করে যারা অসংগঠিত ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করেন তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলেন। যারা পরিযায়ী শ্রমিক বলে পরিচিত তারা হাজার হাজার মাইল হাঁটতে হাঁটতে শুধু নিজেদের প্রাণটুকু ধরে রাখবার চেষ্টায় দিনাতিপাত করলেন। হাতে কাজ নেই, কাজের পারিশ্রমিক নেই, তাদের পরিবার নিরন্ন।(১৪) দেশের রীতিনীতি তৈরিতে তাদের কোনও ভূমিকা নেই, তার মূক। যে যতই বলুক, আসলে লকডাউন এক ছাতার নিচে আনেনি, বরং অসাম্যই বাড়িয়েছে। এখন একথা স্পষ্ট হচ্ছে যে, লকডাউন-এর মতো বিধিনিষেধগুলো ধনী দেশগুলোতে আয়ুষ্কাল বাড়াতে গিয়ে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আয়ুষ্কাল কমিয়ে দিয়েছে।(১৩) আমরা ক্রমশ আরও ভঙ্গুর, আরও বিখণ্ডিত সমাজের পথে এগিয়ে চলেছি।
অথচ নির্বাক, পরিযায়ী শ্রমিকরাই আমাদের দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় অংশীদার। শিল্প শ্রমিকদের আশি শতাংশই আসেন অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে।(১৫) তাদের শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আমাদের দেশে কোনও সুযোগ-সুবিধে নেই। সরকারের তরফে যেটুকু ব্যবস্থা আছে তাও কাজে লাগানো হয় না।(১৫) মোট কথা, এই শ্রমিকরা তাদের মালিকদের করুণাতেই বাঁচেন; নিয়োগকর্তারাই তাদের শাসক এবং শোষক।
তার মানে, আগামি দিনগুলোতে আমাদের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। পারিশ্রমিকহীন, খেটে-খাওয়া মানুষদের শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে আমরা যদি নজর না-দিই, নতুন বেকারদের দিকে যদি লক্ষ্য না-রাখি তাহলে অচিরেই সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে, খুনখারাবি বাড়বে, মদ্যাসক্তি বাড়বে, নেশা করার প্রবণতা বাড়বে। তাতে এই উন্নয়নশীল সমাজের দরিদ্র অর্থনীতির যতটুকু অবশিষ্ট আছে তা গোল্লায় যাবে। তখন হয়তো বুঝবো যে, নানান কাণ্ড করে কোভিড-মৃত্যু কমিয়ে সমাজের উপকার করতে গিয়ে আমরা বরং অনেক বেশি ক্ষতি করে ফেলেছি, এমন ক্ষতি যা থেকে পরিত্রাণের পথ প্রায় নেই।
কোভিড নিয়ে আজগুবী প্রচার করে আমরা একটা মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত সমাজ তৈরি করে ফেললাম, ডাক্তারি ভাষায় এই ব্যাধির নাম, ‘অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার’ (উদ্বেগজনিত ব্যাধি)। সমাজটাকে এই ব্যাধি থেকে মুক্ত করতে না-পারলে বিপদ ভয়ানক। তার জন্য আমাদের হয়তো ভগবৎ গীতার শরাণাপন্ন হতে হবে। গীতার চতুর্দশ পরিচ্ছেদের দশম শ্লোকে তিনটি গুণের কথা বলা হয়েছে, - সত্ত্ব, রজঃ আর তমঃ। এই অতিমারীর প্রথম দিনগুলোতে তমোগুণই আমাদের শাসন করেছে, - চারদিকে যেন অন্ধকার, বিনাশ আর বিশৃঙ্খলা।
নতুন ভাইরাসটি সম্পর্কে তখন তেমন কিছু জানা যায়নি, আমরা শুধু বিশ্ব জুড়ে, বিশেষ করে পশ্চিম বিশ্বে বৃদ্ধ মানুষজনের মৃত্যু দেখছি।(১৬) এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই আসছে কোভিড নিয়ে একটার পর একটা ভুলে ভরা ‘মডেল’; আমাদের আতঙ্ক আরও বাড়ছে।(১৭) তার পরেই আমাদের শাসন করতে এল রজোগুণ, - তার মানে, আবেগ আর ক্রিয়াশীলতার সঙ্গে যুক্ত হল বিভ্রান্তি। বিজ্ঞানীরা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন, সরকার অতিরিক্ত ক্রিয়াশীল হয়ে পড়ল, যার অধিকাংশই ভুল এবং যুক্তিহীন। এর সঙ্গে জুড়ে গেল সর্বস্তরে বিভ্রান্তি, যার জন্মদাতা হল সংবাদমাধ্যম এবং আমাদের পারদর্শী বলে খ্যাত লোকজনরাও।
এবার তাহলে আমাদের সত্ত্ব গুণের ভরসায় থাকতে হবে, যে-গুণ আমাদের সান্ত্বনা দেয়, যুক্তি দিয়ে বিভ্রান্তি কাটায়, ধ্বংসের বদলে নির্মাণ করতে শেখায়, অশুভর বদলে শুভর নবজাগরণ ঘটায়। ভাইরাসের সঙ্গে, তাকে নিয়েই আমাদের বসবাস করতে শিখতে হবে। তবেই হয়তো সমাজটা উৎকট, বিপজ্জনক মানসিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পাবে।
উল্লেখপঞ্জী –
1. Giorgi G, Lecca LI, Alessio F, Finstad GL, Bondanini G, Lulli LG, et al. COVID-19-related mental health effects in the workplace: A narrative review. Int J Environ Res Public Health 2020;17:E7857.
2. Ioannides JP. Infection Fatality Rate of COVID-19 Inferred from Seroprevalence Data. Bulletin of the World Health Organization. Published Online; October 14, 2020. Available from: https://www.who.int/bulletin/online_first/BLT.20.265892.pdf. [Last accessed on 2021 Jul 08].
3. Li W, Yang Y, Ng CH, Zhang L, Zhang Q, Cheung T, et al. Global imperative to combat stigma associated with the coronavirus disease 2019 pandemic. Psychol Med 2021;51:1957-58.
4. Tang Y, Liu J, Zhang D, Xu Z, Ji J, Wen C. Cytokine storm in COVID-19: The current evidence and treatment strategies. Front Immunol 2020;11:1708.
5. Sumner A, Hoy C, Ortiz-Juarez E. Estimates of the Impact of COVID-19 on Global Poverty. Working Paper United Nations University World Institute for Development Economics Research 2020. Availablefrom: https://mailchi.mp/hhconnect.in/infodemic-pandemic-esummit-6172572 . [Last accessed on 2021 Jul 09].
6. Bourgault S, Peterman A, O’Donnell M. Violence against Women and Children during COVID-19 – One year on and 100 papers in: A Fourth Research Round Up. Center for Global Development Notes; April 12, 2021. Available from: https://www.cgdev.org/publication/violence-against-womenand-children-during-covid-19-one-year-and-100-papers-fourth. [Last accessed on 2021 Jul 09].
7. World Health Organization. COVID-19 and Violence against Older People; June 14, 2020. Available from: https://www.who.int/publications/m/item/covid-19-and-violence-against-older-people. [Last accessed on 2021 Jul 09].
8. Panigrahi M, Pattnaik JI, Padhy SK, Menon V, Patra S, Rina K, et al. COVID-19 and suicide in India: A pilot study of reports in the media and scientific literature. Asian J Psychiatr 2021;57:102560.
9. WHO. World Health Day 2012: Adding Life to Years. Available from: https://www.who.int/westernpacific/news/detail/04-04-2012-world-health-day-2012-adding-life-to-years. [Last accessed on 2012 Jul 09].
10. Reiss K, Bhakdi S. Corona – Facts and Figures. London: Chelsea Green Publishing; 2020.
11. Sarkar S. COVID-19 has Exacerbated India’s Hidden Mental Health Pandemic. IndiaBioscience; April 27, 2021. Available from: https://indiabioscience.org/columns/opinion/covid-19-has-exacerbated-indias-hiddenmental-health-pandemic . [Last accessed on2021 Jul 10].
12. Reyes MV. The disproportionate impact of COVID-19 on African Americans. Health Hum Rights 2020;22:299-307.
13. Broadbent A, Walker D, Chalkidou K, Sullivan R, Glassman A. Lockdown is not egalitarian: The costs fall on the global poor. Lancet 2020;396:21-2.
14. Das B. In Indian Migrant Workers’ Long Brutal March, Echoes of Mexican Migrants’ Trek Through Sonaran Desert to Reach US. First Post; May
15. 2020. Available from: https://www.firstpost.com/india/in-indian-migrant-workers-longbrutal-march-echoes-of-mexican-migrants-trek-through-son oran-desert-to-reach-us-8371471.html. [Last accessed on 2020 Jul 10].
16. Staff Reporter. The Unorganized Workforce of India. Geography and You; August 10, 2018. Available from: https://geographyandyou.com/the-unorganised-workforce-of-india/ . [Last accessed on 2021 Jul 10].
17. Thompson DC, Barbu MG, Beiu C, Popa LG, Mihai MM, Berteanu M, Popescu MN. The Impact of COVID-19 Pandemic on Long-Term Care Facilities Worldwide: An Overview on International Issues. Biomed Res Int. 2020 Nov 4;2020:8870249. doi: 10.1155/2020/8870249. PMID: 33204723; PMCID: PMC7656236.
18. Adam D. Special Report: The Simulations Driving the World’s Response to COVID-19. Nature; April 03, 2020. Available from: https://www.nature.com/articles/d41586-020-01003-6 . [Last accessed on 2021 Jul 10].