শিল্পী : দেবাশিস দত্ত
শিল্পী : দেবাশিস দত্ত

"এই মেয়ে শোন এই রাত এই ভোর
যতখানি পুরুষের ততখানি তোর"

ফারজানা ওয়াহিদ শাওনের এই গান আজ কত না মানুষের মুখে মুখে ফিরছে।নারী,পুরুষ,শিশু, কিশোর,বাচ্চা-কোলে মা,লাঠি-হাতে বৃদ্ধা,ছোট দোকানদার,বড় অফিসার,---সকলেই গলা মেলাচ্ছে এই গানে।বয়স-পেশা-লিঙ্গ নির্বিশেষে।না,শুধু গানেই গলা মেলাচ্ছে না।পথে নামছে মানুষ।পথে নেমেছে।নেমেই চলেছে।বিরামহীন,যতিচিহ্নহীন।শুধু পাকা রাস্তাতেই নামছে না।নামছে মেঠো পথে।নামছে মহানগরে,মফস্বলে,গাঁ-গঞ্জে।জনস্রোত স্লোগানে সোচ্চার:বিচার চাই, বিচার।চাই বিচার। WE WANT JUSTICE।

দু:স্বপ্নে বিরল এক নারকীয় হত্যা।এবং বেতনাতিরিক্ত বোনাসের মতো হত্যা পূর্বে ধর্ষণ।মহানগরের এক ব্যস্ততম আরোগ্য নিকেতন তথা উচ্চকোটির স্বাস্থ্যশিক্ষা কেন্দ্রে।
এরকম ঘটনায় শোরগোল পড়ে যাওয়ার কথা।শোরগোল পড়েছেও।বেশ বেশিরকমের শোরগোল।চেনা মাপ,চেনা মাত্রা,চেনা সীমা,চেনা সীমান্তকে উড়িয়ে-ঝুরিয়ে প্রতি সকালে -বিকেলে এই শোরগোল উত্তীর্ণ হচ্ছে সগর্জন গণ প্রতিবাদের অচেনা সব আঙ্গিক ও অবয়বে,ভাষা ও ভাষ্যে।
শাসক বেশ খেইহারা।কারণ সে চায় না যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত দোষী বা দোষীদের যথোচিত শাস্তি।সে চেয়েছে তদন্ত-তদন্ত খেলা খেলে জনতার মন ভোলাতে।কিন্তু এবারে জনতা ভোলেনি।জনতা সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে।বসার ঘর,পড়ার ঘর,শোয়ার ঘর,রান্নাঘর,দোকান ঘর,অফিস ঘর সব ছেড়ে সে নেমেছে পথ দখলে।এবং রাত দখলে।এমনকি খেলার মাঠের গ্যালারিও আজ তার দখলে।সেখানে খেলার দর্শক যত না যুযুধান দলের সমর্থক,তার চেয়েও বেশি প্রতিবাদে সমবেত নাগরিক।প্রিয় দলের জয়োল্লাসকে ছাপিয়ে যাচ্ছে উচ্চকিত স্লোগান:WE WANT JUSTICE।অতএব শাসকের খেই হারানোর কারণ আছে।
এক বর্বর ধর্ষণ-খুনের নেপথ্য কারিগর ও কারণকে আড়াল করার জন্য ক্ষমতাসীন দল ও সরকারি প্রশাসন যে কোমর বেঁধে উঠেপড়ে লেগেছে সরল-সুবোধ বালিকা-বালকদের কাছেও তা আলোর চেয়ে পরিস্কার। শুরুতে রাজ্য ও পরে এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার কার্যধারায় এটুকু বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে প্রথম মুহূর্ত থেকেই রাজ্য সরকারি প্রশাসন ও আর জি কর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চেয়েছেএই খুনের প্রকৃত তদন্তকে পরিকল্পিতভাবে বাঞ্চাল করে দিতে।বিষয়গুলি প্রচার ও সমাজ মাধ্যমে এতটাই বিশদে চর্চিত তার পুনরুল্লেখের প্রয়োজন দেখছি না।
এ পোড়া দেশে ধর্ষণ কোনো বিরল ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়।সর্বশেষ নথিভুক্ত হিসেবানুযায়ী বছরে ৩১০০০,এবং প্রতি ১৫ মিনিটে একটা করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।এই পচা পৃথিবীতেও ধর্ষণের ঘটনা আকছার।'সব-পাওয়ার-দেশ' আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতি চার মিনিটে একটা করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।তবে হিন্দুত্ব চালিত আমাদের দেশের অনেক জায়গায় আজকাল ধর্ষকদের গলায় মালা দেওয়া হয়,তারা গণ সংবর্ধনা পায়।তাদের নিয়ে শোভাযাত্রা বেরোয়।এ-রাজ্যেও নিগৃহীতা নারীর চরিত্র বিচার হয়(পার্কস্ট্রিট),কামদুনি অপরাধীরা পুলিশ প্রশাসনের ত্রুটিপূর্ণ তদন্তে বিনা শাস্তিতে বেকসুর খালাস হয়ে যায়।সুতরাং,আর জি করে খুনে-ধর্ষক অথবা খুনে-ধর্ষকদের শাস্তি নিয়ে পুলিশ প্রশাসন মাথার ঘাম পায়ে না ফেললে সাধারণ ভাবে খুব একটা অস্বাভাবিক দেখায় না।কিন্তু সমাজের চলন যেহেতু কম্পিউটারের সফটওয়্যার নয়,সেখানে মাঝে মাঝেই দেখা দেয় আকস্মিক ঢেউ,অকস্মাৎ চোরাস্রোত।তাই,"মেয়েটি মধ্যরাতে সেমিনারে হলে কী করছিল ",এইসব ধামা দিয়ে সবকিছু চাপা দেওয়া যায় নি।এখনও পর্যন্ত একজন সিভিক ভলান্টিয়ার গ্রেপ্তার, আর জি করের অধ্যক্ষকে দুর্নীতির দায়ে সি বি আইয়ের হেফাজতে নেওয়া,রাজপথে মুখ্যমন্ত্রীর "ফাঁসি চাই,ফাঁসি চাই" চীৎকার সমন্বিত লোক-খ্যাপানো মিছিল, আর বিধান সভায় ফাঁসি আইন পাশের বিকারগ্রস্ত বুজরুকি জনমনকে বশে রাখতে পারে নি।অভয়া হত্যা যে লাগামহীন লিবিডোর বর্বর হিংস্র প্রকাশ নয়, বরং এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক হত্যাকান্ড রাজ্য-কেন্দ্র তদন্ত নিরপেক্ষে জনদরবারে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
কেন এই নির্মম হত্যাকান্ড?কে বা কারা আসল অপরাধী?--এই প্রশ্নগুলির সঠিক উত্তর এখনও সংশয় আর বিভ্রান্তির কুয়াশায় আচ্ছন্ন।কিন্তু এই নারকীয় হত্যার গাছাড়া তদন্তও ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য পরিষেবা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতির সাপের গর্ত তৈরি হয়েছে তাকে বেআবরু করে দিয়েছে।এতদিন আমাদের জানা ছিল জমি-বাড়ির ব্যবসাতে চলে ইট-সিমেন্ট-লোহা-বালির সিণ্ডিকেটের রাজত্ব বা দৌরাত্ম।শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি সিন্ডিকেটের সুতোর টান।কিন্তু স্নাতকোত্তর চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রী হত্যার তোলপাড়ে উন্মোচিত হলো জৈব-চিকিৎসা বর্জ্যের(Bio-medical waste)অনৈতিক ব্যবসা,মর্গ থেকে লাশ উধাওয়ের মতো অনিয়মসিদ্ধ কান্ডকারখানা,মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বেআইনি কারবার চক্রের মতো অকল্পনীয় সব প্রশাসনিক মদতপুষ্ট অপরাধ ।এমনকি মেডিক্যাল শিক্ষা ব্যবস্থাটাও রেহাই পায়নি।অপছন্দের শিক্ষার্থীকে ফেল করানো থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় পাশ করানো এবং অযোগ্যকে যোগ্যতমের প্রাপ্তব্য নম্বর প্রদানের চরম অসাধু ব্যবসা খুলে বসেছিলেন শাসক স্নেহধন্য যে শিক্ষক-প্রশাসকবৃন্দ,তাদেরকে মাফিয়া বললেও কিছুই বলা হয় না।
সুতরাং,JUSTICE বা সুবিচারের অর্থ বর্তমান হত্যাকান্ডে বিস্তৃততর মাত্রা নিয়েছে।এখানে ধর্ষক-খুনি বা ধর্ষক-খুনিদের উপযুক্ত শাস্তিই একমাত্র সুবিচার হতে পারে না।যে ঘৃণ্য দুর্নীতিচক্রের সম্ভাব্য বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের শিকার এই ডাক্তার শিক্ষার্থী, সেই ষড়যন্ত্রের কুশীলবদের বিচারের কাঠগোড়ায় তোলা ও যথোচিত শাস্তি বিধান চলমান আন্দোলনের এক অন্যতম প্রধান দাবি হওয়া উচিত।
এখনও পর্যন্ত ঘটনা পরম্পরা সনিষ্ঠ সমাজকর্মীদের কাছে তুলে ধরছে এক অতি মূল্যবান শিক্ষা যে,প্রকৃত গণ নাগরিক আন্দোলন সমাজতত্ত্বের কেতাবি বিদ্যা নির্দেশিত পথ পেরিয়ে দরকার মতো খুঁজে নেয় নিত্যনতুন পদ্ধতি ও প্রকরণ।আমাদের সামনে তুলে ধরে আন্দোলন-সংগ্রামের স্বকীয় ভাবনার নতুনতর সব উপাদান।পথে যারা নেমেছেন এবং না নেমেও যারা বুকের ভিতর সঞ্চিত ক্ষোভ চুল কাটার সেলুন থেকে অফিস ক্যন্টিনে উগরে দিচ্ছেন,এ সবই ভিন্ন-ভিন্ন মাত্রার সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বঞ্চনা-বিরক্তির এক সমূহ যোগফল।এই মুহূর্তে যার ভরকেন্দ্র জাস্টিস ফর আর জি কর।
কিন্তু জাস্টিস বা ন্যায়বিচার কার?শুধুই অভয়ার?নাকি এক সমগ্র লিঙ্গের।যে-লিঙ্গ সমাজের প্রতিটি আনাচে কানাচে ঐতিহ্য-সমর্থিত পিতৃতন্ত্রের আধিপত্য আর আস্ফালনে ঘরে বাইরে নিয়ত বিপর্যস্ত।এমনকি বহু ক্ষেত্রে সমকাজে পুরুষের সমান উপার্জনের সুযোগ ও অধিকার থেকে সে বঞ্চিত।অভয়া ধর্ষণ-খুনের সঠিক বিচারের দাবি সুনামির শক্তি নিয়ে প্রশাসনের স্তম্ভকে কাঁপিয়ে দিক।তারই সঙ্গে এই আন্দোলনে বৃহত্তর লিঙ্গ-অসাম্যের কাঠামোগত সমস্যাটি উঠে আসার যে-সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তার সযত্ন ও সচেতন চর্চার গুরুত্ব ভুলে থাকা যায় না।
এক বর্বরোচিত হত্যাকান্ডকে উপলক্ষ করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বহাল যে দুর্নীতিচক্র আজ জনসমক্ষে দৃশ্যমান তার পান্ডাপ্রবরদের উপযুক্ত শাস্তি যেমন ন্যায়বিচারের দাবির এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ,তেমনই গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে প্রকৃত অর্থে জনমুখী করতে হলে কিছু মনভোলানো প্রশাসনিক রদবদল বা চোখভোলানো সংস্কারের টোটকায় তা সম্ভব নয়।প্রয়োজন বিকল্প পথানুসন্ধানের যা প্রচলিত আর্থ-সামাজিক বেড়া-বিধির দিকেই প্রশ্ন তুলবে। ডাক্তার-নাগরিক সমাজের ছক ভাঙা চলমান আন্দোলনে এই ভাবনা উঠে আসা ও ছড়িয়ে দেওয়ার পরিসর নির্মিত হওয়ার উপাদান সচেতন সমাজ কর্মীরা খুঁজে নিতেই পারেন।