পৃথিবীর যে সমস্ত জায়গায় কোভিড টিকাকরণের যৌক্তিকতা, বা এই কোভিড টিকাগুলোর কার্যকারিতা ও এই টিকায় শারীরিক নিরাপত্তা নিয়ে মানুষ প্রশ্ন তুলছে, সেই সব জায়গায় টিকাকরণ অভিযান সম্পূর্ণ করার তাগিদে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম নিজের থেকেই বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোকে কিছু উপায় বাতলে দিয়েছে, যাতে সেই সব দেশের সরকার তাদের সরকারি নীতি স্থির করতে পারে। এই লেখাটার নাম “3 Tactics to Overcome Covid-19 Vaccine Hesitancy”১। লেখকেরা হলেন হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের প্রফেসর রোহিত দেশপান্ডে, সিডনির প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যসোসিয়েট মার্কেটিং হেড ওফের মিনজ এবং আর্ভিনে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মার্কেটিং এর প্রফেসর ইমরান এস কারিম।
এই লেখাটি বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম তাদের ওয়েবসাইটে ফলাও করে প্রচার করছে আবার দায় থেকে হাত ধুয়ে ফেলে এই লেখাটির নিচেই লিখে দিয়েছে যে, বক্তব্যের দায় লেখকদের নিজস্ব, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নয়। খুবই সংকীর্ণ ধরণের ধূর্ততা!
যাইহোক, লেখাটার কথায় আসি। লেখাটা পড়তে গিয়ে প্রথমেই যে প্রশ্নটা উঠে আসে, অতিমারী নিয়ন্ত্রনে যে-চিকিৎসা পদ্ধতিকে বিজ্ঞানভিত্তিক বলা হচ্ছে, সেগুলো জনমানুষকে বা রাষ্ট্রগুলোকে বিশ্বাস করানোর জন্য, বা অন্য ভাষায় বললে, তাদের কাছে “বিক্রী’ করার জন্য, তিন তিন জন বিপণন বিশেষজ্ঞকে দরকার হল কেন? অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বা ম্যালেরিয়া, টিবি, ডেঙ্গু, বা ডায়ারিয়ার মহামারীকে রুখে দেওয়ার কাজে কি এরকম কখনো হয়েছে? না হয়নি। যে ভাইরাস সংক্রমণের সম্পর্কে সাধারণ ধারণাটা দাঁড়িয়েছে এই যে, এর ৮৫% রোগ লক্ষণবিহীন, অর্থাৎ লোকে রোগাক্রান্ত হন না, ১০% ক্ষেত্রে রোগ হয় পরিমিত এবং মাত্র ৫% ক্ষেত্রে গুরুতর, তাহলে তার ‘অতিমারী’ রোখার জন্য এর প্রয়োজন কেন হল? পাঠকেরা কিছু বলতে পারেন?
সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষের প্রায় ৬০% থেকে ৭০% কে নাকি টিকা দিতেই হবে এবং এই টিকাকরণ অভিযানের পথে বাধা নাকি হয়ে দাঁড়িয়েছে টিকার প্রতি দ্বিধার মনোভাব, টিকা নেওয়ার ব্যাপারে গড়িমসি, এবং শেষমেশ টিকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেওয়া। এই সব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে বিপণন বিদ্যার বড় বড় তত্ত্বের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। সেই সব তত্ত্ব নাকি বলে যে, লোকে নাকি প্রথমে কোনো কিছু করার আগে চিন্তা করে দেখে, তারপর ভাবে যে, কাজটা করলে তার কেমন লাগতে পারে, এবং তার পর তারা কাজটা করে! আমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে এই গভীর জ্ঞান আমাদের মাঝে বিতরণ করার জন্য আমরা এই সব বিশেষজ্ঞদের কাছে সত্যিই সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। তা সে যাই হোক, এসব তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে তাঁরা তাঁদের সমস্যার কিছু সমাধান পেয়ে গেছেন। আমরা বরং দেখি সেই সমাধানগুলো কি কি। প্রসঙ্গত তাঁরা নিজেরাই জানিয়েছেন যে, এই সমাধানগুলো তাঁরা পেয়েছেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ থেকে।
১। ফোন কল, সরাসরি ইমেল, টেলিভিশন, বিলবোর্ড এবং ডিজিটাল চ্যানেল এর মাধ্যমে জনমানুষকে নাকি ‘শিক্ষিত’ করে তুলতে হবে। আমরা জানি, এগুলো কোনো শিক্ষাই হতে পারে না, এ হল বিজ্ঞাপনী প্রচার।
২। জনসাধারণের নেতা, ধর্মীয় প্রচারক, এবং চিকিৎসাগত দক্ষতা থাকা লোকেদের ব্যবহার করতে হবে। (লক্ষ্যণীয় যে, সরাসরি ডাক্তারদের ব্যবহার করার কথা বলা হচ্ছে না। সেটা কি উদ্দেশ্য ঢেকে রাখার জন্য, নাকি ডাক্তারেরা আর গালগল্পে ভুলছে না, সেইজন্য?) এর মাধ্যমে পরিষ্কার যে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য ও তত্ত্বের ওপর ভরসা না করে, বরং জনমানুষের সামাজিক, বা ধর্মীয় ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে কাজ হাসিল করার কথা বলা হচ্ছে। এই সমস্ত নেতা, প্রচারক এবং তথাকথিত চিকিৎসা সংক্রান্ত দক্ষ লোকেদের যদি কেউ কাজে লাগানোর কথা ভাবেন তাহলে সেটা কোন মূল্যে সেটাও তো আমাদেরই ভাববার বিষয়!
৩। আরো কিছু দৃঢ় অবস্থান নাকি নেওয়া যেতে পারে। যেমন, ‘চিকিৎসাসূত্র’ দিয়ে ‘ভুল তথ্যগুলোকে’ ‘সরাসরি খন্ডন করানো’। কোনটা ভুল তথ্য কোনটা ঠিক, সেই তর্কে না গিয়েও এখানে প্রশ্ন, অতিমারী সংক্রান্ত ভুল তথ্যকে খন্ডন করানোর উদ্যোগ বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এর থেকে আসছে কেন? এই তথ্যকে খন্ডন ‘করানো’টাও কি কোনো অর্থমূল্যে, না বাধ্য করিয়ে? ‘দৃঢ় অবস্থান’ তো বাধ্য করানোর দিকেই ইঙ্গিত করে।
৪। চিকিৎসা সংক্রান্ত, জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত সংস্থা এবং এনজিও গুলোর জন্য প্রশিক্ষণ এবং অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তাঁরা ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। এইবারে সরাসরি মুখটা ফস্কে আসল কথাটা বেড়িয়ে পড়ল। অর্থমূল্য দিয়ে (প্রশিক্ষণের নামেও অনেক রকম অর্থসাহায্যের চল যে আছে, সেটা বলাই বাহুল্য) টিকাকরণের পক্ষে সংস্থাগুলোকে নামিয়ে দেওয়া। এ হল সরাসরি আর্থিক দুর্নীতি।
৫। রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় জননেতা, বিশ্বাসভিত্তিক নেতা, চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানকারী (এবারও সরাসরি ডাক্তার বলছে না) – এদের ব্যবহার করে মানুষকে বোঝানোর কাজটা নাকি করা দরকার।
৬। এই বিশেষজ্ঞরা জানেন যে জনমানুষ ভাবাবেগ ভিত্তিক কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সে তার সম্প্রদায়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই বিশেষ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা কাজ হাসিল করতে চান। অর্থাৎ, এই টিকাকরণ অভিযানে তাঁরা মানুষের ভাবাবেগকে কাজে লাগাতে বলছেন, বৈজ্ঞানিক ধারণাকে নয়।
৭। টিকা সংশয়ীদের ভাবাবেগকে নাকি আরো একরকম ভাবে প্রভাবিত করা যায় – সেটাকে ইংরাজিতে বলা হয়, Fear of Missing Out (FOMO) । অর্থাৎ মানুষকে এই ভয়ে রাখা যে এটা না পেলে সে কিছু হারাবে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দুই ভাবেই এটা করার কথা সুপারিশ করা হয়েছে। এটাকে সাদা বাংলায় বলা হয় জবরদস্তি।
৮। টিকাকরণকে ‘উৎসাহ’ দিতে কোন কোন কাজকে এই মার্কেটিং গুরুরা অনুমোদন এবং উৎসাহ দিচ্ছেন ? সরাসরি টাকার টোপ, লটারির প্রাইজের মাধ্যমে টাকা দেওয়া, অঞ্চলভিত্তিক খানাপিনার পার্টি, ইত্যাদি। এছাড়াও শিল্পমালিকদের প্রতি তাঁদের উপদেশ, শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য লটারি, কোম্পানীর পণ্যের মধ্যে থেকে বিনামূল্যের উপহার, মাইনেসহ ছুটি, ইত্যাদি নানা উৎসাহ যেন দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে যেমন সরাসরি দুর্নীতির আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে, তেমনি শ্রমিক কর্মচারীদের চেতনাহীন মনুষ্যেতর জীব বলে মনে করা হয়েছে।
৯। তাঁদের সর্বশেষ দাওয়াই হল ‘সোয়াট (SWAT) টীম’ আর ক্ষুদ্র টিকাকরণ কেন্দ্র। এগুলো তাঁদের জন্য যারা কোভিড টিকা নিয়ে সংশয়ী, দ্বিধাগ্রস্ত এবং টিকার বিরুদ্ধে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এই সোয়াট টীম২ হল আইনী এবং বেআইনি (অর্থাৎ মানবাধিকার ক্ষুন্ন করে) পথে রাষ্ট্রের কথা মানতে বাধ্য করার জন্য তৈরী বিশেষ বাহিনী। সুতরাং মানবাধিকারের তোয়াক্কা না করে এই বিশেষজ্ঞরা যে ধরে বেঁধে টিকা দিতে বলছেন, তা জলের মতো পরিষ্কার।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, এত বড় বড় তত্ত্বের থেকে বেরিয়ে আসছে তিনটি কর্মপন্থা –
১। চুক্তি (জননেতাদের সঙ্গে - আমাদের আজকের রাজনৈতিক পরিভাষায় যাকে বলে আঁতাত – গোপন কি না জানিনা)
২। দুর্নীতি
৩। জবরদস্তি
এইসব কর্মপন্থা জেনে, এগুলো নিয়ে কী করা হবে, তা ঠিক করার দায়িত্ব জনমানুষের ওপরই ছেড়ে রেখে দিলাম।
তথ্যসূত্রঃ
১। https://www.weforum.org/agenda/2021/06/3-tactics-to-overcome-covid-19-vaccine-hesitancy/
২। https://en.wikipedia.org/wiki/SWAT
বিজ্ঞানের আলোকের বদলে দুর্নীতির কলূষ, আলোচনার বদলে রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগ (টিকাকরণ সম্পূর্ণ করার জন্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের দাওয়াই)
লেখক সম্পর্কে
ডা. ভাস্কর চক্রবর্তী লেখক পেশায় চিকিৎসক।কলকাতায় থাকেন।