২৪ ও ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে চারঘণ্টার নোটিশে লকডাউন করা হল, তখন বলা হল-

(১) বাস, ট্রাম,ট্রেন, বিমান, জাহাজে করে বা এমনকি পায়ে হেঁটে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া বন্ধ,
(২) বাড়ির বাইরে বেরনো চলবে না,
(৩) অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, দোকান-বাজার, নাটক-সিনেমাহল,কারখানা সব বন্ধ। এমনকি খুব জরুরী প্রয়োজন ছাড়া হাসপাতালে না যাওয়ার কথাও বলা হল। সভা-সমিতি, মিছিল-জমায়েত বন্ধ।

ভারতবর্ষের সংবিধানের ১৯ নং ধারায় রাইট টু ফ্রিডম বা স্বাধীনতার অধিকার-এর কথা বলা আছে। সেগুলো এরকম-

১খ) উপধারা-_ শান্তিপূর্ণ নিরস্ত্র জমায়েতের অধিকার।

১(ঘ) উপধারা-_ ভারতের এলাকার মধ্যে এক জায়গা থেকে অবাধে আরেক জায়গায় যাওয়ার অধিকার।

১চ) উপধারা__ যে কোন পেশা, জীবিকা, ব্যবসা বা বাণিজ্যের অধিকার।

সংবিধানের ২১ নং ধারায় বলা আছে জীবনের অধিকার এবং, ব্যাক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার।

১৯ ধারায় অধিকারগুলোর কিছু শর্ত আছে। ১(খ)-এর জমায়েতের অধিকারের শর্ত হল, ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখশুতা বা জনশৃংখলার স্বার্থে এই অধিকারের যুক্তিপূর্ণ সংকোচন করা যেতে পারে।

১ঘ)-এর অবাধ যাতায়াতের অধিকারের শর্ত হল, সাধারণ জনগণের স্বার্থে বা কোনও তফশীলি জনজাতির স্বার্থে ওই অধিকারের যুক্তিপূর্ণ সংকোচন করা যেতে পারে।

১চ)-এর পেশার অধিকারেও সংকোচন করা যেতে পারে। তবে সেটা জনস্বার্থে এবং যুক্তিপূর্ণ হতে হবে।

২১ ধারার মধ্যে যাতায়াতের অধিকার বা জীবন জীবিকা বা ব্যাক্তিস্বাধিনতার সাথে যুক্ত, বিদেশে যাওয়া বা বিদেশ থেকে আসার অধিকার, মকর্দমায় দ্রুত বিচারের অধিকার, মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার এসবই পড়ে। এই সবকটি অধিকারকেই সংবিধানে মৌলিক অধিকারের তালিকায় রাখা আছে। আর পাঁচটা অধিকার থেকে এই অধিকারগুলো আলাদা।

সংবিধানের ১৩ নম্বর ধারায় বলা আছে যে - সংবিধান চালু হবার আগে থাকতে যে সব আইন বহাল আছে, সেগুলো যদি এইসর মৌলিক অধিকারের বক্তব্য বিরোধী হয়, তাহলে পূর্বের আইনের সেই ধারাগুলো শূনা, অস্তিত্বহীন বা অচল বলে ধরা হবে। এটাও বলা আছে যে, রাষ্ট্র এমন কোন আইন করবে না যা এইসব মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয় বা সংকুচিত করে, যদি সেটা ঘটে, তাহলে আইনটা যতটা মৌলিক অধিকারবিরোধী ততটাই শূন্য বা অস্তিত্বহীন বা অচল বলে গণ্য হবে। শুধু তাই নয়, মৌলিক অধিকার খর্ব হলে কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানাতে পারবেন (Writ Petition)।

২৫ শে মার্চের লকডাউন উক্ত করা সবকটি মৌলিক,অধিকার এক নিমেষে বিলুপ্ত করে দিল। যাতায়াত, জমায়েত, জীবিকা বন্ধ হলে জীবন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতাও বিলুপ্ত হয় বৈকি। কোটি কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হলেন এক নিমেষে, জীবিকা বন্ধ হয়ে গেল, যাতায়াত বন্ধ বলে বাড়ি ফেরার অধিকার, হাসপাতালে চিকিৎসার অধিকার, বহুক্ষেত্রেই কার্যত শূন্য হয়ে পড়ল। এই ঘটনা ঘটলো মাত্র চারঘণ্টার নোটিশে। ঘটলো সারা দেশজুড়ে। একসাথে , একই তীব্রতায়। এবং একদিন বা এক সপ্তাহের জন্য নয়। প্রথম আহ্বানেই ২১ দিন, ক্রমশ বেড়ে বেড়ে প্রায় ছয় মাস।

এই ক্ষমতা, একরকম করার আইন কি সরকারের হাতে আছে? ১৩৮ কোটি মানুষকে এইভাবে দিনের পর দিন অধিকারহীন করে রাখার অধিকার কি রাষ্ট্রের আছে? যার ধাক্কায় দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ কর্মচ্যুত হবেন, আশ্রয়হীন হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়বেন, ন্যুনতম স্বাস্থ্য বা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন, এই অধিকার রাষ্ট্র কোথা থেকে পেল? কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো লকডাউন করতে ব্যবহার করেছে দুটো আইন। ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ আমলের মহামারি আইন আর ২০০৫ সালে পাশ হওয়া বিপর্যয় মোকাবিলা আইন। প্রশ্ন হল এই
আইনদুটো দিয়ে সংবিধানের মৌলিক অধিকারকে কি খর্ব করা যায়? এতদিন ধরে যায়? সংসদে পাশ না করিয়ে এরকম করা যায়? এদেশে মৌলিক অধিকারের ওপর এরকম সরাসরি আঘাত নেমেছিল ১৯৭৫ সালে, যখন ইন্দিরা গান্ধী 'জরুরী অবস্থা' জারি করেন। এই জরুরী অবস্থা জারি হয় সংবিধানের ৩৫২ ধারা দিয়ে। নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে যুদ্ধ, বৈদেশিক আগ্রাসন বা আভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা ঘটলে এই জরুরী অবস্থা জারী করা যাবে। ইন্দিরা জরুরী অবস্থা জারী করেন 'আভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা'র অজুহাতে। পরে যখন জনতা সরকার আসে ১৯৭৭ সালে, তখন জরুরী অবস্থার অভিজ্ঞতার থেকে শিক্ষা নিয়ে “আভ্যন্তরীন বিশৃংখলা” কথাগুলো তুলে দিয়ে “সশস্ত্র বিদ্রোহ” বসানো হয় সংবিধান 'সংশোধন' করে। ১৯৭৫-এর জরুরী অবস্থার সময প্রশাসন, মিসায় (MISA) যাকে খুশি গ্রেফতার করতো, আইন অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টার মধো আদালতে পেশ করতনা এমনকি তাঁর খোজখবরও জানানো হত না। মধ্যপ্রদেশের বিদ্যাচরণ শুক্ল বনাম জবলপুর এ.ডি.এম. মামলা সুপ্রিম কোর্টে এলে এই প্রশ্ন ওঠে যে
জরুরি অবস্থায় কি ২১ ধারার জীবনের এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার খর্বিত হবে ? সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত রায়ে বলা - হ্যাঁ হবে। সেই বিচারপতিদের দু'জন ভুল স্বীকার করেন। অন্য মামলার রায়ে ওই পূর্বের রায়কে অধিকারহরণকারী বলা হয়, যে বিচারপতি বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন তাকে টপকে অন্য ব্যক্তিকে পরের প্রধান বিচারপতি করলে সেই বিরুদ্ধমতের বিচারপরতি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। এইসব শিক্ষা নিয়ে, ১৯৭৮ সালে সংবিধান সংশোধন করে এটাও বলা হয় যে সংবিধানের ২০ ও ২১ ধারার অধিকারকে জরুরী অবস্থার সময় খর্ব করা যাবে না। এমনকি জরুরি অবস্থা জারি করলেও একমাসের মধ্যে তা সংসদের উভয় সভায় পাস করাতে হবে।
এবং কোন কোন মৌলিক অধিকার কে খর্ব করা হচ্ছে তাও উভয় সভায় পাশের জন্য রাখতে হবে। এমনকি,সংবিধানের ৩৬০ ধারায়, অর্থনৈতিক স্থিতি যদি বিপন্ন হয়, কেন্দ্রীয় প্রশাসন রাজ্যকে এড়িয়ে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা জারী করতে পারবে, কিন্তু তাকেও দুমাসের মধ্যে সংসদের দুটো কক্ষেই পাশ করাতে হবে এই সিদ্ধান্ত। ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদের পাশ করানো ১৮৯৭-এর মহামারি আইন দিয়ে
মৌলিক অধিকার খর্বের চেষ্টা সরাসরি সংবিধানবিরোধী শুধু নয়, এ এক ধরণের মানসিক দাসত্বও বটে, আর ১৩ ধারায় তো বলেই দেওয়া আছে পূর্বের আইন মৌলিক অধিকার বিরোধী হলে তা সরাসরি অচল, ২০০৫ -এর আইনে ডিজাস্টার বা বিপর্যয় মোকাবিলার কথা বলা আছে, করোনাকে যদি ডিজাস্টার ধরাও হয়, সেই ডিজাস্টার ২৫শে মার্চ কতটুকু ছিল যখন সারাদেশে মাত্র ৫০০ জন আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া গেছিল? করোনা ডিজাস্টার কি এতবড় বিপর্যয়, যাকে আটকানোর নামে এই সমগ্র মৌলিক অধিকার খর্ব করে, দেশের ১৩৮ কোটির মধ্যে ৭০ কোটি বা তারও বেশি মানুষের জীবনে বিপর্যর ডেকে আনা যায়? যোগাযোগ, জীবিকার, সুস্বাস্থ্যের , শিক্ষার অধিকারের বিপর্যয় ঘটানো যায়? বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ১২ ও ১৩ নম্বর ধারায় কেন্দ্র এবং ১৮ ও ১৯ নম্বর ধারায় রাজ্যের দায়িত্ব এই আইন বলবৎ করায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার যা সুকৌশলে দুই সরকারই এড়িয়ে গেছেন।

শুধু তাই নয়। এই আইন চালু করল প্রশাসন, সংসদ, বিধানসভাকেএড়িয়ে। জরুরী অবস্থা জারী না করেই, জরুরী অবস্থার থেকেও বহুগুণ বেশি মানুষের জীবনকে সরাসরি আঘাত করা এই লকডাউন করা হল, তাকে বলবৎ করলো প্রশাসন। রাষ্ট্রের বাকি দুটো স্তম্ভ বিচারব্যবস্থা এবং আইনসভাকে কার্যত অগ্রাহ্য করে। বলা যেতে পারে রাষ্ট্র এই সমযটা তার আবরণ বা আভরণ খুলে ফেলেছিল।

এই নির্জলা স্বৈরতন্ত্র , ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপ তার সমর্থনের ভিত তৈরি করেছে সচ্ছল, ধনী এবং নিশ্চিত বেতনের মধ্যশ্রেণীর মধ্যে। করোনার বিপদকে বহগুণকে বাড়িয়ে, আতঙ্ক তৈরি করে রাষ্ট্র একে একে জনতার অনেক অধিকারই কেড়ে নিয়েছে। অর্থনীতি, রাজনীতি তো বটেই, শুধুই আইনগত দিক থেকে লকডাউন একটি ভয়ঙ্কর মারাত্মক উদাহরণ বা precedent তৈরি করে রাখলো, যাকে চ্যালেঞ্জ যে কোন গণসংগঠনকে করতেই হবে। বাস্তবে, মননে এবং আইনী পরিমণ্ডলে।