সাথী,
বিগত দুটি বছর ধরে আমরা দেখছি কোভিড আর লকডাউন এই দুটি শব্দকে যেন জোর করে গিলিয়ে দেওয়া হয়েছে জনমানসে আর সেটা করার হাতিয়ার হল ভয় আর অপবিজ্ঞান। সেই ভয়ের বাতাবরণে এই দু' বছর ধরেই বন্ধ স্কুল-কলেজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা বললেই সরকার করোনার অজুহাত দিচ্ছে, কর্পোরেট প্রচার মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে করোনার ভূত দেখানো হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। একদিকে যেমন অনলাইন শিক্ষাকে কেন্দ্র করে তৈরী হচ্ছে ডিজিটাল বৈষম্য, শিক্ষার জগত থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে সুবিশাল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী, ঠিক অপর দিকে ছাত্র-ছাত্রীদের, শিক্ষার মত মৌলিক অধিকার রক্ষাও রাষ্ট্র দ্বারা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে তৈরী ছাত্র আন্দোলনের উপর পুলিশি সন্ত্রাস ও আইনি দমন- পীড়ন নামিয়ে আনছে সরকার ।
আমরা দেখতে পাচ্ছি ‘ সবার জন্য শিক্ষা' বিষয়টি বাস্তবিক ক্ষেত্রে অসার হয়ে গেছে। শিক্ষা আর মৌলিক অধিকার থাকছে না। শিক্ষার্থীদের বৃহ ৎ অংশ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিসরের বাইরে চলে যাচ্ছে । যাদের কাছে স্মার্ট ফোন নেই, তাদের পড়াশোনা করার অধিকারও নেই - এটা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে ভারতীয় রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত এই শিক্ষাব্যবস্থা। অন্য দিকে, মাঝেমধ্যেই খবর আসে যে নিয়ম না থাকা সত্বেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এই করোনা পরিস্থিতির সুবিধা নিয়ে তাদের ফি বাড়িয়ে দিচ্ছে কখনো দ্বিগুণ, কখনো তিন গুণ তো কখনো পাঁচ গুণ। আবার তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিলও হচ্ছে ছাত্ররা । যে শিক্ষার্থীদের কাছে প্রযুক্তি ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে তারা মূলত এমন পথে হাঁটছে যেখানে শিক্ষকের বদলে ক্লাস করানো হচ্ছে অ্যাপের মাধ্যমে । মানে একতরফা তথ্যের সরবরাহ চলছে কিন্তু কোনপ্রকার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাগিয়ে তোলার পরিপন্থী এই পদ্ধতি ।
এছাড়া ছোট বেলা থেকে স্কুলে যাওয়া সহপাঠীদের সঙ্গে একসঙ্গে পড়াশোনা - খেলাধুলো করার পরিসরটা আর থাকছে না শিশু বয়স থেকেই; যার ফলে যৌথতার প্র্যাকটিসটা একেবা রে ব ন্ধ হ য়ে যা চ্ছে শৈশব থেকেই এবং শিশুরা সামাজিক জীবন থেকে সম্পূর্ণ রূপে বিযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে আটকা পড়া শিশু হচ্ছে বিভিন্ন মানসিক রোগের শিকার। স্কুল ছুটের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে, এবং বিশেষত কম বয়সী ছাত্রীদের ক্ষেত্রে শিক্ষার আওতা থেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে বিভিন্ন জায়গায়। মিড ডে মিল তুলে দিয়ে কাঁচা রেশন দেওয়ার ফলে শিশুদের পুষ্টিজনিত সমস্যা দেখা যাচ্ছে । অনেক ক্ষেত্রে বা অনেক এলাকায় দেখা যাচ্ছে স্কুল গুলোতে আগে যেমন মিড মিল বাবদ যত টাকা খরচ করা হত, এখন মাসে একদিন কাঁচা রেশন দেওয়ার ফলে তা অনেক কম টাকায় হয়ে যাচ্ছে। এর পিছনে রয়েছে সরকারি তরফে খরচা বাঁচানোর প্রচেষ্টা।
সর্বোপরি সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে সরকারি তরফে শিক্ষার বেসরকারিকরণে মদত। এই বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরও একটা হাতিয়ার রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে, তা হল নয়া শিক্ষা নীতি যা এই কোভিড পরিস্থিতির সুযোগেই চরম অগণতান্ত্রিক ভাবে পাশ করিয়ে নেয় কেন্দ্রের সরকার। ত্রিভাষা শিক্ষার নামে সংস্কৃত শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে । শুধু তাই নয় জোর দেওয়া হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা র ব্যাবহারের ওপর। অর্থাৎ ক্লাসে বসে আর পড়াশোনা নয়, শিক্ষাদান চলবে অ্যাপের মাধ্যমে। এবার বুঝছেন বাইজুস, টিউটোপিয়ার এত ঢক্বানিনাদ কেন? Cluster school system চালু হবে । ছাত্র সংখ্যার বিচারে কিছু স্কুল উঠিয়ে দিয়ে সেইসব স্কুলের বাকি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অন্য স্কুলে নিয়ে যাওয়া হবে পঠন পাঠনের জন্য। ইতিমধ্যেই ৮৯ টা স্কুলকে নোটিশ ধরানো হয়ে গেছে । জেলা স্কুল ধাঁচে ব্লক বা মহকুমায় একটা স্কু ল থাকবে । আর PPP Model এ স্কুল হবে। স্কুল গুলোর প্রাইভেট পার্ট নার হিসেবে কারা থাকবে? স্বাভাবিকভাবেই যাদের মূল লক্ষ্য মূলধন বাড়ানো।
যারা আপনার দেশে ত্রাতা হয়ে ভ্যাকসিনের পসরা সাজিয়েছে। বিশ্বব্যাঙ্ক এমনি এমনি হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়নি। এমনি এমনি ঋণ দেয় না। হাজার শর্তে র বাঁধনে বেঁধে দেয়। এই শিক্ষানীতির সফল প্রয়োগ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় উপস্থিত হাজারোবৈষম্যকে যেমন বাড়িয়ে তুলবে, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করাকে তেমনি করবে আরও সহজ; পাশাপাশি গৈরিকীকরণ এবং তারই সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে জোরদার করার উদ্দেশ্যও পালন করবে এটি। এই নয়া শিক্ষানীতি বাতিলের দাবী করছি আমরা।
তবে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, নয়া শিক্ষানীতি পাশ ইত্যাদি কোনও বিছিন্ন ঘটনা নয়। সারা বিশ্ব জুড়ে কোভিড পরিস্থিতি তৈরি করে, আতঙ্কের নির্মাণ করে, কর্পোরেট এক গোষ্ঠীর স্বার্থে বিশ্বকে যে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া চলছে, তারই অঙ্গ এ সব কিছুই। সমস্ত ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজেশন করার প্রক্রিয়াকে দৃঢ় করতে সাহায্য করছে অনলাইন শিক্ষা যার মধ্যে দিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠছে টিউটোপিয়া, বাইজুস, ওয়াইট হ্যাট জুনিয়ারস, খান - অ্যাকাডেমি বা টাটার লঞ্চ করা নতন অ্যাপ। বাউজুস, যারা আগামী বেশ ক' বছর আইসিসির সবকটা ইভেন্ট স্পনসর করবে, তাদের শুধু লকডাউনেই ৩৩ মিলিয়ন নতুন ইউজার হয়েছে, আর খান - অ্যাকাডেমীর ইউজার বেড়েছে ৪০ মিলিয়ন। বাইজু আকাশ ইন্সটিটিউটকে কিনেছে মাত্র তিয়াত্তর হাজার কোটি টাকায়। বিশ্বজোড়া এই এজেন্ডায় সামিল আমাদের দেশের কেন্দ্রের সরকার থেকে শুরু করে সমস্ত রাজ্য সরকার গুলি। লকডাউন, কোভিডকালে 'সামাজিক দূরত্ব' এর সরকারি প্রচার এবং বাধ্যতামুলক মাস্ক বা ভ্যাকসিনের দাবিতেই ধারাবাহিক ভাবে প্রচার চালিয়ে গেছে সংসদীয় অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিও। যার জন্য , সরকার বা রাষ্ট্রের কোভিড ন্যারেটিভের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাদের কোনো ভাষ্য উঠে আসেনি বা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও সামনে আসেনি। তারা প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রের প্রচারকেই মান্যতা দিয়েছে। কোভিডের সুযোগে লুঠপাটের যে প্রক্রিয়া রাষ্ট্র সেরে ফেলতে চাইছে সেই কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করা সব রঙের রাজনৈতিক দলের-ই অন্যতম অ্যাজেন্ডা।
এদের মধ্যে কেউ কেউ ইদানিং উল্টো স্বরে কথা বলে স্কু লকলেজ খোলার দাবী রাখছে কিন্তু সামগ্রিক কোভিড ন্যারেটিভের প্রেক্ষিতে না দেখে স্কুল- কলেজ খোলার বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন ভাবে তুলে ধরা আসলে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের দিকেই ইঙ্গিত করে। আরও একটা বিষয় আমরা পরিষ্কার ভাবে বলতে চাইছি টীকা বা কোভিড বিধি মেনে চলা কখনো ক্যাম্পাস খোলার আবশ্যিক শর্ত হতে পারে না। এখনও পর্যন্ত এগুলি ক্যান্ডিডেট ভ্যাকসিন, এবং সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী সম্পূর্ণরূপে ঐচ্ছিক। কোনও ভাবেই বকলমে এগুলিকে বাধ্যতামূলক করা চলবে না । প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চ- মাধ্যমিক স্তরের সমস্ত স্কুল এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে কলেজ ক্যাম্পাস অবিলম্বে নিঃশর্তে খুলতে হবে এটাই আমাদের প্রধান দাবী। ক্যাম্পাস খোলার জন্য বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও গণউদ্যোগ ধারাবাহিক ভাবে কর্ম সূচী নিচ্ছে ।
২৫ জানুয়ারী বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন গুলি শিক্ষার মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করার ন্যায্য দাবীতে পথে নামার কর্মসূচী নিয়েছে । ২৭ জানুয়ারি '২২ বৃহস্পতিবার বিকাশ ভবনে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন লকডাউন বিরোধী গণ উদ্যোগের পক্ষ থেকে। জমায়েত দুপুর বারোটা করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ড।
* আমাদের দাবি*–
# বিনা শর্তে ( অর্থাৎ বাধ্যতামূলক টীকাকরণ বা কোভিড বিধি ইত্যাদিকে স্কুল - কলেজ খোলার শর্ত রাখা যাবেনা )। ফেব্রুয়ারি থেকেই সমস্ত স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পঠন- পাঠন চালু করতে হবে।
# জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ বাতিল করতে হবে।
# শিক্ষাক্ষেত্রকে বেসরকারি পূঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া চলবে না।
# কোনো অজুহাতেই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাগুলিকে অনলাইন করা যাবে না।
এই উদ্যোগে আপনিও সামিল হোন ।