সম্প্রতি কলকাতার রাস্তা থেকে ঐতিহ্যবাহী হলুদ ট্যাক্সি উধাও হয়ে যাচ্ছে। পুরনো বেসরকারি বাসের অনেক রুট বাতিল হতে চলেছে কারণ পুরনো বাসগুলির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আর নতুন লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। বছর পনেরো আগে রমরমিয়ে এসেছিল যে গ্যাসের অটো তার বদলে আসতে শুরু করেছে নতুন ইলেকট্রিক অটো (এবারেও অটো বেচছে সেই হামারা বাজাজ)। বেশ কিছু বছর যাবৎ কলকাতা সহ দেশের সব মেট্রো শহরে আইন জারি করা হয়েছে ১৫ বছরের পুরনো কমার্শিয়াল গাড়ির লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। পুরনো গাড়ির ইঞ্জিনে জ্বালানি দহন করার ফলে যে সমস্ত বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন হয় তার দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই সরকারি উদ্যোগ। আপাতভাবে এই প্রচেষ্টা সাধুবাদের যোগ্য এবং অবশ্য প্রয়োজন বলেই মনে হয়। কিন্তু বিষয়টিকে একটু বৃহৎ প্রেক্ষাপটে দেখা দরকার।
পরিবেশ রক্ষার প্রাথমিক দায় কমার্শিয়াল গাড়ির ওপর চাপানোর ফলে অটো ও হলুদ ট্যাক্সির মালিক/ চালক এবং বেসরকারি বাসের মালিকরা (যারা মূলত ছোট বা মাঝারি ব্যবসায়ী) বাজারের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন। যাঁরা টিকে থাকতে পারছেন তাঁরাও নতুন ইলেকট্রিক গাড়ি কেনার জন্য ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন। এর ফলে গণ পরিবহন ব্যবস্থায় উবেরের মতো বহুজাতিক কোম্পানির একচেটিয়া রাজ কায়েম হচ্ছে আর একদল মানুষ কর্মহারা হচ্ছেন বা অন্য কোন স্বল্প রোজগারের পথ বেছে নিচ্ছেন (যেমন শপিং মলে সেলস, সিকিউরিটি বা ডেলিভারি বয়ের কাজ)। এই আর্থ সামাজিক পট পরিবর্তনের বদলে পরিবেশ রক্ষা হচ্ছে কি?
মেট্রো শহরগুলিতে সাবেকি গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রায় বিলুপ্ত আর নতুন গণপরিবহন (উবের / ইলেকট্রিক এসি বাস / এসি মেট্রো) যথেষ্ট খরচ সাপেক্ষ। তাই শহরে অনেক মধ্যবিত্ত মানুষও ব্যক্তিগত দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য (ঋণ নিয়ে) গাড়ি কিনছেন। তার ফলে (পরিবেশবান্ধব ট্রামের মতো গণপরিবহন তুলে দিয়েও) জানজটের সমস্যা যেমন মিটছে না তেমনই বিষাক্ত বাতাস থেকে আমরা বাঁচতে পারছি না। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল দিল্লি শহরে ১৫ বছরের পুরনো কমার্শিয়াল গাড়ি বাতিল করার নির্দেশ জারি করা হয়েছিল সেই ২০১৫ সালে। অথচ দিল্লির দূষণ সমস্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত দশ বছরে আমাদের দেশে প্রচুর কলকারখানা তৈরি হয়েছে এমনটা নয়। উল্টোদিকে শহরগুলিতে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার বেড়েছে কয়েকগুণ। দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরমে পৌঁছেছে। তাই মেট্রো শহরগুলিতে এক শ্রেণির মানুষ ভোগের জীবনে এতোটাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন যে অনেক পরিবারে সদস্যদের মাথাপিছু একটি বা একাধিক গাড়ি রয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় সামগ্রিক বায়ু দূষণ কতটা বেড়েছে তার কোন হিসাব সরকার বা বিশেষজ্ঞরা করেছেন কি? যে দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে সেই মার্কিন মুলুকের মানুষ মাথাপিছু কি পরিমাণ বায়ুদূষণের জন্য দায়ী? ধনীদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রায় মোট যে পরিমাণ কার্বন নির্গত হয় তার সঙ্গে যদি আমরা একজন সাধারন মানুষের (যিনি সস্তার গণপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল কিংবা আজকের দিনেও গ্যাসের খরচ বাঁচাতে স্থানীয় বাজারের ফাঁকা প্যাকিং বাক্স নিয়ে এসে জ্বালানির কাজ সারেন) কার্বন ফুটপ্রিন্ট তুলনা করি তাহলে কার দিকে পাল্লা ভারি হবে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সামগ্রিক বিশ্বের মোট বায়ুদূষণের ৩% আসে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে, আর ৩৫% আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তাহলে পরিবেশ রক্ষার দায় নিম্নবিত্ত বা প্রান্তিক মানুষদের ঘাড়ে চাপিয়ে বিশ্বের কোথাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা সম্ভব হচ্ছে কি? বিশ্ব জুড়ে সাবেকি গাড়ির বাজারে মন্দা চলছে। তাই সাবেকি গাড়ির ক্ষেত্রে ভারতের মতো নতুন মার্কেট উন্মক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। আবার বিশ্ব জুড়ে গাড়ির চাহিদা ধরে রাখতে হলে সাবেকি গাড়ি আইন মারফৎ বাতিল করে ইভি গাড়ি বাজারে আনাটা কর্পোরেট মুনাফা ধরে রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জাতি সংঘের সম্মিলিত মতানুসারে ২০১৬ সালের প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ভারতে শুধু পরিবহন ক্ষেত্রেই নয়, নানান পরিবর্তন আসছে শক্তি (বিদ্যুৎ) উৎপাদন এবং (লোহা ও স্টিলের মতো) কয়লা ও তাপবিদ্যুৎ নির্ভর শিল্পগুলিতে। লোহা ও স্টিলের বিভিন্ন কারখানা এবং ওয়ার্কশপকে 'উৎসাহ' দেওয়া হচ্ছে ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস ব্যবহার করার জন্য। আমদানি হয়েছে 'গ্রিন স্টিল' নামক শব্দবন্ধ। স্টিলের দ্রব্যটি প্রস্তুত করতে যত কম কার্বন নিঃসরণ হবে সেই স্টিল ততধিক সবুজ। বেশি সবুজ স্টিল তৈরি করার খরচ বেশি, তাই তার দামও বেশি। আর স্টিল থেকে গ্রিন স্টিলের পথে এই যাত্রায় আবার পিছিয়ে পড়বেন লোহা ও স্টিলের মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীরা (বর্তমানে দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ উৎপাদন এই উদ্যোগগুলি থেকে হয়), কারন ইলেকট্রিক ফার্নেসের দাম প্রচুর।
প্রতিটি কারখানার জন্য চালু করা হচ্ছে কার্বন ট্যাক্স। কার্বন ট্যাক্স হলো, কোনও শিল্প, ব্যবসা, বা গ্রাহকের কার্বন নিঃসরণের উপর ভিত্তি করে তাদের ওপর আরোপিত কর। কার্বন ট্যাক্সের অধীনে, সরকার প্রতি টন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য নির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ করে। কার্বন ট্যাক্স হলো এক ধরনের পল্যুশন ট্যাক্স। ভারতে এই ট্যাক্স প্রথম চালু হয় ২০১০ সালে। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রতি টন গ্রিনহাউস গ্যাস পিছু চারশো টাকা কর ধার্য হয়েছে। আমাদের দেশে পেট্রোল, ডিজেল ও এগুলির ওপর নির্ভরশীল শিল্প/ দ্রব্যগুলি অত্যন্ত মহার্ঘ। জেনে রাখা ভালো এই সব সামগ্রির জন্য অন্যান্য বিবিধ প্রকারের ট্যাক্স ছাড়াও আমরা কার্বন ট্যাক্স বাবদ টাকা দিই।
আবার প্রশ্ন ওঠে : নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, ছোট/মাঝারি ব্যবসায়ীর ব্যাপক ক্ষতি, একদল মানুষের কর্মসংস্থানের সমস্যা, কর্পোরেট কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসার পথ সুগম হওয়া প্রভৃতি বিপদ তো বুঝলাম, কিন্তু এই পদ্ধতিতে পরিবেশ রক্ষা পাবে কি?
আমাদের এতক্ষণের আলোচনা ছিল কেবল গ্রিনহাউস গ্যাস এবং বিশেষত কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর যে লক্ষ্য পৃথিবী জুড়ে নেওয়া হয়েছে সেই বিষয়ে। আমরা দেখেছি সরকার নানাবিধ আইন প্রণয়ন করে ইভি গাড়ির ব্যবহার ও জীবন ধারণের বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তার জন্য বিদ্যুৎ নির্ভরতা বাড়াতে চাইছে। বিদ্যুৎ নির্ভর জীবনের জন্য চাই হাজার হাজার ব্যাটারি, ইলেক্ট্রনিক চিপ যেগুলিতে ব্যবহার হয় লিথিয়াম, কোবাল্ট, তামা, সিলিকন, ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি বিবিধ খনিজ। সেইসব খনিজ উত্তোলনের জন্য জল-জঙ্গল-জমি-বাস্তুতন্ত্রের জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট করার হিসাব কর্পোরেটরা আমাদের নজরে আসতে দেয় না। যে অঞ্চলে এইসব খনিজ নিষ্কাশন চলে সেগুলির অবধারিত ফলাফল স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা-বাসস্থানের অধিকার বিলুপ্তির সঙ্গে নিশ্চিতভাবে মরুকরণ (desertification) ও জলস্তর ধ্বংস হয়। আবার পুরনো ব্যাটারি ও ফেলে দেওয়া ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটের কঠিন বর্জ্য জনিত ভূমি ও জলস্তরের দূষণ সম্পর্কেও সরকার সম্পূর্ণ উদাসীন এবং প্রচার বিমুখ। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মেট্রো শহরে প্লাস্টিক, ইলেক্ট্রনিক, ব্যাটারি, মেডিকেল বর্জ্য যথাযথ সংগ্রহ ও নিষ্পত্তি করার পরিষেবা উপলব্ধ নেই। আমাদের দেশ সামগ্রিকভাবে পানীয় জলের গভীর সমস্যার সামনে দাঁড়িয়ে। ভূগর্ভস্থ মিষ্টি জলের স্তর সর্বত্র (বিশেষত বড় শহর, খনি ও শিল্পাঞ্চলে) দ্রুত হারে হ্রাস পাচ্ছে। মাটির জলে আশঙ্কাজনক মাত্রায় আর্সেনিক ও ফ্লোরাইড পাওয়া যাচ্ছে। কলকারখানা ও ব্যক্তিগত দূষণের ফলে নদী- নালা-পুকুর-হ্রদ-জলাজমি দূষিত। কার্বনের জন্য আইন যত কড়া, মিষ্টি জলের সংকটের বিষয়ে সরকার ততটা চিন্তিত নয়।
পারমাণবিক শক্তির মতো বিপজ্জনক বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতি বর্তমানে 'ক্লিন এনার্জি' বা পরিবেশ বান্ধব শক্তির তকমা পাচ্ছে! বেসরকারি কোম্পানিকে বরাত দেওয়া হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করার জন্য। তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের বদলে জলবিদ্যুৎ বা হাইড্রো ইলেক্ট্রিক প্রকল্পগুলিকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বৃহৎ নদী বাঁধের সমস্যার বিষয়ে সরকার আলোচনায় নারাজ। হিমালয়ে বন্যা ও ধ্বসের জন্য সরকার দায়ী করছে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে যাওয়াকে (যে থিওরির পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে ক্লাইমেট চেঞ্জ)। উর্বর চাষজমিতে খাদ্যের বদলে বিপুল পরিমাণে আখ চাষ করা হচ্ছে ইথানল (সবুজ শক্তির অন্যতম উৎস) উৎপাদনের জন্য। এক্ষেত্রেও কর্পোরেটরা স্বভাবতই জলের হিসাব করছে না। যেমন কচ্ছের মরুভূমিতে হাজার হাজার হেক্টেয়ার জুড়ে আদানির সবুজ শক্তি পার্কে সোলার প্যানেল দিয়ে বালুস্তর ঢেকে ফেলার দরুন সেই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের ওপর কি প্রভাব পড়ছে তা কেউই জানে না। আবার এতো বৃহৎ এলাকা জুড়ে সূর্যের রশ্মি বালিতে না পড়ে সোলার প্যানেলের ওপর পড়লে স্থানীয় তাপমাত্রা বা জলবায়ুর ওপরে তার প্রভাব পড়বে কিনা সে বিষয়ে সরকার/ কর্পোরেটরা কোন গবেষণা করেছেন কি? কর্পোরেটদের নির্ধারণ করা উন্নয়নের যে মডেল আমাদের দেশে/ রাজ্যে বহাল রয়েছে তাতে হাজার বছরের পুরনো বনভূমি কেটে সাফ করে ফেলে অনায়াসে হাইওয়ের দুই ধারে কিছু গাছ লাগিয়ে দায় সারা যায়। কারণ প্যারিস চুক্তি অনুসারে হিসাব দেখানো হয় শুধু কার্বনের।
প্যারিস চুক্তি অনুসারে ভারত সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০% শক্তি উৎপাদন করতে চায় সবুজ শক্তির মাধ্যমে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১০০% সবুজ শক্তি নির্ভর হতে চায়। বর্তমানে দেশের প্রায় ৭৮% শক্তি উৎপন্ন হয় কয়লা ও পেট্রোল/ ডিজেল থেকে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের জন্য সার্বিক ভূমি ও জলের দূষণের হিসাব কোথায়?
বহু বছর ধরেই কর্পোরেটরা দেশে-বিদেশে শাসকদল ও প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রকৃতির ভাণ্ডারকে লুঠ করেছে, উৎখাত করেছে স্থানীয় মানুষকে। আসলে কর্পোরেটরা দূষণ নিয়ে আদপেই চিন্তিত নয়, এমনকি প্রকৃতিতে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ নিয়েও বহুজাতিক কোম্পানিরা শঙ্কিত এমনটা মনে হয় না। কর্পোরেট লবির চাপে একদিকে যেমন কার্বন ট্যাক্স বসেছে (আমরা খুচরো ব্যবসায়ী আর আপামর সাধারণ মানুষ মূল্যবৃদ্ধি, গণপরিবহন ব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তার খেসারত দিচ্ছি) অন্যদিকে কার্বন ক্রেডিট মার্কেট তৈরি করে বড় কোম্পানিদের ক্ষেত্রে ব্যবসার সুবিধে করে দেওয়া হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে বড় কোম্পানি বা কারখানার মালিকেরা বেসরকারি ফার্মের মাধ্যমে তাদের কার্বন নিঃসরণ হিসাব করাচ্ছে। তারপর উৎপন্ন বস্তুর ওপর লাগু হওয়া কার্বন ট্যাক্স দেব আমরা সেই পণ্যের মূল্যের মাধ্যমে। এদিকে কোম্পানি কিন্তু মোটেই কার্বন নিঃসরণ বা অন্যান্য দূষণ কমানোর প্রচেষ্টা করবে না। কোম্পানি যদি দেখাতে পারে দেশে/ বিদেশের কোন প্রান্তে কোন বাগান কিংবা হাইওয়ের ধারে (ঠিক কার্বনের হিসাব মিলে যায় এরকম সংখ্যায়) গাছ লাগিয়েছে তাহলে কোম্পানি সম পরিমাণ কার্বন ক্রেডিট পাবে। বনাঞ্চল ধ্বংস করে সবুজ শক্তি করায়ত্ত করার জন্য খনিজ নিষ্কাশন করেও একই ভাবে কার্বনের হিসাব মেলানো চলছে। সম্প্রতি এই ব্যবস্থাকে পাকাপাকি করার জন্য আমাদের দেশের সরকার জঙ্গল বা বনের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে যাতে পাম চাষের ক্ষেত অনায়াসে জঙ্গলের তকমা পেয়ে যাচ্ছে। এমনকি কার্বন ক্রেডিট সঞ্চয় করার জন্য বহুজাতিক কোম্পানিদের মধ্যে জঙ্গল কেনার হিড়িক পড়েছে। কোম্পানিগুলি এই কার্বন ক্রেডিট ফাটকা পুঁজির বাজারে বিনিয়োগ করে তার থেকে মুনাফা আদায় করছে। অর্থাৎ আপনি যখন নিজের বাড়ি বানানোর জন্য বেশি টাকা দিয়ে লোহা / স্টিলের রড কিনবেন আর আর্সেনিক মেশানো জল খাবেন তখন এই বলে নিজেকে আশ্বাস দেবেন যে আপনার ব্যক্তিগত কার্বন ট্যাক্স বাঁচল আর প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষা পেল। এদিকে বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্থ বড়লোক এবং কর্পোরেট কোম্পানিরা তাদের ভাগের দূষণ 'বন্ড' বানিয়ে শেয়ার মার্কেটে ছাড়বে। কর্পোরেটদের কাছে কার্বন একটি পণ্য মাত্র, তারা আদৌ দূষণ রোধ করতে চাইছে কি? বিশ্বব্যাপী মন্দার সময়ে নিজেদের মুনাফার পরিমাণ কর্পোরেটরা অক্ষত রাখতে চায়। কার্বনের হিসাব তাদের সামনে এক নতুন বাজার উন্মক্ত করেছে, মন্দার গ্রাস থেকে নিজেদের বাঁচানোর নয়া কর্পোরেট ফিকির।
কার্বন নিঃসরণের দোহাই দিয়ে কর্পোরেটরা জনতার খাদ্যাভ্যাসের ওপরেও নিয়ন্ত্রণ চায়। সাবেকি পদ্ধতিতে চাষাবাদ এবং পশুপালনের জন্য প্রচুর পরিমাণে গ্রিন হাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডলে মিশছে এমন প্রচার আজকাল জনপ্রিয়। গত ত্রিশ বছরে আমাদের দেশে কৃষিকাজ এতোটাই অলাভজনক হয়েছে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ কৃষিনির্ভর গ্রামভিত্তিক জীবন ছেড়ে শহরে আসছেন কাজের সন্ধানে, কিন্তু স্থায়ী রোজগারের বন্দোবস্ত শহরেও জুটছে না। সবুজ বিপ্লব আখ্যা দিয়ে ভারতের খাদ্যভাণ্ডারের ওপর যে কর্পোরেট আক্রমণ সত্তর বছর ধরে চলেছে তার ফলশ্রুতি - মাটির উর্বরতা হ্রাস, মাটি ও জলস্তরে রাসায়নিক সংমিশ্রণ, উদ্বেগজনক মাত্রায় রাসায়নিক সম্বলিত শাক-সব্জি-দানাশস্য, শস্যের খাদ্যগুণ ও ফলনে ঘাটতি, চক্রবৃদ্ধি সুদের দায়ে কৃষকের আত্মহত্যা। সরকার বহুদিন ধরেই আমাদের দেশে জিএম শস্য পাকাপাকিভাবে চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছে (যা কৃষকদের আন্দোলনের জেরে এখনো বাস্তবায়িত হয়নি)। কারণ জিএম চাষের ক্ষেত্রে চাষের বীজ, কীটনাশক , সার - সবকিছুই কৃষকদের কিনতে হবে একটিমাত্র কোম্পানির থেকে। বলা চলে, কৃষক সেই কোম্পানির কাছে মধ্যযুগের ইউরোপের 'সার্ফ'-এ (serf) পরিণত হবেন। কোম্পানির সাহায্য ছাড়া কৃষকের পক্ষে একটি জিএম দানাও ফলানো সম্ভব নয়। আমাদের দেশে বিটি তুলো চাষের ইতিহাস সেই কথাই বলে। জিএম খাদ্যের বিপদ সর্ম্পকে কোন স্বাধীন গবেষণা কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত বিজ্ঞানীদের জগতে হওয়া সম্ভব নয়। একইভাবে আমাদের মতো দেশে ৯০% মাছ ও মাংস উৎপাদন করেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা। এই বাজারকে কর্পোরেট আওতায় আনার জন্য প্রায় দুই দশক ধরে কর্পোরেটরা লাগাতার কার্বন নিঃসরণ আর সংক্রামক রোগের জিগির তুলছে। বহুজাতিক কোম্পানির খামারে চাষ করা মাছমাংস, জিএম মাংস, প্রসেসড মাংস, ল্যাব মিট, সিন্থেটিক প্রোটিন, ভেগান খাবার - এগুলির জন্য স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে কোম্পানির সাপ্লাই এর ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। কর্পোরেট পুঁজি মানুষের খাদ্যভাণ্ডারের উপরে পূর্ণ কর্তৃত্ব চাইছে।
বর্তমানে ভারতের ৩৬% মানুষ শহরাঞ্চলে বাস করেন। আমাদের দেশের সরকারও বলছে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের সংখ্যাগুরু মানুষ থাকবেন শহরে। বিদ্যুৎ নির্ভর শহুরে জীবনের প্রতি আকর্ষণ কমবেশি আমাদের প্রত্যেকের। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎ নির্ভর যে শহুরে জীবনের স্বপ্ন কর্পোরেটরা আমাদের সামনে তুলে ধরছে তাতে সংখ্যাগুরু জনতার জন্য আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য, পুষ্টিকর খাবার, পরিশ্রুত পানীয় জল, পরিচ্ছন্ন ও বাসযোগ্য পরিবেশ - এগুলো কোনটাই উপলব্ধ নয়। আধুনিক হাই টেক শহর জীবনে কিন্তু জনস্বাস্থ্যের ন্যূনতম চাহিদাগুলি মেটানোর জন্য বিনামূল্যে যুক্তিপূর্ণ পরিষেবা পাওয়া যায় না, বরং সরকার (বকলমে কর্পোরেটরা) ছুঁড়ে দেয় নানারকম প্রকল্পের নামে যৎসামান্য অর্থসাহায্য (যাকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম নাম দিতে চায় 'ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম')। বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে আমরা যে সমস্ত স্মার্ট গ্যাজেট/ পরিবহন ব্যবহার করতে ক্রমশ বাধ্য হচ্ছি সেগুলির মাধ্যমে সরকার/ কর্পোরেটদের পক্ষে জনতার ওপর নজরদারি চালানো অত্যন্ত সহজ।
কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে প্রকৃতির ভারসাম্য যেমন নষ্ট হয়েছে, হচ্ছে এবং এটাই ভবিতব্য সেরকম মানবসভ্যতাও দেখা যাচ্ছে গভীর সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে। অদ্যাবধি মানুষের ইতিহাস হল পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতার খোঁজে এক যাত্রা। কিন্তু কর্পোরেটরা ইতিহাসের এই স্বাভাবিক পথ চলাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কর্পোরেট জগতের চালিকাশক্তি 'প্রফিট' বা মুনাফা। কিন্তু বিশ্বপ্রকৃতি তো মুনাফা বোঝে না, মানবসমাজের চালিকাশক্তিও প্রফিট নয়। মুনাফাভোগী শ্রেণি নিজের সুবিধার্থে সামগ্রিক চিত্রকে জনমানুষের চোখের আড়ালে রেখে দেয়। তাই দেখি জিরো প্লাস্টিক রাজ্য সিকিম (যেখানকার সিংহভাগ মানুষ নিজের বাড়িতে সোলার শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করেন), প্রত্যেক বছর বর্ষায় বাঁধ ভাঙা বন্যায় ভেসে যায়। চুংথাম বা তিস্তার শাখা নদীগুলির ওপর অবস্থিত অন্যান্য বাঁধ থেকে যৎসামান্য সবুজ শক্তি উৎপন্ন হয়, কিন্তু তার কোল্যাটেরাল ড্যামেজ হন স্থানীয় মানুষ। খবরের কাগজ আমাদের জানায় ক্লাইমেট চেঞ্জের জন্য বন্যা হয়েছে, কখনোই লেখে না যে বৃহৎ নদী বাঁধের প্রধান সমস্যাই হল বারংবার বন্যা। কারণ বাঁধের ফলে নদীর গতিপথে চড়া পড়ে গিয়ে জলধারণের ক্ষমতা হ্রাস পায়। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের নদীগুলিকে জোড়ার একটি বহু বিতর্কিত প্রকল্প বাস্তবায়িত করার পরিকল্পনা করছে। সবুজ শক্তিকে উৎসাহ প্রদানের জন্য তৈরি হবে আরও আরও নদীবাঁধ। এই পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গাঙ্গেয় উপত্যকা যা পৃথিবীর উর্বরতম অঞ্চল, তার জমির চরিত্র ও ভূমিপৃষ্ঠের সমস্ত মিষ্টি জলের উৎস সম্পূর্ণ হারাতে চলেছে।
আবার কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখের মরুভূমিতে সরকার দেশের বৃহত্তম সোলার পার্ক বানাতে চাইছে। আমরা আগেই বলেছি এই ধরনের বড় সোলার পার্কের কারণে তাপমাত্রার পরিবর্তন হতে পারে কিনা কেউ জানে না। লাদাখের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে যে আল্পস পর্বতমালা থেকে ঘাস ও ছোট গাছগাছালি নিয়ে এসে সোলার প্যানেলের ছায়ায় সেগুলি চাষ করা হবে। সেই ঘাস স্থানীয় মেষপালক গোষ্ঠীর জীবিকার উৎস হবে। খোঁজ নিলে জানতে পারবেন স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে আল্পসের ঘাসের মিথজীবিতা নিয়ে গবেষণা হয়েছে মাত্র বছর পাঁচেক এক ব্যক্তির বাড়ির বাগানে। প্রায় বিগত পনেরো বছর ধরে লাদাখে চাষাবাদ ও সবুজায়নের নানান প্রকল্প চলছে। বিগত এক দশক ধরে লাদাখের মরুদেশে বন্যার খবর আমাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সবুজায়নের ফলে সেই অঞ্চলের বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। ফলস্বরূপ বৃষ্টিপাত বাড়বে। মরুদেশের শীর্ণকায় নদীগুলির এই বিপুল পরিমাণ জল বহন করার ক্ষমতা নেই।
সিকিম ও লাদাখ এই দুই জায়গাতেই মানুষ সরল বিশ্বাসে কর্পোরেট উন্নয়নের মডেল মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তাতে হয়রানি/ জীবনহানী/ জীবিকার অনিশ্চয়তা/ মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি আটকানো সম্ভব হচ্ছে কি? নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সামগ্রিক চিত্রকে অস্বীকার করে কর্পোরেটরা শুধু মুনাফা দেখে। এই মুহূর্তে সেটাই পৃথিবীর সব থেকে বড় সংকট।
আওয়াজ তুলুন :
- ধনীদের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন বা কর্পোরেট দূষণ না কমলে দেশের সামগ্রিক চিত্র পরিবর্তন হবে না।
- সবুজ শক্তির নামে যেসব পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে তাতে সামগ্রিক দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- ব্যাঙ্কের খাতায় কার্বনের হিসাব মিলিয়ে পরিবেশ ও সভ্যতা রক্ষা পাবে না। চাই সঠিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি।
- সমস্ত প্রকার জিএম ও সিন্থেটিক খাদ্যের বিরোধিতা করতে হবে।
- সরকার জনগণকে বলিষ্ঠ গণপরিবহন পরিষেবা দিতে বাধ্য থাকবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি পরিবহন ব্যবসাকে উৎসাহ দিতে হবে। গণপরিবহনের ক্ষেত্রে একচেটিয়া পুঁজির বিরোধিতা করতে হবে।
- শহরের রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ির বেআইনি পার্কিং অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং নিয়ম ভাঙার জন্য উচ্চহারে জরিমানা ধার্য করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য জনবার্তা পত্রিকার বইমেলা, ২০২৫ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত।