ছোটবেলায় খুব গরম পড়লে মনে হত কেন এখন একটু বৃষ্টি পড়ছে না, আর বর্ষাকালে মনে হত বিকেলে যেন বৃষ্টির জেরে খেলাটা পণ্ড না হয় । মনে হত এই প্রাকৃতিক অবস্থা যদি নিয়ন্ত্রণ করা যেত তাহলে কি ভালোই না হত। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেই মানুষ টিকে থেকেছে এই পৃথিবীর বুকে, যুগযুগান্ত ধরে, আর ক্রমশ তার মনের মধ্যে বেড়েছে এই প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার বাসনা। মানুষ প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছে নিজের বেচে থাকার রসদ জোগাড় করতে আর নিজের বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা ব্যবহার করেছে প্রকৃতির ভয়াল গ্রাস থেকে বাঁচতে। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ও জীবনযাপন সহজ করে তুলতে নিত্যনতুন আবিষ্কার করেছে, উন্নতি করেছে প্রযুক্তির। প্রতি পদক্ষেপেই মানুষ প্রভাবিত করেছে এই পৃথিবীর পরিবেশ ও প্রকৃতিকে যেমন অন্য প্রাণীরাও করে। কখনো আগুন জ্বেলেছে শৈত্য ঠেকাতে,কখনো গাছ কেটেছে চাষের জমি বা বাড়িঘর তৈরীর প্রয়োজনে। সুদূর অতীতে এই অসংগঠিত কর্মকাণ্ড পৃথিবীর জলবায়ুর উল্লেখযোগ্য পার্থক্য সৃষ্টি করেনি কারণ পৃথিবীর আকৃতির তুলনায় তা আণুবীক্ষণিক রকম ক্ষুদ্র।

১৮ শতকের মাঝামাঝি থেকে প্রকৃতি ও জলবায়ুর পরিবর্তন এক বিশেষ অভিমুখে এগোতে শুরু করল। শিল্প বিপ্লব এবং ক্রমশ পুঁজিবাদের বিস্তার পৃথিবী জুড়ে প্রকৃতির যে “পরিবর্তন” ঘটানো শুরু করল তার সঙ্গে আগের অবস্থার তুলনা চলে না। শহরায়ন, কলকারখানার প্রয়োজনে এবং খনিজ নিষ্কাশনের প্রয়োজনে বনভূমি ধ্বংস হতে শুরু করল আর কারখানা থেকে নির্গত বিভিন্ন গ্যাস(যা মানুষের জন্য ক্ষতিকারক) ও রাসায়নিক বর্জ্য্ ক্রমশ বাড়তে লাগল, ফলত প্রকৃতি ও পরিবেশে তার ছাপ পড়ল যা আজ আমরা দিল্লি সহ পৃথিবীর বহু শহরে বিশেষ ভাবে টের পাচ্ছি।

প্রকৃতির এই পরিবর্তন, যা মানুষের বেঁচে থাকার পরিপন্থি, তাকেই আমরা পরিবেশ দূষণ বলে জানি। সেই ছোটবেলা থেকে পাঠ্য বই পড়ে আর পরীক্ষায় বহুবার রচনা লেখার সুবাদে আমরা জানি পরিবেশ দূষণ কি এবং কিভাবে তা হয়। আমরা জানি প্লাস্টিক কি প্রচণ্ড দূষণ ঘটায় আর মাটির নিচে থেকে জল তুলে নিলে ঠিক কি রকম দূষণ হয়। তবে মজার কথা হল, কে বা কারা এর জন্য দায়ী এই প্রশ্নটা এলেই দেখা যায় দায়টা চেপে যায় শুধু ব্যক্তি মানুষের ওপর। অবশ্যই ব্যক্তির দায় তো থাকেই - আশপাশ অপরিষ্কার রাখা থেকে শুরু করে প্লাস্টিক ব্যবহার, মাটির নিচে থেকে জল তোলা থেকে শুরু করে পাণীয় জলের অপচয়। কিন্তু সেই বড় বড় কোম্পানিগুলোর দায় উহ্য হয়ে যায় যারা তাদের কলকারখানায় গ্যালন গ্যালন জল অপচয় করছে, বিষাক্ত গ্যাস ছড়াচ্ছে(ভূপালের ক্ষত আমরা আজও বয়ে বেড়াচ্ছি), ক্ষতিকারক রাসায়নিক বর্জ্য জড়ো করছে আমাদের চার পাশে। মানুষের নিত্য প্রয়োজনে যা জল ব্যবহার হয় তার বহুগুণ বেশি ব্যবহার হয় কলকারখানায়[১,২,৩] যা অধিকাংশ সময়ই তারা পরিশোধন তো করেই না বরং খরচা বাঁচানোর জন্য সেই জল সরাসরি ফেলে দেয় নদী বা সমুদ্রে যা সরাসরি দূষণ ঘটায়। ঠান্ডা পানীয়র বহুজাতিক কোম্পানিগুলো(যাদের নাকি আজকাল কর্পোরেট বলে) যে পরিমাণে জল মাটির নিচে থেকে তুলে নেয় তার সঙ্গে ব্যক্তিগত ব্যবহারের কোন তুলনাই চলে না। কোকোকোলার কারখানার দৌলতে কেরালার প্ল্যাচিমাডা গ্রামের দুরবস্থার কথা আজ আমরা অনেকেই জানি[৪,৫]। দীর্ঘ আন্দোলনে বন্ধ হয় সেই কারখানা কিন্তু সেই কোম্পানি এবং এরকম অন্যান্য কোম্পানি এখনও বহাল তবিয়েতে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে আর বাড়াচ্ছে আমাদের চারপাশে সার্বিক দূষণ যা কদাচিত আমাদের পাঠ্যপুস্তকে জায়গা পায়। সেখানে বার বার মনে করানো হয় আমাদের অর্থাৎ সাধারণ জনগণের কি করণীয় প্রকৃতিকে বাঁচানোর জন্য।

আচ্ছা এটা কি আমরা ভেবে দেখেছি যে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করার জন্য প্লাস্টিকের কারখানাগুলো বন্ধ করে দিলেই তো হয়, জনগণের কাছে গিয়ে বার বার বলার কি প্রয়োজন যে প্লাস্টিক খুব খারাপ জিনিস - ভয়ানক দূষণ ছড়ায় - প্লাস্টিক ব্যবহার করা একদম উচিত নয়? আমাদের পাড়ার সাধারণ দোকানদারদের জরিমানা করা হয়, কখনোও প্রশাসন লাইসেন্স বাতিলের ভয় দেখানো হয় প্লাস্টিক ব্যবহার করার জন্য কিন্তু বড় বড় কোম্পানিগুলো যে প্লাস্টিকের মোড়কে (আজকাল যাকে বলে প্যাকেজিং) জিনিস পাঠায় তাদের কেউ কিছু কেন বলে না? কেন কোনো প্রশাসনিক পদক্ষেপ দেখা যায় না তাদের বিরুদ্ধে? অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করার ইচ্ছে বড় বড় কোম্পানিগুলোর নেই, “স্বাভাবিক ভাবেই” মুনাফায় ঘাটতি তারা কেন বরদাস্ত করবে(প্লাস্টিকের খরচ তুলনামূলক বেশ কম)? আর প্রশাসন কর্পোরেটদের আজ্ঞাবহ তল্পীবাহী কারণ প্রশাসন তো তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করবে যারা ভোটের খরচ জোগাবে। তাই তারা আপনাকে আমাকে ধমকাবে চমকাবে প্লাস্টিক ব্যবহার জন্য যাতে আমাদের মনে হয় পরিবেশ দূষণের জন্য আমরাই দায়ী আর কর্পোরেটদের ব্যপারে টু শব্দটিও করবে না।

দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদের রমরমা যত বাড়ছে এবং তার অনুসারী মুনাফা, আরও মুনাফা, আরও আরও মুনাফার লোভ কোম্পানিগুলো ও তাদের মালিকদের (যাঁদের এখন কর্পোরেট বলা হয়) মধ্যে যত বাড়ছে, তারা সমানুপাতিক হারে পরিবেশ দূষণও তত বাড়িয়ে চলেছে। আর প্রশাসন নিষ্ঠাভরে তার দায়িত্ব পালন করে চলেছে যাতে সেই তথ্য লুকিয়ে রাখা যায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে, কখনও এসব বিষয়ে উদাস থেকে, আবার কখনও নৈতিক দায়িত্ব সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়ে। এসব কিছুর পরেও যদি জনরোষ তৈরী হয় এবং কর্পোরেটদের পাছে কোনো ক্ষতি হয়, সে আশঙ্কা নির্মুল করতে পুরনো আইনের হেরফের করে অথবা নতুন আইন তৈরী করে কর্পোরেটদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তারা কখনোই গাফিলতি করেনি। ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনার মতো ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কর্পোরেটদের বাঁচানোর তাগিদে প্রশাসন কতদূর যেতে পারে কারণ তখনকার আইন অনুযায়ী মালিকের কঠিন শাস্তি হওয়ার মতো আইন ছিল। তবে এখন আর সেই কুম্ভ রক্ষার চাপ প্রশাসনকে নিতে হবে না, কারণ বর্তমান আইনে অনুরূপ ঘটনায় কর্তৃপক্ষ জরিমানা দিয়েই ছাড়া পেয়ে যাবে এবং কোন ফৌজদারি মামলার হেপা তাদের আর সামলাতে হবে না।

জলবায়ুর পরিবর্তনের কথায় ফেরা যাক। জলবায়ুর পরিবর্তন যে শুধু মানুষের কার্যকলাপেই পরিবর্তিত হয় এমন তো নয় প্রাকৃতিক কারণেও হতে পরে, সুর্যের প্রভাব বা ভূমিকম্প অথবা আগ্নেওগিরির কারণেও হতে পারে। তবে জাতিসংঘ কিছুদিন যাবৎ বলছে ১৮০০ শতকের পর থেকে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রধান কারণ নাকি মানুষের কার্যকলাপ। মানুষের কার্যকলাপেই নাকি গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিনহাউস গ্যাস হচ্ছে সেই সমস্ত গ্যাস যেগুলো পৃথিবীর ওপর একটা আবরণ তৈরী করে যার ফলে সুর্য থেকে আগত রশ্মি পৃথিবী থেকে প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে বেরিয়ে যেতে পরে না এবং পুনরায় পৃথিবীর দিকেই ফিরে আসে ফলে উত্তাপ বেড়ে যায়। কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড , হাইড্রোফ্লোরকার্বন ও আরও কিছু গ্যাস এই তালিকায় পড়ে যদিও প্রধাণত কার্বন ডাই অক্সাইড ও মিথেন নিয়েই তারা বেশি শব্দ খরচ করে থাকে।

প্রথমেই জানা প্রয়োজন এই গ্যাসগুলো বাড়ছে কি করে? প্রথমত ও প্রধাণত কলকারখানার দৌলতে, আর নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করার ফলে। কিন্তু আজব বিষয় হল যারা(বিভিন্ন দেশের প্রশাসন, জাতিসংঘর মত বিভিন্ন সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের প্রশাসন) এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত বলে প্রচার করছে তারা ঠিক কি পদক্ষেপ নিচ্ছে এই অবস্থা পরিবর্তন করার জন্য? এখানেই বিষয়টা বেশ মজাদার হয়ে ওঠে। এখানেও দায়টা তারা ঘুরিয়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন সাধারণ মানুষের ওপরে। সাধারণ মানুষ কে বলা হচ্ছে গাছ লাগান, পাড়ায় পাড়ায় বৃক্ষ রোপন উৎসব হচ্ছে আর প্রশাসনিক সহায়তায় কর্পোরেটরা বনভূমি সাফ করে ফেলছে উন্নয়ণের দোহাই দিয়ে। বেশিদিন আগের কথা নয়, আদালত আর এ ফরেস্টের দুই তৃতীয়াংশ কেটে ফেলা কে সায় দিয়েছে “উন্নয়ণের খাতিরে” এমনকি ২৯ জন যারা প্রতিবাদ করছিলেন তাদের গ্রেফতার ও করা হয় কারণ তাঁরা নাকি “উন্নয়ণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে” গাছ কাটার প্রতিবাদ করছিলেন। খনিজ তোলার জন্য একরের পর একর বনভূমি সাফ করে ফেলা হয়, সেখানে কারোর কোনো কথা চলে না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বলা হয় বনভূমি কাটা হলে তার জায়গায় অন্য কোথাও গাছ লাগিয়ে দিলেই নাকি চলবে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে কথাও কথাও পাম গাছ লাগিয়ে তাকে বনভূমি আখ্যা দেওয়া হচ্ছে [২৬] যা কখনোই বনভূমির পরিপূরক হতে পারে না। যেমন শহরের আসে পাশে গাছ লাগিয়ে বা বাগান তৈরী করে তা বনভূমির সমতুল্য হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। শহরে বা যেখানে সম্ভব সেখানেই তার পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সামঞ্জস্যওপূর্ণ গাছ লাগানোই উচিত, কিন্তু তা বনভূমিকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না। বনভূমি শুধু যে অক্সিজেন দেয় তাই নয় সেখানে একটা বাস্তুতন্ত্র থাকে। এমনকি যে উপজাতির মানুষ সেখানে বসবাস করে তারাও সেই বাস্তুতন্ত্রের অঙ্গ। বিষয়টা এখানেই সীমিত নয়, আঞ্চলিক বৃষ্টিপাত, কোন দিক থেকে আসা হাওয়া কতদূর যাবে এসব কিছুই বনভূমির সঙ্গে জড়িত। এর জলন্ত উদাহারণ দিল্লি। আসে পাশের বনভূমি কেটে সাফ করে ফেলার দৌলতে যে ধোয়াশা আগে দিল্লির ভেতরে ঢুকত না তা আজ ঢুকছে এবং মানুষের শ্বাস নেওয়ার অধিকারটাও কেড়ে নিচ্ছে। আর একটা উদাহরণ সুন্দরবন। সুন্দরবনের দৌলতে কলকাতা ও তার আসে পাশের অচল প্রচণ্ড ঝড়ের প্রকোপ থেকে বাঁচাত, যত সুন্দরবনের গভীরতা কমছে কলকাতা ও পার্শবর্তী অঞ্চলে ঝড়ের প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। সন্দেহ জাগে পরিবেশ দূষণ নিয়ে যে প্রচার চারপাশে চলছে এবং যারা তার মূল উদ্যোক্তা তারা কি সত্যিই পরিবেশ দূষণ নিয়ে চিন্তিত? বনভূমির ক্ষয় ক্ষতিতে তাদের কিছু কি যায় আসে? নাকি এর পেছনেও আছে অন্য কিছু যেমন প্লাস্টিক বন্ধ করা নিয়েও হম্বিতম্বী আছে কিন্তু নেই কোন আসল উদ্যোগ।

দেখা যাক এই প্রশ্নে কোন আলোকপাত করা যায় কিনা। আমরা বরং একটু পিছিয়ে যাই ১৯৪৬ সালে। ভিনসেন্ট জে শেফার, বার্নার্ড ভন্নেগাট এবং আইভিং ল্যাংমুরি জেনারেল ইলেকট্রনিকসের গবেষণাগারে গবেষণা করছিলেন এক বিশেষ বিষয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেখা গেছিল উড়োজাহাজের ডানায় বরফের আস্তরণ জমে যায় কিছু বিশেষ অবস্থায় যা বহু ধরণের অসুবিধা সৃষ্টি করে উড়ানে। এই বিষয় নিয়েই গবেষণা করতে গিয়ে তাঁরা দেখেন যে কৃত্রিম ভাবে তৈরী মেঘ থেকে বরফ পড়ার মত অবস্থা তৈরি করা সম্ভব। শেফারই প্রথম মেঘের বীজ বপন করেছিলেন একে বলা হল “ক্লাউড সিডিং”। শেফার এবং পাইলট কার্টিস ট্যালবট সফলভাবে শুকনো বরফ ব্যবহার করে মেঘ থেকে বৃষ্টি তৈরী করতে সক্ষম হন। “সিডিং এজেন্ট” হিসাবে সিলভার নাইট্রেট যে ব্যবহার করা যায় তাও জানা যায় সেই সময়। ১৯৪৭ সালে প্রথম সফল “ক্লাউড সিডিং” করা হয়[৭], এই গবেষণার নাম ছিল “প্রোজেক্ট সাইরাস”। জমাট না বাঁধা মেঘকে কৃত্রিম ভাবে জমাট বাঁধিয়ে যে বৃষ্টিপাত ঘটানো সম্ভব তা এর থেকে প্রমাণিত হয়। মোটের ওপর মানুষ কৃত্রিম ভাবে বৃষ্টি নামাতে সক্ষম হয় যা এর আগে একমাত্র প্রাকৃতিক ভাবেই সম্ভব হত।

এরপর প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের (weather modification) গবেষণা আরও গতি পায়। তবে এই গবেষণা তাৎক্ষণিক ভাবে জনসমক্ষে খুব একটা আসেনি। এমনকি সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও এবিষয়ে একটা সময় পর্যন্ত অন্ধকারেই ছিল। এমন চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়ে উঠল যুদ্ধের হাতিয়ার। এবিষয়ে অপারেশন পপেই-এর উল্লেখ করা যেতে পরে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন বিমান বাহিনী অত্যন্ত গোপনে একটি অপারেশন করে যার লক্ষ্যে ছিল হো চি মিন ট্রেইলের নির্দিষ্ট এলাকায় বর্ষার সময়কে সম্প্রসারিত বা দীর্ঘায়িত করা যাতে রাস্তার উপরিভাগ নরম হয়ে যায় এবং জমি ধসে গিয়ে ভিয়েতনামের বাহিনীর সামরিক সরবরাহ ব্যাহত করা যায়। এই সময় ভিয়েতনামে বর্ষার সময়কাল অন্যান্য বছরের তুলনায় ৩ মাস বেড়ে গেছিল। প্রাক্তন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব, রবার্ট এস ম্যাকনামারা জানতেন যে এই কাজের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সমাজ নানা প্রশ্ন তুলতে পারে তবু তিনি তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে একটি মেমো পাঠান, যেখানে তিনি বলেন যে দেশের সুরক্ষার স্বার্থে এই ধরণের আপত্তিকে প্রধান্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতীতে কোন সামরিক গতিবিধি বন্ধ করেনি, যার অন্তর্নিহিত অর্থ এখনও এই ধরণের আপত্তিকে গুরত্ব দেওয়া অনুচিত। রাসায়নিক ব্যবহার করে আবহাওয়া পরিবর্তন কর্মসূচি থাইল্যান্ড থেকে কম্বোডিয়া, লাওস এবং ভিয়েতনামের উপর পরিচালিত হয়েছিল। শোনা যায় সেক্রেটারি অফ স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার ও সিআইএ, তৎকালীন প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি মেলভিন লেয়ার্ডের অনুমোদন ছাড়াই এই অপারেশন চালান। কৃত্রিম আবহাওয়ার পরিবর্তন যে কৌশলগত এক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং সেই প্রযুক্তি যে হাতে আছে, এই পুরো বিষয়টাই প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি মেলভিন লেয়ার্ড সে সময় কংগ্রেসের সামনে অস্বীকার করেছিল[২৫]। যদিও বেশিদিন সব কিছু পর্দার আড়ালে রাখা সম্ভব হয় নি। জাতিসংঘ ১৯৭৭ সালের ১৮ই মে-র সম্মেলনে একটি চুক্তিপত্র নিয়ে আসে সকল সদস্যের সাক্ষরের জন্য যার শিরোণাম ছিল প্রকৃতি বা আবহাওয়ার পরিবর্তনের প্রযুক্তিকে সামরিক বা প্রতিকুল পরিস্থিতি তৈরীর কাজে ব্যবহার করার থেকে বিরত থাকা। অর্থাৎ ১৯৭৭ সাল নাগাদ জাতিসঙ্ঘের সদস্য দেশগুলো অন্তত জানত যে এরকম প্রযুক্তি তৈরী করা গেছে বা খুব তাড়াতাড়ি করে ফেলা যাবে।

এর পরের ঘটনাবলী আরও চমকপ্রদ(উদ্বেগজনকও বটে)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিগত তথ্যকেন্দ্র (Defense Technical Information Center) তে থাকা গবেষণা পত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে ১৯৯৬ সালের অগাষ্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর সামনে এক উপস্থাপনা হাজির করা হয় যার র্শীষক “weather as a force multiplier:Owning the weather by 2025”, অর্থাৎ পরিবেশ ও জলবায়ুর দখলদারী ও মালিকানা বা সোজা হিসেবে সম্পুর্ণ নিয়ন্ত্রণ(অবশ্যই নিজেদের প্রয়োজন ও সুবিধার্থে)। উপস্থাপনাটি করেন ৭ জন সামরিক ব্যক্তিত্ব। ১৯৯৬ সালের উপস্থাপনায় বলাহয় ২০২৫ এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ বাহিনী উদিয়মান প্রযুক্তির ওপর বিনিয়োগ, নির্ভর ও এই প্রযুক্তির আরও উন্নতি ঘটিয়ে আবহাওয়ার ওপর সম্পুর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে। এই প্রযুক্তি যুদ্ধ ক্ষেত্রের চেহারা এমন ভাবে বদলে দিতে পারে যা আগে কখনোও সম্ভব হয় নি। এই প্রযুক্তি প্রতিপক্ষর বিরুদ্ধে এবং বন্ধুপক্ষের সাহায্যার্থে ব্যবহার করা যাবে। একটু দেখে নেওয়া যাক কি কি করা সম্ভব এই প্রযুক্তি দিয়ে। শত্রু পক্ষের অঞ্চলে বর্ষা বাড়ানো যাতে সেখানে বন্যা পরিস্থিতি তৈরী করা যায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করা যায়, শত্রু পক্ষের শারীরক অস্বস্তি বাড়িয়ে মনোবল দুর্বল করা যায়। ঝড় বাড়িয়ে শত্রু পক্ষের কর্মকাণ্ড স্তব্ধ করে দেওয়া যাবে। বৃষ্টিপাত কমিয়ে খরা তৈরী করা এবং মিষ্টিজলের জোগান শত্রু পক্ষের জন্য বন্ধ করে দেওয়া যাবে। বায়ুমন্ডলের বিশেষ স্তরের অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে যোগাযোগের বিঘ্ন ঘটানো থেকে রাডারকে অকেজো করে দেওয়া - সবই সম্ভব। মহাকাশে অবস্থিত শত্রু পক্ষের সম্পত্তি(যেমন কৃত্তিম উপগৃহ) আংশিক ভাবে অকার্যকর করা থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা যাবে। মেঘ ও কুয়াশা নির্মুল করে প্রতিপক্ষের অবস্থান নির্নয় এবং প্রতিপক্ষ যাতে মেঘ বা কুয়াশার আড়াল না নিতে পারে তা নিশ্চিত করা যাবে। আবার যুদ্ধের সময় এই সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজের বা বন্ধু পক্ষের সুবিধেও করা যাবে। যেমন বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণ করে দৃশ্যমানতা বাড়ানো, নিয়ন্ত্রণ রেখা বজায় রাখা, শারীররিক অস্বস্তি কমিয়ে মনোবল বাড়ানো এসবই করা সম্ভব। ঝড় নিয়ন্ত্রণ করে যুদ্ধ ক্ষেত্রের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করাও যাবে। বায়ুস্তরের অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করা থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষের যোগাযোগ মাধ্যমে আড়ি পেতে তাদের কথোপকথন শোনা যাবে। মেঘ ও কুয়াশার আবরণ তৈরী করে মিত্রপক্ষের লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাবে। এই গবেষণা পত্রই বলছে এই প্রযুক্তি, ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক পরিসরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সুরক্ষা নীতির অংশ হতে চলেছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই যে একমাত্র আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গবেষণা করেছে এবং সেই প্রযুক্তি করায়ত্ত করেছে এমন নয়। ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিকের সময় চীন সফল ভাবে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করেছিল [১৯,২০]।

এরপর আমারা বরং কিছু বিন্দু রেখে যাই, পাঠক সহজেই এই বিন্দুগুলো যুক্ত করে নিতে পারবেন। এই লেখার চালনে পরবর্তী প্রসঙ্গ High-frequency Active Auroral Research Program বা সংক্ষেপে HAARP(হার্প)[৮]। কি এই হার্প? হাই-ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাক্টিভ অরোরাল রিসার্চ প্রোগ্রাম (HAARP) হল আয়নোস্ফিয়ার অধ্যয়নের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে সক্ষম হাই-পাওয়ার, উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি ট্রান্সমিটার। HAARP-এর বিজ্ঞানীরা আয়নোস্ফিয়ারের ছোট অঞ্চলগুলিকে গরম করতে এবং প্রভাবগুলি পর্যবেক্ষণ করতে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি রেডিও ট্রান্সমিটার ব্যবহার করেন। এখন প্রশ্ন হল এই গবেষণার সঙ্গে এই প্রবন্ধের সম্পর্ক কথায়। প্রথমত এই গবেষণা শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি। সময়টা ১৯৯৩। ১৯৯৯ এর মধ্যে মাঝারি ক্ষমতাসম্পন্ন এমন এক ব্যবস্থা তৈরী হয় যার সাহায্যে গবেষণা করা যাবে। দ্বিতীয়ত হার্প সম্পর্কে বলা হয় যে এই প্রযুক্তির প্রয়োগে নাকি পরিবেশ ও আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটানো যায়। ইউরোপীয় সংসদ, পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নীতি, ব্রাসেলস এর ডকুমেন্ট নম্বর A4-0005/99, 14 জানুয়ারী 1999 থেকে জানা যাচ্ছে যে ইউরোপীয় সংসদে হার্পের বিষয়ে আলোচনা চলাকালীন এই বিষয়ে বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে - পরিবেশের উপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কারণে এটি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের বিষয় এবং সেই জন্যেই এর আইনি, পরিবেশগত এবং নৈতিক প্রভাব একটি আন্তর্জাতিক স্বাধীন সংস্থা দ্বারা পরীক্ষা করার জন্য আহ্বান জানানো হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারংবার সেই অনুরোধ প্রত্যাখান করে এবং দুঃখ প্রকাশ করে। মনে রাখতে হবে এই অনুরোধ ছিল শুধু মাত্র এই প্রোগ্রামের পরিবেশগত এবং জনসাধারণের ঝুঁকির বিষয়ে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জনশুনানিতে কোনরকম প্রমাণ দিতে অস্বীকার করে। প্রশ্ন জাগে কেন এই গোপনীয়তা। প্রায় দু দশক পেরিয়ে আমরা এই গোপনীয়তার কারণ বুঝতে পারব, দ্য ইকোনমিক টাইমসে ২০১৮র ১৪ই জুলাইয়ের একটি প্রতিবেদন থেকে। প্রতিবেদনের র্শীষক - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরী অস্ত্র বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ হতে পারে: সরকার(এখানে সরকার মানে ভারতবর্ষের সরকারের কথা বলা হচ্ছে)[৯]। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারত সরকারের পরিবেশমন্ত্রী অনিল মাধব দাভে জানিয়েছেন - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাক্টিভ অরোরাল রিসার্চ প্রোগ্রাম(HAARP - হার্প) নামে এক ধরনের অস্ত্র(হার্প কে এখানে কোনো গবেষণা নয় - যুদ্ধের অস্ত্র বলা হচ্ছে) তৈরি করেছে যা বায়ুমণ্ডলে কেন্দ্রীভূত (focused) ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রশ্মি দিয়ে আঘাত করে এবং বিশ্বব্যাপী উষ্ণতার(Global Warming-এর) কারণ হতে পারে। তিনি এটাও বলেছেন যে জলবায়ুর পরিবর্তন শস্যর ফলন কমাতে পারে। আমাদের দেশে এবিষয়ে সরকারি ভাবে আলোচনা শুরু হয় আরও বছর দুয়েক আগে। বাংলার সাংসদ শ্রী সুখেন্দু শেখর রায় সংসদে হার্পের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। ভারত সরকারের তকালীন পরিবেশমন্ত্রী অনিল মাধব দাভে সেই প্রশ্নের জবাব দেন। ২০১৬র ১৮ই জুলাইয়ের রাজ্য সভার আলোচনায় এই বিষয়টা উঠে এসে ছিল। “Scientific American” ওয়েব পোর্টালে ২২শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭এ প্রকাশিত “মানুষের ক্রিয়াকলাপ আলাস্কান আকাশকে উত্তপ্ত করবে — ইচ্ছাকৃতভাবে এবং চিত্রকরভাবে” শীর্ষক নিবন্ধ থেকে আমারা এবিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পারি[১০]।

এবার একটু আমাদের দেশের কথায় আসা যাক। ভারতবর্ষেও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের গবেষণা শুরু হয়েছে বেশ অনেকটা আগেই। জাপানের আবহাওয়া সংস্থার জার্নাল “Journal of the Meteorological Society of Japan” এর ৪৬ নম্বর ভলিউমের ৩ নম্বর সংখ্যায় ভারতে আবহাওয়া পরিবর্তন শীর্ষক নিবন্ধয় আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ভারতে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৪ সালে ক্লাউড সিডিং করা হয়েছে দিল্লি,আগ্রা, জয়পুর, মুন্নার এই সমস্ত জায়গায়। সাম্প্রতিক অতীতে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে, আমাদের দেশে এ বিষয়ে যে গবেষণা হয় তার আনুষ্ঠানিক নাম “Cloud Aerosol Interaction and Precipitation Enhancement Experiment (CAIPEEX)”[১৩,১৪] যার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বৃষ্টিপাত বাড়ানো। ভারতীয় আবহাওয়া সমিতি “Indian Meteorological Society”র সরকারি ইস্তাহার “Vayu Mandal”র[১৫] ২০২০র পত্রিকা থেকে দেখা যাচ্ছে কর্ণাটকের বৃষ্টিছায়া অঞ্চলে ক্লাউড সিডিং করা হয়েছে। ২০২৩ এ মহারাষ্ট্রের শোলাপুরে ১৮% বেশি বৃষ্টিপাত ঘটান গেছে, ইকোনমিক টাইমসের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত খবর। এখন তো বেসরকারী সংস্থাদের ক্লাউড সিডিংয়ের বরাত দেওয়ার জন্য টেন্ডার ডাকা হচ্ছে। ক্লাউড সিডিংয়ের বিষয়ে ২০১৭র ১২ই এপ্রিল এবং ২০২১ এর ১৫ই ডিসেম্বর আলোচনা হয় লোকসভায়। ২০২৩ সালের ২৬সে ডিসেম্বর businessline অনলাইন পত্রিকার এক নিবন্ধে দেখা যাচ্ছে তৎকালীন earth science minister শ্রী কিরেন রিজিজু বলেছেন যে ভারতের হাতে কৃত্রিম ভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানোর প্রযুক্তি আছে যা একমাত্র চরম অবস্থায়ই ব্যবহার করা হবে। অতএব দেখা যাচ্ছে ভারতবর্ষে ক্লাউড সিডিংয়ের ইতিহাস বেশ পুরনো এবং সরকারও সরাসরি স্বীকার করছে যে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানোর প্রযুক্তি সরকারের হাতে আছে। সরকারের হাতে প্রকৃতি বা জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের অন্য কোনো প্রযুক্তিও কি আছে? বলা মুশকিল, তবে এবিষয়ে একটা তথ্য উল্লেখ করা যেতে পারে। উত্তর মেরুর চুম্বকশক্তির প্রভাবে উচ্চ আবহমণ্ডলের বাতাসের সঙ্গে মহাকাশ থেকে আগত শক্তিশালী ইলেকট্রন ও প্রোটন রশ্মির সংঘর্ষের ফলে উত্তর আকাশে এক বিশেষ আলোর ছটা দেখা যায়, যাকে বলে মেরুজ্যোতি বা অরোরা, যা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই তৈরি হয়। হার্পের ফলেও আকাশে একই রকম অরোরা দেখা যায়, যা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়োমে তৈরী নয় বরং বলাচলে মানুষের দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম অরোরা। আমাদের দেশে, লাদাখের আকাশে ২০২৪ সালের মে মাসে অরোরা দেখা গেছিল, যা স্বাভাবিকভাবে দেখা যাওয়ার কথা নয়। সংবাদপত্রে বলা হয়, তীব্র সৌর ঝড় পৃথিবীর বুকে আঘাত করায় নাকি ওই অরোরা দেখা গেছিল। সত্যিটা কি কে জানে?

তাহলে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা, কলকারখানার ধোঁয়ায় থাকা গ্রীন হাউস গ্যাস বা সৌর ঝড় বা এই সব কারণ বাদেও শুধু মাত্র মানুষের(বিশেষ ক্ষমতাবান, যারা হার্প এর মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করার অধিকারী, আপনার আমার মতো এলেবেলে মানুষের নয়) ইচ্ছেতেও বাড়তে পারে, তাদের ইচ্ছেতেই বৃষ্টি বাড়তে পারে, বন্যা বা খরা হতে পরে। তা হঠাৎ সেই সব বিশেষ ক্ষমতাবান মানুষদের এই সব ইচ্ছে হবে কেন? বিশেষত এই সব কিছু যেখানে মানব জীবনে ক্ষতিকারক প্রভাব রয়েছে। যেমন ক্লাউড সিডিং করে বৃষ্টি নামালে একদিকে যেমন বৃষ্টির জলে আম্লিক ধর্ম দেখা যাচ্ছে অন্য দিকে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এছাড়া আমাদের দেশে ক্লাউড সিডিং গবেষণার ফলে আমাদের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত অর্থাৎ মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে যে বৃষ্টিপাত হয় তা বিঘ্নিত হচ্ছে কিনা তা জানাটাও তো প্রয়োজন। ক্লাউড সিডিং করলে যে অঞ্চলে ক্লাউড সিডিং করা হচ্ছে সেখানে আশেপাশের অঞ্চল থেকে জলীয়বাষ্প এসে ঘণীভূত হবে এবং বৃষ্টিপাত হবে। যে অঞ্চল থেকে জলীয়বাষ্প এলো সেই অঞ্চলে জলীয়বাষ্পর ঘাটতি হবে। সুতরাং আশপাশের সেই সব অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হবে অথবা হবে না। অর্থাৎ যেখানে স্বাভাবিক ভাবে বৃষ্টি হত সেখানে হবে না, আর যেখানে স্বাভাবিক ভাবে বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল না সেখানে হবে।[২১] তার মানে জলবায়ুর পরিবর্তন। হার্পের ব্যবহার বা ক্লাউড সিডিং করে ঠিক কি কি জলবায়ুর পরিবর্তন হতে পারে বলা কঠিন কিন্তু সামগ্রিক উষ্ণতা যে বাড়তে পারে তা ভারতসরকারই স্বীকার করেছে। আমাদের দেশে শেষ কিছু বছর যাবৎ অসময় এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, এই সব প্রয়োগের ফলাফল হতে পারে কিনা সে বিচার পাঠক নিজেরাই করে নেবেন। প্রসংগত এবিষয়ে রাজ্যসভায় আলোচনা হয় এবং ৮ই অগস্ট ২০২৪এ সরকার জানায় যে বৃষ্টিপাতের যে প্যাটার্ন ভারতবর্ষে ছিল তাতে পরিবর্তন এসেছে[২১]। সেচের ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দেশে কৃষি এখনও অনেক অংশেই বৃষ্টি নির্ভর। অনিয়মিত এবং অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতে আমাদের দেশে ফসলের বেশ ক্ষতি হচ্ছে আর সরকারও ক্ষতিপূরণ দিতে বিশেষ অনীহা দেখাচ্ছে। আবার বৃষ্টির জলে আম্লিক উপাদান দেখা যাচ্ছে(অ্যাসিড রেইন) যার ফলে জমিও আম্লিক হয়ে উঠছে(ক্লাউড সিডিংয়ের কল্যাণে), যা সরাসরি চাষের ক্ষতি করছে। আবার এই অসময়ে এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের জুজু দেখিয়েই বলা হচ্ছে জেনেটিক্যালি মডিফাইড (কৃত্রিম ভাবে জিন পরিবর্তিত, যাকে সংক্ষেপে জিএম চাষ বলা হয়) বীজ দিয়ে চাষ নাকি আমাদের এই পরিস্থিতিতে বাঁচাতে পারে। [১৬,১৭,১৮]। জিএম চাষের ক্ষতিকারক দিকগুলো নিয়ে আমরা আমাদের আগের সংখ্যাগুলোয় বিস্তারিত আলোচনা করেছি। জিএম চাষ আমাদের দেশে জনপ্রিয়তা পায়নি বরং আমাদের দেশে মানুষ এখনও জিএম চাষের বিরোধীই বলা চলে। যে বিশাল কৃষক আন্দোলন আমাদের দেশ দেখল, সেখানেও জিএম চাষের বিরোধী স্বরই শোনা গেছে।

এমতাবস্থায় বার বার জলবায়ুর পরিবর্তনের (যা কৃত্রিম ভাবে ঘটানো সম্ভব) ফলে চাষের ক্ষতি হওয়া, একদিকে বিশ্বব্যপী উষ্ণতা বৃদ্ধির ধুয়ো ওঠা - অন্য দিকে যারা সেই ধুয়ো তুলছেন তাদের কল্যাণেই একরের পর একর বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাওয়া, কৃষকদের ক্ষতিপূরণ না পাওয়া এবং এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একমাত্র জিএম চাষই আমাদের বাঁচাতে পারে জাতিও প্রচার তুঙ্গে ওঠা - ঠিক কোন দিক নির্দেশ করে তা পাঠকরাই ঠিক করবেন। প্রসঙ্গত ভারতবর্ষে বেশ কিছু সময় যাবৎ ক্লাউড সিডিং করছে বিভিন্ন বেসরকারী কোম্পানি। তাদের বিশাল অংকের টাকার বরাত দেওয়া হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। দেশের উন্নয়ণ আর কর্পোরেট কোম্পানির মুনাফা এবং সরকারি চুরি যখন পরস্পর সম্পর্কীত হয়ে ওঠে তখনই গোলযোগ বাধে[২২,২৩,২৪]। ক্লাউড সিডিং বাজার ক্রমশ বড় হচ্ছে[২৪]। সঙ্গে জোরালো হচ্ছে জিএম চাষের পক্ষে প্রচার, আমাদের ঠিক কি করণীয় তা আমাদেরই ভাবতে হবে।

 

জনস্বাস্থ্য জনবার্তা পত্রিকার বইমেলা, ২০২৫ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত। 

 

তথ্যসূত্র :

১। https://www.inodedesign.com/sector-blog/water-consumption

২। https://2030.builders/world-water-day/

৩। https://www.aquatechtrade.com/news/industrial-water/industrial-water-essential-guide

৪। https://groundwater.kerala.gov.in/wp-content/uploads/2018/04/coca-cola-kerala.pdf

৫। https://en.wikipedia.org/wiki/Plachimada_Coca-Cola_struggle#:~:text=The%20Plachimada%20Coca%2DCola%20struggle,water%20turned%20contaminated%20and%20toxic.

৬। https://blog.indiacontent.in/news/buy-images-aarey-forest-controversy-case-timeline_832/

৭। https://idwr.idaho.gov/iwrb/programs/cloud-seeding-program/history-of-cloud-seeding/

৮। https://haarp.gi.alaska.edu/campaigns

৯। https://economictimes.indiatimes.com/news/defence/us-developed-weapon-system-may-cause-global-warming-government/articleshow/53268090.cms?from=mdr

১০। https://www.scientificamerican.com/article/human-activity-will-heat-alaskan-skies-deliberately-and-picturesquely/

১১। https://www.jstage.jst.go.jp/article/jmsj1965/46/3/46_3_160/_article/-char/en

 

১২। https://imetsociety.org/wp-content/pdf/vayumandal/2020462/2020462_7.pdf

১৩। https://www.tropmet.res.in/~caipeex/prog-structure.php

১৪। https://imetsociety.org/wp-content/pdf/vayumandal/2014/2014_1.pdf

১৫। https://www.thehindubusinessline.com/economy/agri-business/india-has-artificial-rain-technology-will-use-only-in-extreme-case-rijiju/article67676532.ece

১৬। https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1360138522000048

১৭। https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/35148945/

১৮। https://www.weforum.org/stories/2022/07/engineered-crops-can-fight-climate-change/

১৯। https://en.wikipedia.org/wiki/Beijing_Weather_Modification_Office

২০। https://www.nbcnews.com/id/wbna23397205

২১। https://sansad.in/getFile/annex/265/AU1954_SbPs0v.pdf?source=pqars#:~:text=The%20research%20findings%20are%20as%20follows%3A,-%E2%80%A2&text=Goa%20has%20recorded%20the%20maximum,by%20Rajasthan%20(414.2%20mm).%20change%20in%20rainfall%20pattern%20rajya%20sabha%20india

২২। https://www.thehindu.com/news/cities/Hyderabad/pay-4028-crore-towards-cloud-seeding-hc-directs-ap-ts/article31465985.ece

২৩। https://m.economictimes.com/news/politics-and-nation/cloud-seeding-during-congress-rule-to-be-probed-ap-minister/articleshow/48860429.cms

২৪। https://www.imarcgroup.com/cloud-seeding-market

২৫। https://en.wikipedia.org/wiki/United_States_herbicidal_warfare_research

২৬। https://www.indiatoday.in/diu/story/india-forests-a-tale-of-growth-loss-and-revival-2429324-2023-08-31

 

লেখক সম্পর্কে

GRAPH_AVATAR_IMG
অমর্ত্য