গ্রাফ ওয়েবসাইটে পূর্ব প্রকাশিত
(দ্বিতীয় কিস্তি)
কোভিড-১৯এর বয়স হল প্রায় দেড়বছর। মৃত্যুর সংখ্যা খুব তাড়াতাড়ি তিনকোটি হবে। এরমধ্যেই কোটি কোটি মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে। অসাধারণ মুনশিয়ানায় মানসিক এবং স্নায়বিক ব্যাধির মহামারী শুরু হয়ে গেছে। লকডাউন, মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, ভ্যাকসিন সত্ত্বেও কিম্বা হয়তো সেগুলোর কারণেই ভারতে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। এক বিশাল হোলোকাস্ট। কিন্তু প্রশ্ন হল কোত্থেকে এল এই মারণ মহামারী?
এর উত্তর আজও জানা যায়নি। জানার চেষ্টাও হচ্ছেনা। বরং জানার চেষ্টাকে ঘুরিয়ে বাধা দেওয়া হচ্ছে। উৎস না জানতে পারলে কী করে এমন এক অতিমারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় সম্ভব? হ্যাঁ, এই ভাইরাসের জন্ম চীনের উহানে। উহানে একটি বাজারের মধ্যেই করোনাভাইরাস গবেষণার শীর্ষস্থানীয় কেন্দ্র, উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি। ওই বাজারে বিভিন্ন ধরণের প্রাণী বিক্রি হয়। এই ভাইরাসের উৎসের মূলে দুটি তত্ত্ব আছে। এটা হয় কোনও এক বুনো জন্তু থেকে মানুষের শরীরে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অথবা এই ভাইরাস ওই ‘ল্যাব’ বা গবেষণাগার থেকেই কোনওভাবে বাইরে ছড়িয়ে গেছে। প্রথম তত্ত্বকে বলব বুনোসূত্র, যা প্রাকৃতিক। আর দ্বিতীয়টি ‘জেনেটিক্যালি ল্যাব ম্যানুফ্যাকচার্ড’।
এইখানে এসে আমরা জুরাসিক পার্ক সিনেমার গল্পের কথা ভাবি। ওখানে একটা থিম পার্ক ছিল। সেখানে ছয় কোটি বছর আগের এক জন্তুকে জেনেটিক্যালি ম্যানুফ্যাকচার করা হচ্ছিল। ডাইনোসরের থেকে ভাইরাসের জন্ম অনেক অনেক আগে। আজও তারা লক্ষ লক্ষ সংখ্যায় ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র নিয়ে আছে, থাকবে। আমাদের প্রত্যেকের শরীরে আছে। এবার রিয়ালিটিতে আসা যাক। কুড়ি বছর ধরে আমেরিকা তাদের গবেষণাগারে প্রকৃতিতে উপস্থিত ভাইরাসগুলোর চেয়েও বিপজ্জনক ভাইরাস জেনেটিক্যালি ম্যানুফ্যাকচার করে চলেছে, যাকে ‘গেইন অফ ফাংশন’ (জিওএফ) রিসার্চ বলা হয়। তারা যুক্তি দিয়েছে যে এগুলি নিরাপদেই তৈরি করা যায় এবং স্রেফ গবেষণার প্রয়োজনে। গল্প হলেও সত্যি মনে হচ্ছে না? গল্পেও জেনেটিক্যালি ডাইনোসর ম্যানুফ্যাকচারড হচ্ছিল, তবে সেতো গল্পে। জিওএফেও জেনেটিক্যালি বিপজ্জনক ভাইরাস ম্যানুফুয়াকচার্ড হচ্ছে, কিন্তু গল্প নয়। উহানেও ঠিক একইরকম ভাবে জেনেটিক্যালি ম্যানুফ্যাকচার্ড ভাইরাস নিয়ে কাজ হচ্ছিল।
উহানের গবেষণায় আর্থিক সহায়তা ছিল ফ্রান্সের, আমেরিকার, এমনকি আমেরিকার ওই ‘জিওএফ’ সংস্থারও। ওই ‘জিওএফ’ সংস্থা আর্থিক সহায়তা পেত আমেরিকার সরকারের তহবিল থেকে। শুধু আমেরিকা নয়, আরও অনেক ইউরোপিয় সংস্থাই সাহায্য করেছে। সেতো হতেই পারে। বিজ্ঞানের কোনও দেশ জাতি হয় না। কিন্তু এর পরের অংশ গল্পের মত মনে হবে।
উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজির গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ শি ঝেং-লি। যাকে আড়ালে অনেকে বলে ‘ব্যাট লেডি’। কেন, সে আর এক গল্প। উহানের ল্যাবে আর্থিক অনুদানের প্রধান ঠিকাদার ছিল, আমেরিকার ইকোহেলথ অ্যালায়েন্সের প্রেসিডেন্ট পিটার দাসজাক। উনি উহান ল্যাবের শি’য়ের সঙ্গে সাবকন্ট্রাক্ট করেছিলেন। তাতে অবশ্য বলা যায় না যে, শ্রীমতী শি তার ল্যাবে সার্স-২ তৈরি করেছিলেন বা তৈরি করেন নি, কারণ গবেষণার রেকর্ডগুলো আজও সিল করা আছে। রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আনবিক জীববিজ্ঞানী রিচার্ড এইচ এবারবাইট বলেছেন, এটা স্পষ্ট যে উহান ল্যাবই করোনভাইরাস তৈরি করছিল আর সংক্রমণ করায় তাদের দক্ষতার মূল্যায়ন করছিল। তার মানে কোভিডের জন্ম উহান ল্যাব থেকেই এই তত্ত্বের পক্ষে তিনি বলছেন। সেটা প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু এই উহান ল্যাবের আর্থিক সহায়তায় আমেরিকার প্রধান ভূমিকা ছিল। তা কী করে সম্ভব? জুন ২০১৪ থেকে মে ২০১৯ পর্যন্ত পিটার দাসজাকের ইকোহেলথ অ্যালায়েন্স উহানে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা করার জন্য বিপুল অনুদান দিয়েছিল। সার্স-২ সেই গবেষণার ফসল কিনা বলা মুশকিল। কিন্তু, একটু ভাবুন, এমন এক বিপজ্জনক গবেষণার জন্য একটি বিদেশী ল্যাব-এ আমেরিকার একটি গবেষণা সংস্থার অর্থ বরাদ্দ করাটা কি প্রশ্নের উর্দ্ধে? তাও চীনে?
এবার আরও অবাক হবার পালা। ২০১৪ সালে আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ, দাসজাকের ইকোহেলথ অ্যালায়েন্সকে ৩.৪ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়। যারা সন্দেহ করছেন উহান ল্যাব থেকেই ভাইরাসটি বাইরে এসে থাকতে পারে, তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার পিটার দাসজাক। কেন? কেন পাঁচ বছরে উহান ল্যাবকে পাঁচ লক্ষ ডলারেরও বেশি অর্থসাহায্য করা হয়েছিল? সেইসময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন জানিয়েছিল যে, ‘জিওএফ’-এর যে গবেষণায় বিপজ্জনক ভাইরাস তৈরি করা চলছে, সেই গবেষণায় জড়িত নতুন প্রকল্পগুলোকে আর অর্থ দেওয়া হবে না। তার মানে, এই জাতীয় গবেষণার উপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হল। এর মোদ্দা অর্থ উহানে অনুদান বন্ধ। অথচ ঠিক তার পাঁচ মাস পরেই, মে ২০১৪ থেকে উহান ল্যাবকে এই অর্থ প্রদান শুরু হয়ে গেল। কী সেই মিরাকল যে খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এই বিপুল অর্থ প্রদান সম্ভব হল? হয়েছিল দু’জনের অসম্ভব ধূর্ত বুদ্ধির জন্য। “আসলে এটা ঠিক ভাইরোলজির গবেষণা নয়, এটা টেকনোলজি সংক্রান্ত গবেষণা”, এই অজুহাতে কাজটা করে ফেলেছিল ‘এনআইএআইডি’ আর ‘এনআইএইচ’-এর ডিরেকটাররা। কারা তারা? নাম শুনে চমকে উঠতে হবে। তারা দুজন হলেন অ্যান্টনি ফাউচি আর ফ্রান্সিস কলিন্স। তারাই উহানে আর্থিক সাহায্য চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। আমাদের এখানে মিডিয়ার দৌলতে এখন অ্যান্টনি ফাউচি অত্যন্ত পরিচিত নাম।
কিন্তু এই তথ্যগুলো থেকে কী করে বলা সম্ভব যে এই ভাইরাস উহান ল্যাবেই ম্যানুফ্যাকচার্ড? হ্যাঁ, ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড সিড’-এর মত, ভাইরাসও তৈরি করা হচ্ছিল, ঠিকই। হয়ত কিছুটা অনৈতিকভাবে ফাউচি এবং ফ্রান্সিস, প্রেসিডেন্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই উহান ল্যাবে আর্থিক সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছিল। সেটাতো ভাইরোলজি গবেষণার স্বার্থেও হতে পারে। উল্টোটাও তো হতে পারে। কোনও বুনোজন্তু থেকে হয়তো এই ভাইরাস এসেছে। সেক্ষেত্রে ভাইরাসটি ম্যানুফ্যাকচার্ড তো বলা যাবে না। যেমন জেনেটিক্যালি মডিফায়েড চারা আর প্রাকৃতিক চারা এক নয়। এই ভাইরাসটি তো প্রকৃতি থেকেও এসে থাকতে পারে।
হ্যাঁ, পারে। এখন সেই গল্পই বাজারে চলছে। উহানে বাজারে নানা পশুপাখি বিক্রি হয়। আর ল্যাবটাও সেখানেই। তাহলে বুনো জন্তুর সম্ভাবনাটা খতিয়ে দেখা যাক।
ব্যাট লেডি শি ঝেং-লি। শি নর্থ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটির বিশিষ্ট করোনভাইরাস গবেষক রালফ এস বারিকের সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন। বিজ্ঞানীদের মতে, করোনার ভাইরাস বাদুড়ের মধ্যে আছে। এর সংক্রমণের জন্য মানুষ আর বাদুড়ের মধ্যে একটি মধ্যস্থতাকারী প্রাণীর দরকার হয়। মধ্যস্থতাকারী প্রাণী সনাক্ত না হলে বলা সম্ভব নয় যে সংক্রমণটি বুনোসূত্রেই এসেছিল। এর আগে দু’বার বড় ধরনের করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। ২০০২ সালে ‘সার্স-১’ এবং ২০১২ সালে ‘মার্স’। সেবার গবেষণার পরে, মধ্যস্থতাকারী প্রাণীগুলো সনাক্ত করা গিয়েছিল। শি ঝেং লি, যখন বুঝতে পারেন যে আগের দুটো করোনা ভাইরাসই বাদুড় থেকে এসেছিল, তখন তিনি চিনের বিভিন্ন ধরনের বাদুড়দের গুহা পরিদর্শন করে করোনার ভাইরাস নিয়ে নিবিড় গবেষণা চালাতে শুরু করেন। এই বাদুড় গবেষণার কারণেই তিনি আড়ালে ব্যাট লেডি হয়ে গিয়েছিলেন। জানা গিয়েছিল সার্স-১ ভাইরাসের মধ্যস্থতাকারী প্রাণী ছিল উহানের বাজারে বিক্রি হওয়া এক ধরনের বিড়াল। আর মার্সের মধ্যস্থতাকারী ছিল, উট। উট মধ্যপ্রাচ্যের জনপ্রিয় প্রাণী। তাই এই ভাইরাসের নাম হয়ে গেল মিডলইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম, মার্স।
নভেম্বর ২০১৫ সালে তারা সার্স-১ ভাইরাসের মেরুদণ্ড নিয়ে এবং এর স্পাইক প্রোটিনকে ব্যাট ভাইরাস থেকে নেওয়া একটি প্রোটিন দিয়ে প্রতিস্থাপন করে একটি অভিনব ভাইরাস তৈরি করেছিলেন। এই ভাইরাসটি মানুষের শ্বাসনালীর কোষগুলিকে সংক্রামিত করতে সক্ষম হয়েছিল। পরে উহানের ল্যাবে শি ফিরে এসে আবার জিনগতভাবে ম্যানুফ্যাকচার্ড করোনভাইরাস নিয়ে কাজ শুরু করেন। কে সেই গবেষণার অর্থ সংস্থান করেছিল? আমরা আগেই তা জেনেছি। এই কাজের জন্য অর্থবরাদ্দ ছিল সর্বকালীন রেকর্ড। কেন এই বিপূল অর্থবরাদ্দ? কী পরিকল্পনা ছিল? আজও সুনির্দিষ্টভাবে তা জানানো হয়নি।
বেশ, সার্স-১ বুঝলাম, মার্সও বুঝলাম, সার্স-২ যদি কোনও বুনো জন্তু থেকে এসে থাকে? যদি প্রাকৃতিক হয়? আজও সার্স-২-এর মধ্যস্থতাকারীর সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমনকি এই সার্সের উৎস বাদুড়জাতীয় কোনও প্রাণী থেকে কিনা তাও আবিষ্কার করতে পারা যায়নি। সার্স-১ বা মার্স ভাইরাসের মধ্যস্থতাকারী খুঁজে পাওয়া গেছিল, কিন্তু চিনা কর্তৃপক্ষের নিবিড় অনুসন্ধান সত্ত্বেও ৮০,০০০ প্রাণীর ওপর পরীক্ষা করেও সার্স-২ কোভিড-১৯ এর কোনও মধ্যস্থতাকারী প্রাণী পাওয়া যায়নি। তাই সার্স-২ বুনোসূত্র থেকে এসেছে এমন সিদ্ধান্তের কোনও প্রমাণ নেই।
সুতরাং, আরও তদন্তের প্রয়োজন আছে ঠিকই, কিন্তু এই ভাইরাস উহান ল্যাব থেকে পালিয়ে গেছে এই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। জুরাসিক পার্কের সেই থিম পার্ক থেকে জেনেটিক্যালি ম্যানুফ্যাকচার্ড ডাইনোসরের মত। যেই এই সম্ভাবনার কথা উঠেছে অমনি বিখ্যাত পত্রিকা ‘ল্যানসেট’ আর ‘নেচার’ এবং ‘হু’ এই সম্ভাবনাকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা কনস্পিরেসি থিওরি বলে ব্র্যান্ডিং করে ফেলেছে।
(ক্রমশ)