জনমানুষকে নিয়ে যেকোনো নীতি বা ধারনা সমকালীন সমাজনীতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতির ধারনার দ্বারাই পরিচালিত হয়ে এসেছে। সেটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। জনস্বাস্থ্যও এর ব্যতিক্রম নয়। চর্চার বিষয় হিসেবে জনস্বাস্থ্যর উৎপত্তি বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসবিদেরা এই ইতিহাসকে বলেন পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। উনবিংশ শতাব্দী অবধি এই চিকিৎসাশাস্ত্র বা চিকিৎসা ব্যবস্থা যা ছিল, তা ছিল ব্যক্তি মানুষের চিকিৎসাকে ঘিরে বা তার সুস্বাস্থ্য বজায় রাখাকে ঘিরে। সেটা শুধুই চিকিৎসা ছিল না, স্বাস্থ্য পরিষেবাও ছিল। কিন্তু তা ছিল ব্যক্তি মানুষের জন্য এবং রাজা বা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যক্তি মানুষের উদ্যোগে। অর্থাৎ রাজা বা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো ব্যক্তি চিকিৎসকের বা কোনো চিকিৎসক গোষ্ঠীর উদ্যোগে তৈরী কোনো চিকিৎসালয়। সেখানে ব্যক্তি মানুষ কিভাবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবেন, সেই নিদানও দেওয়া হোতো, কিন্তু জন স্বাস্থ্য বলতে আজ আমরা যা বুঝি তা আলোচিত হোতো না। এই ধারনার উৎপত্তি হয় বিংশ শতাব্দীর গোড়ায়, ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বিপ্লবের পরে। বিপ্লবের পরে রাশিয়ায়, ক্রমশ রাষ্ট্র দ্বায়িত্ব নেয় জনমানুষকে স্বাস্থ্যবান করা এবং রাখার কাজে, এবং রোগ প্রতিরোধের কাজে। রাষ্ট্রের দ্বায়িত্বে জনস্বাস্থ্যের ধারনার উৎপত্তি এখান থেকেই। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর বেশ কিছু বিশেষজ্ঞের (আনা হাইনস, অরি ই সিজারিস্ট, স্যার আর্থার নিউসহোম, জন এ্যডামস কিংসবারি ইত্যাদি) রাশিয়া ভ্রমণ এবং সেখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে গবেষণার মাধ্যমে তাদের দেশ এবং সেই সব রাষ্ট্রের অধীনে থাকা কলোনীগুলোর বাসিন্দারা বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ার (পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন) এই উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে পারে।
এই জনস্বাস্থ্যের ধারনায় ছিল জনমানুষকে স্বাস্থ্যবান করে তোলার এবং রাখার পরিকল্পনা - যথাযথ পুষ্টি, যথাযথ পরিশ্রম, হাড়ভাঙা খাটুনির থেকে মুক্তি, যথাযথ বিশ্রামের জায়গা, প্রতিকুল পরিবেশ থেকে বাঁচার ব্যবস্থা, প্রকৃতি এবং সমাজকে জানা, সৃজনশীলতার বিকাশ, ইত্যাদির মাধ্যমে। এবং ছিল রোগ প্রতিরোধের পরিকল্পনা - মূলত সংক্রামক রোগকে প্রতিরোধ করার পরিকল্পনার মাধ্যমে। সোজা কথায় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির পরিষেবার ব্যবস্থার মাধ্যমে।
অন্যদিকে, উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই, ইয়োরোপে সংক্রামক রোগের হাত থেকে বাঁচার জন্য চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, এবং বিজ্ঞানী মহলের হাত ধরে জন সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বিজ্ঞানী মহলে মহামারী নিয়ে অভিজ্ঞতার চর্চা হতে হতে, মহামারীবিদ্যা একটা নতুন বিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। ট্রপিক্যাল রোগের চর্চা হিসেবে শুরু হয়ে শেষে সে পুরো একটা বিষয় হয়ে উঠল মহামারীবিদ্যা নামে। বস্তুত ১৮৫১ সাল থেকেই ইন্টারন্যাশনাল স্যানিটারি কনফারেন্স শুরু হয়ে যায় ইয়োরোপে।
একদিকে এক বিশাল দেশে আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পটভূমির পরিবর্তনের সাথে সাথে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উৎপত্তি, এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে তার সংবাদ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়া, আর অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে মহামারী থেকে বাঁচার তাগিদে মহামারী নিয়ে চর্চা, ইতিহাসের এই দুই ধারার চাপে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে চর্চা শুরু হোলো বা বিকশিত হতে থাকল পৃথিবীর অন্যান্য অংশে অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী দেশ এবং তাদের কলোনি গুলোতে। ইন্টারন্যাশনাল স্যানিটারি কনফারেন্স হতে হতে, ১৯২০ সালে যখন লীগ অফ নেশনস গঠিত হয়, তখন এর একটা স্বাস্থ্য সংগঠন তৈরী করা হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল সংক্রামক রোগের মহামারী আটকানো।
এর সঙ্গে এর কয়েক দশক পরেই যুক্ত হয় সারা পৃথিবীর আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পটভূমিতে আর এক বড় পরিবর্তন। তা হোলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সারা পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদের বহু কলোনির স্বাধীনতার ঘোষণা। পৃথিবী জোড়া জনমানুষের পক্ষে এত বড় বড় পরিবর্তনের চাপে জনস্বাস্থ্যের দাবী সারা পৃথিবীতেই বিজ্ঞানীমহলে এবং প্রশাসক মহলে জোরালো হয়ে ওঠে। ফল স্বরূপ, একদিকে যেমন জনস্বাস্থ্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের চর্চার একটি বিষয় হয়ে ওঠে, তেমনি দেশে দেশে রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে জনস্বাস্থ্য নিয়ে পরিকল্পনার ব্যবস্থা রাখা রেওয়াজ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি, লীগ অফ নেশনস থেকে যখন ইউনাইটেড নেশনস তৈরী হোলো, তখন ওয়ার্ল্ড হেলথ এ্যসেম্বলীর মাধ্যমে তৈরী হোলো ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন। এই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে সংবিধান তৈরী হোলো ১৯৪৮ সালে তার মুখবন্ধে লেখা হয়েছিল যে স্বাস্থ্য মানে শুধু কোনো অসুখ বা প্রতিবন্ধকতা না থাকা নয়, স্বাস্থ্য মানে হোলো শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক ভাবে সম্পূর্ণ ভালো থাকা। সম্পূর্ণতার ধারনা নিয়ে অনেক বিতর্ক এবং জটিলতা থাকলেও, একথা আমাদের মানতেই হবে যে এই প্রথম আন্তর্জাতিক কোনো মঞ্চে স্বীকৃত হোলো যে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক স্বাস্থ্য এই সব মিলিয়েই কোনো ব্যক্তি মানুষের স্বাস্থ্য গড়ে ওঠে। জনমানুষের স্বাস্থ্য গড়ে তুলতে গেলেও শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক স্বাস্থ্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। এর পরে ক্রমশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্পোরেট সংস্থাদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে, জনমানুষের সুস্বাস্থ্য গড়ে তোলার ধারনা থেকে সরে এসেছে, সে আর এক ইতিহাস।
জনস্বাস্থ্যের অঙ্গীভূত মহামারীবিদ্যা থেকে নেওয়া যে মূল ধারনার ভিত্তিতে চিকিৎসকেরা চিকিৎসা করে এসেছেন এযাবৎ, এবং যে ধারনাকে বিজ্ঞানীরা মান্যতা দিয়ে এসেছেন এযাবৎ, তা হোলো সংক্রমণ থেকে রোগ হওয়ার প্রক্রিয়া। এই ধারনাতে বলা হয়েছে যে সংক্রমণ হলেই সেটা রোগ হিসেবে দেখা দেয় না। পরিবেশগত অবস্থা, ব্যক্তির শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, এবং সংক্রামক জীবাণুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, এই তিন ধরনের বৈশিষ্ট্য মিলে গেলে তবেই কোনো ব্যক্তির শরীরে রোগ তৈরী হবে, নাহলে নয়।
জনস্বাস্থ্যের এই বুনিয়াদী ধারনাগুলোকে এই কোভিড কালে, কোভিড ভাষ্যের মাধ্যমে নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
লকডাউনের কারণে যে কোটি কোটি মানুষ কর্মচ্যূত হয়েছেন, জীবিকার সুযোগ থেকে উৎখাত হয়েছেন, সরকারী ডোল নিতে বাধ্য হয়েছেন, অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছেন, তাদের নিয়েই তো জনস্বাস্থ্যের ভাবনা। তাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে এই কোভিড কালে এটা তো বলাই বাহুল্য। লকডাউন তো পরিকল্পিত। তাহলে পরিকল্পনা করেই তো তাদের অস্বাস্থ্যের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হোলো। মানসিক স্বাস্থ্যই বা তাদের কিভাবে ভালো থাকলো এর ফলে? অনাহারে, অর্ধাহারে থেকে, কর্মচ্যূত হয়ে জনমানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ভালোত্ব নিয়ে চিন্তা করাটাও তাকে উপহাস করারই সামিল। এবং মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব রচনা করে, বিভেদ বাড়িয়ে দিয়ে, তাকে ঘরে বন্ধ করে রেখে, তার সামাজিক স্বাস্থ্য ভালো থাকতে পারে? অথচ আমরা দেখলাম যে ঠিক তাইই করা হোলো। তাহলে প্রশ্ন কি ওঠেনা যে কার স্বার্থে এসব করা হোলো, জনমানুষের স্বার্থে যখন নয়?
মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে প্রশাসনকে ব্যবহার করে, সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙ্গার অজুহাতে। কিন্তু শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের শৃঙ্খল যে এভাবে ভাঙ্গা যায় না, তা মহামারীবিদ্যার চর্চায়, মানুষ জেনে গেছে বহুদিন আগেই, লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে মহামারীবিদ্যার ভিত্তি হিসেবে। এই কোভিড কালে সেই ধারণাকে উলটে দেওয়া হোলো। এটাও তার সাথে বলা হোলো না যে সারাদিন মাস্ক পরে থাকা ব্যক্তি মানুষেরও স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।
সংক্রমণ মানেই যে রোগ তৈরী হয় না, রোগ হতে গেলে যে সংক্রমণ, ব্যক্তির শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার খামতি এবং পরিবেশের প্রভাব, এই তিন ধরনের বৈশিষ্ট্যকেই যে উপস্থিত থাকতে হয়, এই কোভিড কালে বেমালুম ভুলিয়ে দেওয়া হোলো জনস্বাস্থ্যের সেই বুনিয়াদি ধারণাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার এ্যডভাইসরিতে লিখে প্রচার করলো যে এক্ষেত্রে সংক্রমণ মানেই রোগ বলে ধরতে হবে।
মহামারীবিদ্যার আরো এক ধারনা বিগত কয়েক দশক ধরে প্রমাণিত হয়ে এসেছে বারবার এবং প্রোথিত হয়ে গেছিল বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসক মহলে। সেটা এই যে শ্বাসতন্ত্রের আর এন এ ভাইরাসের ক্ষেত্রে কোনো কার্য্যকরী এবং স্থায়ী টীকা তৈরী করা অসম্ভব। কারণ এই ধরনের ভাইরাসের নিজেকে বারংবার পরিবর্তন করে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। স্রেফ প্রচারের জোরে ঢাকা চাপা পড়ে গেছে এই সত্য (যে প্রার্থী টীকাগুলোকে এত প্রচার দেওয়া হচ্ছে সেগুলো যে আদতে কাজ করছে না, এবং বিপজ্জনক, ঢেকে রাখা হচ্ছে সে তথ্যও, তবে সে কথা অন্যত্র আলোচ্য)।
অর্থাৎ জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিষয়ের যে বুনিয়াদি ধারনাগুলো তৈরী হয়েছিল বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এবং শাসক শ্রেনীর বিরুদ্ধে, জনমানুষের পক্ষে বড় বড় ঐতিহাসিক জয়ের ধারায়, এই কোভিড কালে নস্যাৎ করে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা হয়েছে এবং হচ্ছে সেই সব বুনিয়াদি ধারনাগুলোকে।
এই ভাবেই আন্তর্জাতিক কর্পোরেট সংস্থাগুলো, নিজেদের তাত্ত্বিকদের দ্বারা এবং তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা নিজেদের অপকর্মকে জন মননে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তাই জনস্বাস্থ্যের এই বুনিয়াদি ধারনাগুলোকে জন মননে প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের কাজ। জনমানুষের দ্বারা রাষ্ট্রকে, কর্পোরেট সংস্থাকে তাদের অপকর্ম গুলো বন্ধ করতে বাধ্য করার আহবান জানানোই আমাদের কাজ।
এই খসড়াটি সম্পর্কে আপনার মতামত পাঠাতে পারেন