সমাজ ব্যবস্থার বা সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব হল সমাজের উৎপাদক শক্তি আর উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেও অর্থনীতির অন্তর্নিহিত মূল দ্বন্দ্ব এটাই থেকে গেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যই এই যে সে নিজেই নিজের সঙ্কট ডেকে আনে কিছু সময় অন্তর। সেই সংকট থেকে মুক্তি পেতে তাকে নতুন কিছু ব্যবস্থা নিতে হয়। কিন্তু সেরকম প্রতিটি ব্যবস্থাই চরিত্রে অস্থায়ী হয় এবং তার পরের সংকটটা ডেকে আনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। অর্থনীতিতে এই সংকট প্রতিভাত হয় অতি উৎপাদনের রূপে, এবং জনজীবনে, উৎপাদিত পণ্যের মালিকানায় বৈষম্যের রূপে।
পুঁজিবাদের এই সমস্যা তার অন্তর্নিহিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। পুঁজিবাদ যতদিন থাকবে ততদিন সে এক সংকট থেকে আরেক সংকটে আবর্তিত হতে থাকবে। এই সংকট থেকে মুক্তির যদি কোনো স্থায়ী উপায় খুঁজতে হয়, তাহলে এক বৈপ্লবিক উপায়ের মধ্যে দিয়েই পুঁজিবাদকে রূপান্তরিত হতে হবে। কিন্তু পুঁজিবাদীরা কখনো তা করেনা। বরং কিছু তাপ্পি দিয়ে নিজেদের ব্যবস্থা মেরামত করতে চায়, এবং ব্যবস্থাটা টিকিয়ে রাখতে চায়।
এই সংকট পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত। কিন্তু সংকটকালে পুঁজিবাদীরা জনমানুষকে আরো শোষন করেই তাদের সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়। যতবার সংকটে পড়ে, ততবার তারা মানুষের ওপর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক আক্রমণ বাড়িয়ে নিয়ে তাদের সংকট থেকে মুক্তি চায়। এই আর্থসামাজিক আক্রমণের ফলে মাঝে মাঝেই, পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের মুখোশটুকুও আর রাখতে পারেনা তারা। স্বৈরতন্ত্রের চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। বিভিন্ন কালে এই স্বৈরতন্ত্রের বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়ে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক স্বৈরতন্ত্রের এক ঐক্যবদ্ধ রূপ আমরা দেখতে পেয়েছি। ঐতিহাসিকভাবে যাকে আজ ফ্যাসীবাদ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
এই সংকট অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীতে হোতো প্রায় প্রতি দশকে। বিংশ শতাব্দীর ১৯৩৯ সাল অবধি এই এরকম চলেছিল। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে আবার গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল, অবশ্য এক বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু এবং সর্বস্বান্ত হওয়ার পরিবর্তে। পুঁজিবাদ ঠিক এরকমই। পুঁজিবাদীরা তাদের সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে জনমানুষের জীবন এবং সম্পত্তির বিনিময়ে। এর পরের ইতিহাস ও এরকমই, তবে কিছুটা পরিবর্তিত। সাম্রাজ্যবাদীরা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে এক একটা রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল এর বাইরে চলে যাবে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় যেমন তৈরী হয়ে গিয়েছিল গোটা একটা "সমাজতান্ত্রিক শিবির"। মুক্ত হয়ে গিয়েছিল কলোনিগুলো। তাই এই সময় থেকেই সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র গুলো, সদ্য স্বাধীন কলোনিগুলোর মালিকেরা দুই ধরনের পদ্ধতি নিয়েছিল পৃথিবীর ওপরে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য।
প্রথমত, তারা "সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র" গুলোর আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা গুলোকে ব্যবহার করে এদের ভেতর থেকে ধ্বংস করার চক্রান্ত শুরু করেছিল। দ্বিতীয়ত নিজেদের দেশে এবং সদ্য স্বাধীন কলোনি গুলোর জন মননে "সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র" গুলোকে এবং "সমাজতান্ত্রিক শিবির" কে জনমানুষের এক সাধারণ শত্রু হিসেবে তুলে ধরার জন্য ঊঠে পড়ে লাগল। শুরু হোলো "ঠান্ডা যুদ্ধ"। এই যে উঠে পড়ে লাগল, এই প্রচেষ্টায় সে এক নতুন বন্ধুকে পাশে পেল। সে হোলো, আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী প্রক্রিয়াতে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্যবাদী গন মাধ্যমকে। ধীরে ধীরে বোঝা গেল যে সাদাকে কালো আর দিন কে রাত বানিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই মাধ্যম, গোয়েবলসীয় ধরনের প্রচারকে শিশু সুলভ দেখায় এদের ক্ষমতার কাছে।
সারা পৃথিবীর মানুষের সাধারণ শ্ত্রু হিসেবে খাড়া করে দেওয়ার কায়দা, সাম্রাজ্যবাদীদের খুবই কাজে লেগেছে। সাম্রাজ্যবাদী গনমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে নিজেদের নানা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এজেন্ডা কাজে পরিণত করে গেছে সাম্রাজ্যবাদীরা। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পরে, এই সাধারণ শত্রু হিসেবে তারা সামনে নিয়ে এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু ইসলামিক রাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্যবাদীদেরই মদতে তৈরী হয়ে ওঠা বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীদের।
কয়েক দশক ধরে চলে এই "সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ"। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের সঙ্কট ফিরে ফিরে আসতে থাকে। আর এর সঙ্গে সঙ্গেই সাম্রাজ্যবাদের কিছু পরিবর্তনও হয়। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা হয়ে ওঠে আন্তর্জাল নির্ভর। ফিনান্স পুঁজির আন্তর্জাতিক এক জালের মধ্যে আটকে পড়ে সারা দুনিয়া। এছাড়াও, ১৯৭০ এর দশক থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন খেলাধুলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদিতে বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশ সাম্রাজ্যবাদীদের দেখিয়ে দিয়েছিল যে তাদের আভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলায় আরো একটা পথ আছে। আমেরিকার বৃহৎ পুঁজি এটা দেখিয়ে দিয়েছিল যে মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে আতংক তৈরী করে তারা তাদের অতি মুনাফার রাস্তা খুলে নিতে পারে। যেমন কিছু অসংক্রামক রোগ যেমন ডায়াবিটিস, হার্টের অসুখ এবং ক্যান্সার এর ক্ষেত্রে। এই সব রোগকে, হঠাৎ করেই, আন্তর্জাতিক গন মাধ্যমের প্রচারের দ্বারা প্রায় মহামারীর পর্য্যায়ে নিয়ে গিয়ে, এদের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ ঘোষণা করে, তারা তাদের অতি মুনাফার আর একটা ক্ষেত্র তৈরী করেছিল। তৈরী হয়েছিল মেডিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স।
একবিংশ শতকের প্রথম দশকে ২০০৮ সালে এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকট যখন দেখা দিল তখন সাম্রাজ্যবাদীদের অবস্থা কেমন ছিল ? আন্তর্জাতিক বৃহৎ ফিনান্স পুঁজির অতি মুনাফার চাহিদায় পুঁজির কেন্দ্রীভবন হয়ে চলেছিল দ্রুতগতিতে। তার রাজনৈতিক রূপ দেখা দিল আন্তর্জাতিক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, এক একবিশ্ব অতিরাষ্ট্রিক ব্যবস্থায়। যে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা দেখা দিল সার্ভেইলান্স পুঁজিবাদের মধ্যে দিয়ে, এই ব্যবস্থার মধ্যে থাকা প্রতিটি মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। রাষ্ট্রগুলোর তৈরী করা ব্যক্তি মানুষের বিভিন্ন পরিচয় পত্র, যা আন্তর্জালের সঙ্গে যুক্ত, এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে।
সাম্রাজ্যবাদী ফিনান্স পুঁজি নিয়ন্ত্রিত এই বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদ, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেখেছিল যে রোগকে ভিত্তি করে মানুষের মনে আতংক তৈরী করা, এবং এই আতংকের দ্বারা তার জীবন যাপন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ডায়াবিটিস, হার্টের অসুখ এবং ক্যান্সারের ক্ষেত্রে তারা এটা দেখেছিল। এটাও তারা বুঝেছিল যে সংক্রমণ এর আতংক দিয়ে মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরী করা সম্ভব। তাই এই শতকের তৃতীয় দশকে পা রেখে আমরা পেলাম, সাম্রাজ্যবাদীদের অতিরাষ্ট্রিক ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমের দ্বারা হাজির করা মানবজাতির নতুন শত্রুকে - সার্স কোভ ২ ভাইরাস আর কোভিড ১৯ রোগ।
কোভিড এর অতিমারী যে কর্পোরেট পুঁজির, সাম্রাজ্যবাদীদের একটি নির্মান, সেটা আজ স্পষ্ট হয়ে গেছে। স্পষ্ট হয়ে গেছে, কারণ গত এক দশকের এ সংক্রান্ত ইতিহাস সামনে চলে এসেছে। কারণ এটাও যে সাম্রাজ্যবাদীদের মুখপাত্র ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এর ডিরেক্টর ক্লস শোয়াব বই প্রকাশ করে ঘোষণা করেছেন যে এই অতিমারী পরিস্থিতি, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ঘটাতে এক বিরাট ভূমিকা নিয়ে চলেছে। কর্পোরেট তাত্ত্বিকদের মুখপাত্র হিসেবে তিনি এটা বেশ গর্বের সঙ্গেই ঘোষণা করেছেন।
সাম্রাজ্যবাদীরা যখন আর একটা শিল্প বিপ্লব ঘটাতে চলেছে, বা ঘটিয়ে চলেছে, সেটা যে বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির (অর্থাৎ বৃহৎ, একচেটিয়া, কর্পোরেট পুঁজির) অতি মুনাফার জন্য ঘটিয়ে চলেছে, তা তো বলাই বাহুল্য। তাতে যে মাঝারী পুঁজি, দেশীয় কো-অপারেটিভ পুঁজি, ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্ষুদ্র পুঁজি ও কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষেরা যে অস্তিত্বের সংকটে পড়বে, সে তো ইতিহাসের শিক্ষা। এবং এরই ফলে যে একচেটিয়া, বৃহৎ, কর্পোরেট পুঁজি এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র, জনমানুষের রোষের মুখে পড়বে, সেকথাও তারা আঁচ করে নিয়েছিল বহু আগেই। কিন্তু শুধু আঁচ করে নিয়ে তো তারা বসে থাকবে না, মানুষের রোষের মুখে যাতে তারা না পড়ে, বা পড়লেও যাতে উদ্ধার পায়, তার পরিকল্পনা যে তারা করে রাখবে, একথা বলাই বাহুল্য।
একথা কর্পোরেট তাত্ত্বিকদের পক্ষে বোঝা খুবই সহজ যে তারা যে বিশ্বজোড়া বিশাল পরিকল্পনা নিয়েছে, গোটা মানবজাতি যার ফলে সংকটে পড়বে এবং বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়বে, সেই পরিকল্পনা গোপন রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। এত বিশাল এক পরিকল্পনা গোপন রাখা সম্ভব হয়না। এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে, ফাঁস যারা করে দেবে তাদের ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক বলার এবং সেই বদনাম দিয়ে তাদের হাস্যাস্পদ করে তোলার রাস্তা তারা করে রেখেছিল তাই আগে থেকেই। যাতে এক দিকে, কর্পোরেট প্রচার মাধ্যমের কোভিড অতিমারীর আতংকের নির্মান আর একইসাথে, এই নির্মান পরিকল্পনা ফাঁস করে দেওয়া মানুষজনকে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক বলে প্রচার, এই দুইয়ের যাঁতাকলে পড়ে, জনমানুষ সত্যটা থেকে দুরেই থেকে যান।
কর্পোরেট তাত্ত্বিকেরা এটাও তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে, যে শিবির থেকে জনমানুষকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠবে, স্বভাবগত ভাবেই সেটা হোলো বামপন্থীদের শিবির। আর এই সুযোগে পৃথিবী ব্যাপী বামপন্থীরা যদি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে তাহলে, আবার পৃথিবী জুড়ে গন জাগরণের ঢেউ উঠে যেতে পারে, সাম্রাজ্যবাদীরা, একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজিবাদীরা যাকে ভয় করে চলে।
এই সম্ভাবনা এড়াতে তাই দুই ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এক, বামপন্থীদের কাছে বিজ্ঞানের দোহাই পেড়ে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির দোহাই পেড়ে এটা বোঝানো যে কত অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে আজকের বিজ্ঞান কোভিডের জিন ভিত্তিক পরীক্ষা, এবং তার টিকা তৈরী করে ফেলতে পারে এবং করেছে। আর দুই, কোভিডের অতিমারীর আতংকের নির্মানের কিছু কিছু তথ্য ওষুধ কর্পোরেট এর সাম্রাজ্য নিজেরাই বের করে দিয়েছিল বিশেষ কিছু ব্যক্তি, বিশেষ কিছু সংগঠনের মাধ্যমে। সেই সব ব্যক্তি এবং সংগঠন শুধু যে বামপন্থীদের বিরোধী তাই নয়, তারা স্বভাবগত ভাবেই বিজ্ঞানের বিরোধী অবস্থান নেয়, প্রযুক্তিমাত্রকেই বর্জনীয় বলে প্রচার করে এবং সামাজিক অবস্থান হিসেবে জনগণের মধ্যে বিভাজনকে মদত দেয়, রাষ্ট্রের জনবিরোধী অবস্থানকে সরাসরি বা বকলমে স্বীকৃতি দেয়, এবং বিভিন্ন স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির অবস্থানকে সরাসরি বা ঘুরিয়ে সমর্থন করে। এই সব তথ্য, এবং অতিমারীর আতংকের নির্মানের কিছু তত্ত্ব, এই সব ব্যক্তি এবং সংগঠনের মাধ্যমে আসার ফলে, বামপন্থীদের মধ্যে দ্বিধা এবং সংশয় তৈরী করতে তারা সফল হয়, ভুল বোঝাতে সক্ষম হয়। ভুল বোঝানোতে এতটাই তারা সফল হয়েছিল যে এক বড় অংশের বামপন্থীরা এখনো বিশ্বাস করে যে কোভিড অতিমারীর আতংকের নির্মানের পরিকল্পনা বলে কিছু নেই, এগুলো পৃথিবী ব্যাপী দক্ষিণপন্থী, স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব।
এক শ্রেণির বামপন্থীদের এই বিচ্যুতি বা বাস্তব বিচ্ছিন্নতা বিনা কারণে বা হঠাৎ করে আসেনি। যে কোনও মতাদর্শেরই সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ থাকে। বিংশ শতকের শেষ ভাগ ও একবিংশ শতকের শুরু - এই সময়কালে সাম্রাজ্যবাদের সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ থেকেছে এমন কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী দর্শন যা শেষ পর্যন্ত আমাদের সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে আমন্ত্রণ জানায়।
আমাদের চেতনার বাইরে বস্তুজগতের অস্তিত্ব আছে এবং এই বস্তুজগৎ আমাদের চেতনায় যে সংবেদন তৈরি করে সেগুলিই আমাদের জ্ঞানের উৎস - এরকম দার্শনিক অবস্থানকে বরাবরের জন্যে ভয় পেয়ে এসেছে সমাজের শাসক ও শোষক শ্রেণিগুলি। শোষকশ্রেণি যেহেতু সমাজের শ্রমজীবী মানুষের তৈরি উদ্বৃত্ত হাতিয়ে নিয়ে তার অস্তিত্ব রক্ষা করে তাই এই শ্রেণির আগ্রহ থাকে বাস্তবকে অস্বীকার করবার এবং করানোর। কিন্তু সমাজ বিকাশের গতির অমোঘ নিয়মে প্রকৃত নিষ্ঠুর বাস্তবতা জনগণের মধ্যে সংবেদন সৃষ্টি করে চলতেই থাকে, আর সেই সংবেদন প্রক্রিয়াতে জনগণের সংগ্রাম জন্ম দেয় সমাজবদলের তত্বের। এই প্রক্রিয়াকে ঠেকিয়ে রাখতে সুদূর অতীত থেকেই শোষক শ্রেণিগুলি জনগণকে বিভ্রান্ত করতে নানান রকম ভাববাদী দর্শনকে নানান রূপে হাজির করে আসছে। বিংশ শতাব্দীতে এই ধরনের যে দর্শনগুলির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে সেগুলিতে চেতনার বাইরে বস্তুজগতের অস্তিত্ব সেভাবে জোরের সাথে অস্বীকার করা হয়নি, কিন্তু যেটা জোর দিয়ে বলতে চাওয়া হয়েছে তা হচ্ছে যে মানুষের জ্ঞান বা তত্বের মধ্যে দিয়ে বাস্তবতা প্রতিফলিত হয় এরকম ভাবার কোনও অর্থ নেই। এই দর্শনগুলির আসল লক্ষ্য হচ্ছে সংগ্রামী মানুষকে সংগ্রাম পরিচালনার তত্ব আয়ত্ত করা ও তাকে বিকশিত করবার পথ থেকে সরিয়ে আনা। বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা তার বিকাশের নিয়মে সারা বিশ্ব জুড়ে এতটাই ধ্বংসের শক্তি হয়ে উঠেছে যে এই ব্যবস্থার রক্ষকদের হাতেও এই শক্তিকে লাগাম দেওয়ার উপায় নেই। এইরকম অবস্থায় সে একদিকে যেমন মদত করে চলেছে সমস্ত ধরনের ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও জীর্ণ মতবাদগুলিকে তেমনি অপরদিকে এমন সব চিন্তাধারাকে সূক্ষ্মভাবে হাজির করতে চেষ্টা করে চলেছে যা কেবলমাত্র জ্ঞানের সাথে বাস্তবের সম্পর্ককে অস্বীকার করেই ক্ষান্ত থাকবে না তা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে কার্যকরী ভূমিকা নেবে।
শেষ কয়েক দশক ধরে এই দর্শনগুলো বামপন্থী চিন্তাজগতে গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করে গণ-আন্দোলনকে জীর্ণ করেছে। সংগ্রাম-বিমুখতা, জন-বিচ্ছিন্নতা, বাস্তব-বিচ্ছিন্নতা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বিলুপ্তি ঘটেছে বস্তুবাদী দর্শনের চোখ দিয়ে ইতিহাসের চলনকে বোঝার। যার ফলস্বরূপ কোভিড আখ্যানকে বিশ্লেষণের প্রক্রিয়ায় হয়েছে ভ্রান্তি। এখনও বহু বামপন্থী চিন্তাবিদ পুঁজির সংকটের সাথে এই আখ্যানের সম্পর্ককে দেখতে, বুঝতে নারাজ। অথচ ইঙ্গিতগুলো বিগত কয়েক বছরের ঘটনায় পরিষ্কার বিদ্যমান। ২০২০ জানুয়ারী মাসেই আমরা এক মহামন্দার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ২০২০র জানুয়ারির প্রথম অর্ধে (অতিমারি/ লকডাউন এর ঠিক আগে) মার্কিন অর্থনীতি ৪.৮% হারে সঙ্কুচিত হচ্ছিল। একই ভাবে জাপানে ৭.১% হারে , ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ৩.৫% হারে সঙ্কোচন হয়। বস্তুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্কোচন শুরু হয় ২০১৯ এর শেষ অর্ধ থেকেই। ২০১৯ এর তিনটি অর্ধ জুড়ে মার্কিন অর্থনীতির ১৯.২% হারে সঙ্কোচন হয়।
এই পরিস্থিতে অভূতপূর্ব ভাবে বিগত দুই বছর গোটা পৃথিবীর মানুষ লকডাউনের নামে গৃহবন্দি। অতিমারির নামে হরণ করা গেছে জীবন, জীবিকার অধিকার, ধ্বংস করা হয়েছে খুচরো বাজার, ক্ষুদ্র অর্থনীতি, সরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা। বিনষ্ট হয়ে গেছে মানুষের সামাজিক জীবন। সুচারু ভাবে তৈরি করা হয়েছে পরস্পরকে সন্দেহের চোখে দেখার, প্যারানইয়ার বাতাবরণ। এই নিউ নর্মালের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের উপর। সংবাদমাধ্যম, নেতা, আমলা, আন্তর্জাতিক সংস্থা যথা WHO, অন্ধের মত পুনরাবৃত্তি করে গেছে দায়হীন World Economic Forum এর তৈরি করা আখ্যানকে। একই সময় ভারতীয় কোটিপতিদের সম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে ৩৫% হারে প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন। বস্তুত সারা পৃথিবী জুড়েই সম্পদের অভূতপূর্ব ঘনীভবন ও তার হাতবদল লক্ষ্য করা গেছে। লকডাউন প্রকৃত প্রস্তাবে বৃহৎ পুঁজির সঙ্কটের দায়কে সাধারণ মানুষের কাঁধে চাপানোর অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছে মাত্র। এমত অবস্থায় কিছু বামপন্থী ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করেছেন বা করবার চেষ্টা করেছেন উদ্ধৃতি, উপদেশবাক্য এবং গুরুবাদ দিয়ে। তাই বিজ্ঞান পরিণত হয়েছে বিশ্বাসে।
কিন্তু এই কঠিন পরিস্থিতি আবার গণ-আন্দোলনের জন্যে তৈরি করেছে অনুকূল পরিবেশ। দুনিয়া জুড়ে এই আখ্যানের বিরুদ্ধে জেগে উঠছে মানুষ। অতিরাষ্ট্রিক ব্যাবস্থার উত্থান নিজেই জায়গা করে দিয়েছে নয়া আন্তর্জাতিকতাবাদের। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে গনসংগঠনের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রের নিষ্ঠুর দমন-পিড়ন জনগণের মধ্যে হতাশারও জন্ম দিতে পারে। তাই আমাদের আশু কর্তব্য হোলো জনগণকে সংগঠিত করা এবং কোভিড আখ্যানের বিপ্রতীপে লড়াই করা। একই সঙ্গে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াও আমাদের উদ্দেশ্য।
এই খসড়াটি সম্পর্কে আপনার মতামত পাঠাতে পারেন