গ্রাফ ওয়েবসাইটে পূর্ব প্রকাশিত 

জনস্বাস্থ্য বহাল রাখতে গিয়ে যেসব পদ্ধতি নেওয়া হয় তাতে উপকারের সঙ্গে ক্ষতির দিকটাও দেখবার কথা। কারণ, শুধু একটা নির্দিষ্ট অসুখ না, জনস্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের দুর্ভাবনা গোটা শরীরটা নিয়ে, গোটা সমাজের স্বাস্থ্য নিয়ে। কোনও কোনও রোগকে আমরা শাসন করে হয়তো কিছুটা বাগে আনতে পারি, আবার অন্যদের সঙ্গে শুধু বোঝাপড়াই চলে, তার বেশি কিছু করতে গেলে হিতে বিপরীত। তাই তাৎক্ষণিক নিয়ম-নীতির চেয়ে দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি বেশি জরুরি। আমাদের কোনও পদক্ষেপের কারণে অসুখের ভার যদি সচ্ছল মানুষজনের থেকে অসচ্ছল, অসহায়দের কাঁধে চলে যায়, তা মর্মান্তিক। এসব অবশ্য নীতি আর আদর্শের কথা।

এমন কথা আরও আছে। যেমন, অতিমারীর সময়ে প্রকৃতির বাছবিচার থাকে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন, “কোভিড’-এর অতিমারীতে বৃদ্ধরাই সবচেয়ে বিপন্ন, বিশেষ করে যাঁরা অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি অসুখে ভোগেন। তাই তাঁদের প্রতি নজর রাখলে, তাঁদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করলে অবাঞ্ছিত মৃত্যুহার কমে। সেকাজ করা যায়নি। কারণ দেখা গেল, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া জনস্বাস্থ্য রক্ষার পরিকাঠামো বা অবকাঠামো প্রায় সর্বত্রই ভঙ্গুরপ্রায়। তার বদলে অতিমারী নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব পদ্ধতির উপর জোর দেওয়া হল সেগুলো যে সাধারণ শ্বাসতন্ত্রীয় ভাইরাস সংক্রমণের বেলায় অকেজো আর সেকেলে সেকথা সাম্প্রতিকতম ডাক্তারি পাঠ্য বইতেই বলা আছে।

যিনি অসুস্থ তাঁর রোগনির্ণয় অতি জরুরি; কিন্তু যিনি আপাতসুস্থ এবং উপসর্গহীন তাঁর উপর রোগনির্ণয়ের পরীক্ষা চালানো জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে ক্ষতিকর। জনস্বাস্থ্য দাঁড়িয়ে থাকে বিশ্বাস আর আস্থার উপর -- সরকার, প্রশাসন আর চিকিৎসকদের উপর জনমানুষের ভরসা। জামার হাতা গুটিয়ে, দুনিয়াকে “কোভিড-শূন্য” করার জন্য যুদ্ধের স্লোগান দিলে, এর-তার উপর দোষ চাপিয়ে আর কথায়-বার্তায় আচরণে আতংক সৃষ্টি করলে সেই আস্থা আর থাকতে চায় না। প্রথমেই জনমানুষকে নির্বোধ, অশালীন, অপরিণত আর বিশৃঙ্খল ধরে নিলে “হাতে বন্দুক পায়ে বন্দুক” ছাড়া আর রইলটা কী! তার চেয়েও বড় কথা, জনস্বাস্থ্য রক্ষার গুরুদায়িত্ব যাঁদের কাঁধে তাঁদের সামনে আমাদের প্রথম দাবিটার নাম, সততা; এই উপাদানটি আপাতত যেন নিরুদ্দেশ।

আর তার চেয়েও বেশি জরুরি হল, সুস্থ, সভ্য বিতর্ক। “চোপ, জরুরি অবস্থা চলছে, বিভ্রান্তি ছড়াবেন না”, এই কথা বললে আস্থা কমে, বাড়ে না। কারণ, আজকের যুগে বিপুল, বিচিত্র তথ্য যখন আমাদের হাতের মুঠোয়, মেধা যখন কেবল কয়েকজন বিজ্ঞানী বা ডাক্তার বা গবেষকদের দখলে নেই, তখন জীবনমরণ নিয়ে প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তাই ধমক দিয়ে কাজ হবে না। তার চেয়ে ভাল, সুরক্ষিত গৃহকোণে কম্পিউটারের সামনে বসে না-থেকে জনমানুষের দুয়ারে যাওয়া, প্রতিদিন। তাঁরা কেমনভাবে, কী চান, জীবিকার সুসংস্থান কীভাবে হবে, কীভাবে রোগের সঙ্গে বোঝাপড়া করা যাবে, এই রহস্যের হদিশ তাঁদের কাছেই আছে।

ঠিক এইভাবে না-বললেও, উপরের কথাগুলো এসেছে “আমেরিকান ইন্সটিটিউট ফর ইকনমিক রিসার্চ” নামে একটি প্রখ্যাত সংস্থার কাছ থেকে, লেখক ডাক্তার মার্টিন কুলডর্ফ। তিনি জানিয়েছেন, “কোভিড” অতিমারীর অবসরে আমরা জনস্বাস্থ্যের নীতি আর আদর্শগুলো বিসর্জন দিয়েছি। অন্য অনেক স্থিতধী মানুষও বলেছেন, “এভাবে নয়, এভাবে ঠিক হয় না”। যদি কেউ বলেন, “কীভাবে হয়? কেমন করে হয়? কেমন করে ফুলের কাছে রয় গন্ধ আর বাতাস দুই জনে...”, সে-প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে অনুশীলনে। দশ হাজার বছর ধরে সেই অনুশীলনের অভিজ্ঞতা আছে জনমানুষের ঝুলিতে; তার সারাংশই আমরা ভুলতে বসেছি। তাই রোগের চরিত্র, মতিগতি, নির্ণয়কাণ্ড, প্রতিষেধক আর চিকিৎসা নিয়ে হাহাকার আর থামতে চায় না।

এই হাহাকারের মধ্যে কি নিষ্প্রশ্ন থাকাই উচিত? এই সংকটে কি একথা বলা উচিত হবে যে, “ইমিউনিটি” ব্যাপারটা ধারাপাতের মতো অত সরল কিছু না, বরং অতি জটিল এক শাস্ত্র? এই ঘোর অমাবস্যায় ডাক্তাররা কী করবেন? যথেষ্ট তথ্য আর যুক্তির জন্য অপেক্ষা না-করে তাঁরা কি খড়কুটো ধরেও বাঁচবার, বাঁচাবার দিকেই নজর দেবেন? নাকি, গবেষণার গুণমান, ওষুধের কার্যকারিতা, টিকার চরিত্র আর নিরাপত্তা, এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন? তা নিয়ে কিছুকাল আগে “ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল”-এ তর্কসভা বসেছিল। তাতে এক পক্ষ বললেন, স্বাভাবিক সময়কালে ডাক্তাররা নতুন গবেষণাপত্র, ওষুধপত্র বা তথ্যপ্রমাণ নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক থাকেন, ভাল কথা। কিন্তু এখন চলছে এমন এক অতিমারী যার জন্য আমরা কেউই তৈরি ছিলাম না।

তাই এখন, এই অদ্ভুত বিপর্যয়ের মুখে আর যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ, স্বচ্ছতা, যুক্তি ইত্যাদির জন্য অপেক্ষা করা চলে না; এমনকী, আপাতত কিছু তথ্য গোপন থাকলেও তেমন ক্ষতি নেই। বরং “শর্টকাট” হলেও, মৃত্যুর স্রোত রোধ করাই ডাক্তারদের কর্তব্য; বাকি প্রশ্নগুলো ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখা উচিত। কিন্তু প্রতিপক্ষ বললেন, অতিমারীর ইতিহাস নতুন না, তাই আমাদের অভিজ্ঞতাও কম না। আমরা সেই ওষুধ আর সেই চিকিৎসার উপরেই ভরসা রাখি যার পিছনে স্বচ্ছতা আছে, তথ্যপ্রমাণের খুঁটিও মজবুত। কোনও সংকটের অজুহাতে তথ্যের গোপনীয়তা মেনে নিলে এবং অস্বচ্ছ আর দুর্বল তথ্যপ্রমাণের উপর দাঁড়াবার চেষ্টা করলে ভবিষ্যতে বিপদের আশংকা বরং আরও বাড়ে। তাই ওই পথ ঠিক না।

বিপদ দুই প্রকার। প্রথম বিপদ, সংকটের সুযোগ নিয়ে যেকোনও ওষুধকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অতি-উপকারী বলে দেখানো, আর দ্বিতীয় বিপদ, ওষুধের কুফলগুলোকে প্রায় ধামাচাপা দেওয়া। কোম্পানিগুলো এসব ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত; তার ইতিহাস অঢেল। তাই তথ্যের স্বচ্ছতা অপরিহার্য; অতিমারীতে এমন কিছু ঘটে যায়নি যে সেই স্বচ্ছতা পরিহার করা যায়; বরং স্বচ্ছতাই আস্থা বাড়ায়, বিজ্ঞানকর্মের প্রতি ভরসা বাড়ায়। ভরসার উপরেই জনস্বাস্থ্যের বিচরণ, নইলে তো পুলিশ-মিলিটারিই যথেষ্ট ছিল। তাই তথ্য “থাকলে ভাল” তবে “না-থাকলেও তেমন ক্ষতি নেই”, এই যুক্তি মেনে নেওয়া যায় না। এই রন্ধ্রপথ খুলে দিলে পরিণতি ভয়ংকর। বরং জনমানুষের সামনে চিকিৎসার যুক্তি, প্রতিযুক্তি, সুফল আর কুফল নিয়ে খোলামেলা থাকতেই হবে। তাঁরা আকাট, নাবালক না, নিজের জীবনের দাম তাঁরা যথেষ্ট বোঝেন।

তার মানে, তর্ক চলছে – বিজ্ঞান সভায় যেমন, জনমনেও তেমনই। অথচ আজকাল অনেকে প্রশ্ন তুললেই রাজনীতির গন্ধ পান। তাঁরা ভেবে দেখেন না যে, গন্ধের দোষ নেই, জনস্বাস্থ্য তো রাজনীতিরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সর্বদেশে, সর্বকালে। অতিমারীর আলোচনায় “নিউ নর্মাল” বা “কর্পোরেট” ব্যবস্থার কথা উঠলে অনেকে বিরক্ত হন, চমকে ওঠেন। অথচ এমন ইঙ্গিত তো আমাদের রাষ্ট্রের “নতুন” শিক্ষানীতিতেই স্পষ্ট ভাষায় বাঙ্ময় হয়ে আছে। যে-কেউ তা পড়ে দেখতে পারেন। সেখানে অতিমারীর কথা এসেছে একাধিকবার। আমরা যে শিল্প সভ্যতার “চতুর্থ” যুগে প্রবেশ করেছি, সেকথাও গোপন থাকেনি; তার মানেই তো “ডিজিটাল” যুগে প্রবেশের ছক! যেকোনও রাষ্ট্রের একটা পরিকল্পনা থাকেই, একটা ছক, সেটা অবাঞ্ছিত না। যা অবাঞ্ছিত তা হল, জবরদস্তি আর মিথ্যাচার।

হিটলারের হাতেও ছক ছিল, স্তালিনের হাতেও। কিন্তু ছক তো বেদবাক্য না। তাই চলতে-চলতে ন্যায্য প্রশ্ন তোলাও দরকার, “আস্কিং, উই ওয়াক”। আজকের বিপর্যয় যে আমরা অতিক্রম করব সেকথা সত্যি। কিন্তু, অমন সত্যি কথা আরও আছে যা ভুলে যাওয়া অন্যায়। যেমন, “কোনও হুমকির সামনেও, আমি আমার ডাক্তারি বিদ্যাকে এমনভাবে ব্যবহার করব না যাতে নাগরিক স্বাধীনতা আর জনমানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হয়” – ডাক্তারদের এই অঙ্গীকার। তাই অতিমারীর ঝঞ্ঝার মধ্যে গণ টিকাকরণ কতটা যুক্তিগ্রাহ্য, “লকডাউন” কার সর্বনাশ ডেকে আনে, তার কার পৌষ মাস, এই প্রশ্ন ন্যায্য। অতিমারী কি প্রকৃতির স্বাভাবিক সৃষ্টি, না কোনও গবেষণাগারের কৃত্রিম নির্মাণ, “কোভিড”-এ ভোগান্তি আর মৃত্যুর চেয়ে অনাহারের বিপন্নতা আর মৃত্যু মহীয়ান কিনা, এসব কথা তুলতেই হবে।

এই সমাজ জঙ্গিবাদী না, গণতান্ত্রিক। সেকথা সরকার, তার আদরণীয়, অপদার্থ পরামর্শদাতারা আর কোনও কোনও সুনাগরিক ভুলিয়ে দিতে চাইলেও আমরা ভুলতে যাব কেন? আমরা প্রশ্ন করে যাবই, সকলকে – ক্ষমতাকে আর নিজের বিবেককেও।


===============================================


(১৭-ই মে, ২০২১-এ দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের পরিমার্জিত রূপ)

লেখক সম্পর্কে

GRAPH_AVATAR_IMG
ডা. স্থবির দাশগুপ্তলেখক পেশায় ক্যান্সার চিকিৎসক।কলকাতায় থাকেন।