গ্রাফ ওয়েবসাইটে পূর্ব প্রকাশিত
(প্রথম কিস্তি)
নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বেরোচ্ছেন না। বেরোলেও অনেকে দুটো মাস্ক পরে বেরোচ্ছেন। অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে চাইছেন না। চেম্বারে ডাক্তারবাবু সাড়ে তিনমিটার দূরত্ব রেখে মুখে মাস্ক, ফেসশিল্ড পরে, মাথায় সার্জিক্যাল ক্যাপ লাগিয়ে রোগী দেখছেন। সেমিনার নয়, এখন ওয়েবিনার হয়।
সব কেনাকাটা অনলাইনে। শুধু অনলাইনেই টাকা লেনদেন (এটিএম নয়) এখন রোজ ১০ কোটি হয়, যা মাত্র চারবছরে ৫ গুণ বেড়ে গেছে। টিভির ৭০% সময় শুধু করোনার বীভৎসতা। রোজ কত আক্রান্ত, কত মৃত্যুর হিসেব। কিন্তু হিসেব দেওয়ার মুনশিয়ানা হল, দেড়বছরের মোট আক্রান্ত এবং মোট মৃত্যুর সংখ্যা বলা, নিয়মিত। সেই সংখ্যাটা কোটিতে হয়। রোজ খবরের কাগজ খুলেই বা টিভি খুলেই কোটি মৃত্যুর হিসেব শুনলে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবেই। মিলেনিয়াম জেনারেশনের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় থিম, ‘হরর’। সিনেমা, ওটিটি সবজায়গায় হররের ছড়াছড়ি। কিন্তু সব হররকে পিছনে ফেলে দিয়েছে কোভিড-রিয়্যাল-লাইফ হরর। শ্মশানে মৃতদেহের লাইন, গঙ্গায় শব ভেসে আসছে। শুধু আতঙ্কেই আপন কন্যাকে গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাবা আত্মহত্যা করছে। মৃত্যুর খবর মানেই, কোভিডে মৃত্যু। সুইসাইড হলেও বলতে হবে, কোভিডে মৃত্যু; রোড অ্যাক্সিডেন্টও তাই। জনমানব শূন্য রাস্তায় হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গিয়ে ফোন করে বাড়ির লোককে ডাকতে গিয়ে কানে ফোন নিয়ে দেড়মিনিট ধরে করোনা সতর্কতার বিজ্ঞাপণ শুনতে হচ্ছে। ততক্ষণ রক্তপাত অব্যাহত। সারা পৃথিবী কোভিড আতঙ্কে থরহরি কম্প, কেউ কেউ ভাবছেন, মানব সভ্যতা হয়তো তার শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেই গেল। সেই ‘ডুমসডে’ কিম্বা ‘অ্যাপোক্যালিপস’। কলিযুগের শেষ হবার কথা কল্কি অবতারের হাতে। কল্কিই কি করোনা?
কোভিড-১৯ যে সত্যিই এক ভয়াবহ সুনামী তা নিয়ে আর মানুষের মনে কোনও দ্বিধা নেই। তাহলে বাঁচার উপায়? একসময় জেনেছিলাম, রাতে নির্দিষ্ট সময়ে থালাবাটি বাজালেই করোনা শেষ হবে। হতেও পারে। লক্ষ লক্ষ ঘটি-বাটি-থালা বাজলে যে আল্ট্রাসাউণ্ড তৈরি হবে তা করোনা হয়তো সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু হল না। রাতের বেলা নির্দিষ্ট সময়ে আলো নিভিয়েও করোনা ভাইরাসকে পথভ্রষ্ট করা গেল না। এল লকডাউন। একটানা কার্ফু। ২৪ ঘন্টা ভারতবন্ধ জানি, কিন্তু দিনের পর দিন বন্ধ-এর অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। শুরুতে বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, এপিডেমোলজিস্টরা টিভিতে এসে মাথায় সার্জিক্যাল ক্যাপ পরে ওঁ বলার মত মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন “মাস্ক মাস্ক মাস্ক”। কয়েকটা সংস্থা রাতারাতি পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে গেল। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা ‘হু’, আইসিএমআর, সরকারের স্বাস্থ্যদপ্তর। শুরু হয়ে গেল চিকিৎসার প্রোটোকল। প্রোটোকল মানে? বোঝাপড়া। যেমন বিদেশের রাষ্ট্রপতি এলে এদেশের রাষ্ট্রপতিকেই বিমানবন্দরে যেতে হয়। কে বা কারা প্রোটোকল তৈরি করছেন? ওই হু কিম্বা আইসিএমআর। যদি প্রোটোকলেই কোভিড সেরে যায় তাহলে ডাক্তারের কী প্রয়োজন? ঘরে ঘরে অক্সিমিটার, পকেটে পকেটে স্যানিটাইজার। নিত্য নতুন প্রোটোকল আসছে। আগের প্রোটোকল বদলে দিয়ে নতুন প্রোটোকল। স্বাভাবিক।
কোভিড-১৯ একেবারেই নতুন এক বিভীষিকা। জুরাসিক পার্কের সেই ডাইনোসরকে মনে আছে? সিনেমার গল্প। একটা থিম পার্ক। সেখানে ছয়কোটি বছর আগের এক বিলুপ্ত প্রাণীকে জেনেটিক্যালি ম্যানুফ্যাকচার করা হয়েছে। ট্যুরিস্টরা এসে এনজয় করছে। হঠাৎ সেই প্রাণী খাঁচা ভেঙ্গে মুক্তি পেয়ে সবাইকে তাড়া করে একেবারে শহরে এসে হাজির। সব ভেঙ্গে চূড়ে তছনছ করে ফেলছে। ঠিক তেমনই ইনিভিজিবল কোটি কোটি, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন, জিলিয়ন ভাইরাস, যার নাম সার্স কোভ-২, এসে মানবসমাজকেই শেষ করে ফেলার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। জুরাসিক পার্ক যেমন গল্প, আমরা দেখব “গল্প হলেও সত্যি” কেমন করে হয়।
তো এই অবস্থায় বাঁচার উপায়? শুধু মাস্ক, লকডাউনে হবে না। ভ্যাক্সিন চাই। ভ্যাক্সিনের এফিকেসি পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করার সময় নেই। সাত-আট বছর অপেক্ষা করলে আর ভ্যাক্সিন নেবার কেউ বেঁচেই থাকবে না। তাই একমাত্র উপায় ‘ক্লিনিক্যালি টেস্টেড অ্যান্ড ওকে’ হবার অপেক্ষায় না থেকে সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে দ্রুত ভ্যাক্সিনেট করে ফেলা। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও হবে, টেস্টও হবে, আবার ট্রিটমেন্টও হবে? মানে ইঁদুর নয়, সরাসরি মানুষের ওপরেই পরীক্ষা? আপাতভাবে অদ্ভুত মনে হলেও এটাই একমাত্র উপায় -- হু, আইসিএমআর এবং আরও বিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা কোরাসে বলে চলেছেন। একে বলে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট। প্রায় আটশ কোটি মানুষকে টিকা দিতে হবে। জয়টিকা। করোনা জয়ের টিকা। সেখানেও বিপত্তি। প্রথম ঢেউয়ের পর এল দ্বিতীয় ঢেউ, আরও মারাত্মক চেহারা নিয়ে। শোনা যাচ্ছে তৃতীয় ঢেউও আসছে। আপাতত আন্দাজ আরও চার-পাঁচ বছর এমনই ঢেউয়ের পর ঢেউ আসবে। করোনা বহুরুপী কিম্বা গিরিগিটি। মুহুর্মুহু চেহারা বদলায়। আগের ভ্যাক্সিন নাকি আর তেমন কাজ করছে না। অতএব আবার নতুন টিকার সন্ধান করতে হচ্ছে। হয়তো এমন হবে, একেবারে নিয়মিত দুর্গাপুজা, বড়দিন, ইদুজ্জোহার মত বাৎসরিক টিকা-উৎসব চলতে থাকবে। সবই মানুষের কল্যাণে। নানা ভাষা, নানা মতের মধ্যেও একমাত্র মিলন-গাথা এই করোনা। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রপ্রধান, রাজনৈতিক দল, ডাক্তার, বুদ্ধিজীবী, মার্ক্সবাদি, গান্ধীবাদি, হিন্দুত্ববাদী, গণতন্ত্রী, রিপাকলিকান সবাই একসুরে বলছে মাস্ক, লকডাউন, ভ্যাক্সিন, লকডাউন, মাস্ক। না হলে আপনার বিপদ, আপনিও বিপদ।
ব্যতিক্রম নিয়মের প্রমাণ। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম আছে। কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, এই ভীতি অমূলক। এই আতঙ্ক নাকি ম্যানুফ্যাকচার্ড। চোমস্কির ভাষা ধার করে বলা যায়, ইদানিংকালের সবচেয়ে সফল কনসেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং।
এদেরকে কি বলা যায়? এরা চক্রান্ত তত্ত্বের ফেরিওয়ালা। এরা সবকিছুর মধ্যে ষড়যন্ত্র দেখতে পায়। মাস্কের আড়ালে চক্রান্ত, লকডাউন চক্রান্ত, ভ্যাক্সিন তো মারাত্মক চক্রান্ত। যেখানে হু ঘোষণা করে দিয়েছে কোভিড-১৯ প্যানডেমিক, সেখানে “এ এমন কিছু নয়, ব্যাড টাইপ অফ ফ্লু কিন্তু মৃত্যুহার নগণ্য”, বলে গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। “প্যানডেমিক” শব্দটার মধ্যে আছে প্যান, মানে গোটা, সবটা। ডেমিক শব্দটার আড়ালে আছে ডিমাইজ অর্থাৎ মৃত্যু। এবার দেখুন হু-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ২০০৯ সালে প্যানডেমিকের সংজ্ঞা নাকি বদলে দিয়েছিল। ২০০৩ সালে হু’র প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস-এর পাতায় বলা ছিল “An influenza pandemic occurs when a new influenza virus appears against which the human population has no immunity, resulting in several simultaneous epidemics worldwide with enormous numbers of deaths and illness.” আর দুহাজার নয় সালে সিএনএন-এর এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে যে সংজ্ঞা জানানো হল, তাতে ““enormous numbers of deaths and illness” কথাগুলো বাদ চলে গেল। প্যানডেমিক হবার জন্য প্রচুর অসুস্থতা আর মৃত্যুর প্রয়োজন থাকল না। প্যানডেমিকের ডেমিক অর্থাৎ ডিমাইজটা বাদ চলে গেল। প্যানডেমিক ঘোষণা করে দেওয়াটা সহজ হয়ে গেল। (সূত্রঃ ncbi.nlm.gov/pmc/article).
আসুন, এবার আমরা ‘মেইন্সট্রিম’ পত্রিকায় ৪ জুন, ২০২১-এ প্রকাশিত কোবাড ঘান্দির লেখা Origins of Corona and the Conspiracy Theorists-তে কী বলা হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করি।
(এই রচনাটি জুন ৫, ২০২১-এ ‘মেইনস্ট্রিম’ পত্রিকায় প্রকাশিত, কোবাড ঘান্দির প্রবন্ধ, ‘Origins of Corona and the Conspiracy Theorists’ -এর অনুসরণে লিখিত)
(ক্রমশঃ)