আমাদের রোজকার খাদ্যাভ্যাসের এক অপরিহার্য উপকরণ নুন বা লবণ। লবণকে ঘিরে নানান মিথ এবং বাস্তব আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন ডাঃ ভাস্কর চক্রবর্তী।

 

রোগী এলেন ডাক্তারের চেম্বারে। মাথা ঘুরছে, ঘাড়ে মাথায় টিপ টিপ ব্যথা করছে মাঝে মাঝেই, বেশ কয়েকমাস ধরে। হাটতে গিয়ে মাঝে মাঝে টাল খেয়ে যাচ্ছেন। মধ্যবয়সী। ধূমপায়ী। বিগত পঁচিশ বছর ধরেই ধূমপায়ী। ডাক্তারবাবু রোগের ইতিহাস লিখলেন, রোগীর জীবনের কিছু ইতিহাস লিখলেন, ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা করলেন। দেখা গেল রক্তচাপ বেশ বেশী। ডাক্তারবাবু কিছু পরীক্ষা করাতে লিখলেন, কিছু ওষুধ লিখে দিলেন, এক সপ্তাহ পরে আবার ফিরে আসার কথা বলে দিলেন। আর বললেন ধূমপান বন্ধ করতে, নুন খাওয়া কমাতে। মানে খাওয়ার পাতে নুন খাওয়া একদম বন্ধ করতে বললেন।

ডাক্তারের পরামর্শে রোগী খুশী; পরিবার খুশী; যে স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে রোগী এর পরে রক্তচাপ পরীক্ষা করাবেন, তিনি খুশী; যে পাঠকেরা এতদূর পড়লেন, তাঁরাও খুশী। যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসা হয়েছে। ওষুধ দেওয়া হয়েছে, কিছু পরীক্ষা করতে বলা হয়েছে, আর জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমেও চিকিৎসা করার কথা বলা হয়েছে।

কিন্তু আমি খুশী হতে পারলাম কই ? কেন পারলাম না? এই ক্ষেত্রে খুশী হওয়া বা না হওয়া নিয়ে কিছু বলার আগে একটু ভণিতা করে নেওয়া দরকার। একটু ভূমিকা আর কি।

 

প্রতিটা চিকিৎসা পদ্ধতিরই কিছু কিছু দার্শনিক ভিত্তি আছে। মানে সেই সব পদ্ধতি কিছু জীবনদর্শনের দ্বারা চালিত হয়। প্রাচীন সভ্যতার চিকিৎসা পদ্ধতির দর্শন নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখা এখনো হয়ে ওঠেনি। তবে যে চিকিৎসা পদ্ধতি শিখে আমি চিকিৎসক হিসেবে সরকারের কাছে লাইসেন্স পেয়েছি, মানুষের চিকিৎসা করার, সেই পদ্ধতির দর্শন সম্পর্কে কিছু ব্যবহারিক জ্ঞান তো হয়েইছে। অর্থাৎ আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি। এই 'আধুনিক' চিকিৎসা পদ্ধতির অধুনা কিছু কিছু দর্শন সম্পর্কে আমার চোখ খুলেছে - যেমন ল্যাবোরেটরীতেই মানুষের যাবতীয় রোগ নির্নয় করা যায় এবং করা উচিত, সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে নয়; যেমন প্রতিটা রোগের এবং প্রতিটা উপসর্গের এক একটা ওষুধ আছে, এবং সেই ওষুধও ল্যাবোরেটরীতে না বানানো হলে সেটা কোনো ওষুধই নয়। প্রকৃতিতে পাওয়া যায় এমন কিছু উপাদান (গাছ, গাছড়া থেকে আহরিত) দিয়ে যদি কোনো রোগ বা উপসর্গের চিকিৎসা করা যায়, যে প্রাকৃতিক উপাদান মানব শরীর সহ্য করতে পারে বেশী, তাহলেও তাকে বলা হবে হাতুড়ে চিকিৎসা, আর সেই প্রাকৃতিক উপাদান থেকে ল্যাবোরেটরীতে তৈরী কোনো কৃত্রিম পদার্থ দিয়ে চিকিৎসা করলে সেটা হবে আধুনিক, যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসা। উদাহরণ অনেক আছে, তবে এখন আমাদের আলোচ্য বিষয় এটা নয় বলে, আর এর মধ্যে ঢুকলাম না।

এই পদ্ধতির আরেকটা দর্শন হোলো এই যে, বৈজ্ঞানিক, ল্যাবোরেটরীতেই জ্ঞান আহরণ করবেন, সেই জ্ঞান বিতরণ করবেন চিকিৎসকদের কাছে, বিনামূল্যে বা মূল্যের বিনিময়ে, এবং চিকিৎসকেরা সেই জ্ঞান প্রয়োগ করেই দ্বায়িত্ব সারবেন, বিনামূল্যে বা মূল্যের বিনিময়ে। অর্থাৎ জ্ঞান আহরণ করবেন কিছু বিশেষজ্ঞ, তাঁরা বা তাঁদের দ্বারা পরিচালিত কোনো সংস্থা সেই জ্ঞানের আধার হবে, সেই জ্ঞান এর অধিকার থাকবে বিশেষ সংস্থা, বিশেষ ব্যক্তি বা বিশেষ শ্রেনীর কাছে। সেই জ্ঞান প্রযুক্ত হবে সেই বিশেষ সংস্থা, ব্যাক্তি বা শ্রেনীর মর্জিমাফিক। এই জ্ঞানের ক্ষেত্রে জন মানুষের ভূমিকা হোলো শুধু অনুসরণ করে চলা এবং প্রয়োগ পদ্ধতিতে নিজেদের ল্যাবোরেটরীর পশু বানানো। গিনিপিগ। এই বিশেষ শ্রেনী অবশ্যই শাসক শ্রেনী (বা হয়ত তারও একটা ক্ষুদ্র অংশ), বিশেষ সংস্থা গুলো হোলো সব কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত গবেষণা সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদি, বা রাষ্ট্রেরও ওপর খবরদারী করে যে সব সংস্থাগুলো, যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসঙ্ঘ, ইত্যাদি (অর্থাৎ অতিরাষ্ট্রিক সংস্থাগুলো) । জনমানুষ, এই দর্শন অনুযায়ী, আজ্ঞাবহ দাস এবং গিনিপিগ, এবং এ ভিন্ন অন্য কোনো স্বর তার মধ্যে থেকে উঠে আসলেই বলা হবে যে সে স্বর দেশ বিরোধী, চক্রান্তকারী, আতঙ্কবাদী, মাওবাদী, ইত্যাদি।

এই ধরনের জ্ঞানের প্রয়োগের অত্যাচার আমরা কিছুদিন আগেই দেখেছি কোভিড ধোকামারীর সময়ে। কিন্তু, এই অত্যাচার হঠাৎ একদিনে আকাশ থেকে খসে পড়েছে, তা নয়। এই অত্যাচার চালানোর জন্য কর্পোরেট এবং অতিরাষ্ট্রিক সংস্থা গুলোর দীর্ঘ প্রস্তুতি লেগেছে। অনেক সামাজিক পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। জন মানুষ যাতে বিদ্রোহ না করে, তার জন্য তাকে দিয়ে এর আগে থেকে অনেক কিছুই সইয়ে নিতে হয়েছে। মানুষকে ধীরে ধীরে ঘিরে ধরতে ধরতে, কোণঠাসা করতে করতে, হঠাৎ একদিন ধোকামারীর অজুহাতে হয়ে গেল লকডাউন।

যে যে সহনীয় কর্পোরেট মিথ্যার মধ্যে দিয়ে জন মানুষকে যেতে হয়েছে তারই একটা নিয়ে আলোচনা করতে বসে এত কথার অবতারণা করলাম। কিন্তু সেই কথায় ঢোকার আগে, ভূমিকাটা সম্পূর্ণ করে নিই। জ্ঞান আহরণ এবং তার প্রয়োগ সম্পর্কে মাও সে তুং এর বক্তব্য ছিল এই কর্পোরেট দর্শনের ঠিক উলটো। এই মত অনুযায়ী, জনমানুষ এবং এই পৃথিবী থেকেই সব জ্ঞান আহরণ করতে হয় এবং সেই জ্ঞান প্রয়োগ করে পরীক্ষাও করতে হয় মানব সমাজে এবং প্রকৃতিতে। সেই পরীক্ষার ভিত্তিতেই নির্ধারন হয় সেই জ্ঞান এর গুনাগুণ, সত্যাসত্য। সেই জ্ঞান এই পরীক্ষার ভিত্তিতে পরিবর্তিত হয়ে আবার নতুন জ্ঞান এর উদ্ভব হয়। এই ভাবেই চলতে থাকে জ্ঞান আহরণ। ফ্রম দ্য পিপল, এ্যান্ড টু দ্য পিপল। এই দর্শনে বলে যে আসলে এই পদ্ধতিতে প্রকৃতি এবং জনমানুষ কখনোই নিষ্ক্রিয় থাকে না। বরং একটা সক্রিয় ভূমিকাই নেয়। সুতরাং সব জ্ঞানই আসলে আসে প্রকৃতি এবং মানব সমাজ থেকে। সেই জ্ঞান সূত্রায়িত করার কাজে বিশেষজ্ঞদের একটা ভূমিকা থাকে মাত্র, এর বেশী কিছু নয়।

 

এবারে আবার ফেরা যাক সেই রোগীর কথায়। তিনি তো ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রিপশনে মতো সব কিছু করতে লাগলেন। রক্তচাপ কিছুটা কমল কিন্তু ডাক্তারবাবু বললেন আরো কমাতে হবে, সঠিক স্তরে আসেনি। ওষুধ আরো বাড়ল। ধূমপান তিনি কমিয়েছেন, ছাড়েননি। পাতে নুন খাওয়া কমিয়েছেন, ছাড়েননি। এবার ডাক্তারবাবুর ধমকে তিনি কষ্ট করে ধূমপান করা ছাড়লেন। পাতে নুন খাওয়া ছাড়লেন। পরিবার এবং পড়শী শুভানুধ্যায়ীদের চাপে পড়ে রান্নাতেও নুন দেওয়া একেবারেই কমিয়ে দেওয়া হোলো। ওনার জন্য এখন প্রায় আলাদা রান্না হয়। বাইরের কিচ্ছু খান না।

এভাবে চলল প্রায় বছর দশেক। পাঁচ বছর আগে তিনি রিটায়ার করেছেন। শরীর আগের মতো চাঙ্গা আর কখনোই হয়নি, কিন্তু রক্তচাপ ঠিক স্তরে আছে বলে ডাক্তারবাবু আশ্বস্ত করেছেন। শরীর যে আগের মতো ভালো আর থাকবে না, সেটা তিনি মেনে নিয়েছেন, কারণ ডাক্তারবাবু বলেছেন, যে বয়সকালে কি আর শরীর যৌবনের মতো চাঙ্গা থাকে?

একদিন তিনি হঠাৎ বাড়িতে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে হাসপাতালের এমারজেন্সিতে ভর্তি হলেন। সেখান থেকে একজন নিউরোলজিস্ট এর অধীনে ভর্তি, একই হাসপাতালে, ব্রেন এ দেখা গেল স্ট্রোক হয়েছে। তাঁর সঙ্গে রক্তে সোডিয়াম এর স্তর খুব কম। চেতনা নেই। ভেন্টিলেশন, সেন্ট্রাল লাইন, হাসপাতালে হওয়া ইনফেকশন, গুচ্ছের এ্যান্টিবায়োটিক এবং অন্যান্য ওষুধ, ফিজিওথেরাপী ইত্যাদি কষ্টসাপেক্ষ এবং ব্যায়বহুল চিকিৎসা শেষে তিনি এখন বাড়িতে, শরীরের বাঁদিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত। রোজ ফিজিওথেরাপী চলে। কিন্তু উন্নতি সামান্যই।

 

এতদূর পড়ে পাঠক নিশ্চই বুঝেছেন যে উক্ত রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসার কোনো একটা বিষয়ের দিকে আমি ইঙ্গিত করতে চাইছি। যে কারণে ওই রোগীর আজ এই দশা। হ্যাঁ, তবে, একটা নয়, দুটো।

এক, রক্তচাপ মানুষের শরীরের চাহিদা এবং সহ্য ক্ষমতা অনুযায়ী না কমিয়ে যদি বৈজ্ঞানিক বা চিকিৎসক সমিতির ঠিক করে দেওয়া স্তর অনুযায়ী কমানো হয়, তাহলে কখনো সেই রক্তচাপ অতিরিক্ত কম হয়ে যেতে পারে, তার ফলাফল হতে পারে মস্তিষ্কে রক্তচাপ কমে যাওয়া, রক্ত সংবহন কমে যাওয়া, এবং মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমে যাওয়া। তার ফলে স্ট্রোক।

দুই, দীর্ঘদিন নুন কম খাওয়া বা না খাওয়ার ফলে, গরমের দেশে শরীরের ঘামের মাধ্যমে জল এবং সোডিয়াম বেশী পরিমাণে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে, এবং রক্তচাপ কমানোর জন্য ব্যবহৃত ওষুধের কারণে রক্তে সোডিয়াম এর স্তর মারাত্মক রকম কমে যেতে পারে এবং এর ফলে মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষগুলো ফুলে উঠে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতার নানারকম বিঘ্ন ঘটাতে পারে স্ট্রোক হতে পারে এবং ব্যক্তিটি কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতে পারেন। আর এর সঙ্গে পাতলা পায়খানা এবং বমি হলে তো সোনায় সোহাগা! জল এবং সোডিয়াম শরীর থেকে হু হু করে বেরিয়ে যাবে।

 

রক্তে সোডিয়াম এর স্তর কমে গেলে তার কি মারাত্মক ফল হতে পারে, তার একটা উদাহরন আমরা দেখলাম। কিন্তু, রক্তচাপ বাড়লে নুন খাওয়া তো কমাতে বলতেই হবে তাই না? মানে, আপনার আশেপাশে, ডাক্তারবাবুরা (সে তিনি যুক্তি দ্বারা সিদ্ধ হোন বা কর্পোরেট অর্থে পুষ্ট হোন) প্রায় সবাই তাই বলবেন। বলেই থাকেন। আর ডাক্তারবাবুদের থেকেও যারা এবিদ্যায় দড়, মানে আপনার পাড়া প্রতিবেশীরা, আপনার পরিবারের সবাই তো এটা আপনার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবেন। মানে আপনি যদি উচ্চ রক্তচাপের রোগী হন। ভালবাসার অধিকারে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? নুন বেশী খেলে কি রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় বা বেড়ে থাকে ? আসুন, এবিষয়ে কিছু তথ্যে চোখ রাখি।

 

১। স্বাভাবিক (কোনো ক্রনিক রোগ বিহীন) একজন মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশে (যেমন রক্তে) সোডিয়ামের পরিমাণের কোনো তারতম্য হয়না, খাবারের সাথে নুন বেশী খাওয়া বা কম খাওয়ার ওপর নির্ভর করে। কারণ, শরীরের নানান প্রক্রিয়া শরীরে সোডিয়াম এর স্তর নিয়ন্ত্রণ করে থাকে

 

২। নুন খাওয়া এবং উচ্চ রক্তচাপ এর সম্পর্ক নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, তাকে মান্যতা দিয়ে, ইয়োরোপয়ীয়ান সোসাইটি অফ কার্ডিওলজি, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি লেখা প্রকাশ করেছে। এই লেখা কোনো গবেষণা পত্র নয়। নুন খাওয়া এবং উচ্চ রক্তচাপের মধ্যেকার সম্পর্ক সংক্রান্ত চালু বয়ানগুলোর একটা সারাংশ। অর্থাৎ এই লেখাতে পাওয়া যাবে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের বর্তমান চালু ধারনা। এই লেখার থেকে আমার বক্তব্যের জন্য প্রয়োজনীয় অংশ গুলোর উল্লেখ করছি।

 

ক) এই লেখাতে, যারা নুন বেশী খান, তাঁদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে রয়েছেন যাদের কিডনি সুস্থ, তাঁরা। আর দ্বিতীয় ভাগে, যাদের কিডনি খারাপ, তাঁরা। বলা হয়েছে যে প্রথম ভাগের মানুষদের নুন বেশী খেলে সেই নুন শরীর থেকে বের করে দেওয়ার পদ্ধতি শরীরের মধ্যেই রয়েছে। তাঁদের সমস্যার কিছু নেই। আর দ্বিতীয় ভাগে যে মানুষেরা পড়েন, তাঁরা নুন বেশী খেলে, উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হবেই যে, তা কিন্তু বলা নেই।

কিন্তু এদিকে আমরা আবার জানি যে, কিডনি খারাপ হলে সেই কারণেই উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। তাহলে প্রশ্ন, বেশী নুন খাওয়াকে কি উচ্চ রক্তচাপের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? নুন খাওয়া বা না খাওয়ার সঙ্গে তাহলে উচ্চ রক্তচাপের সমানুপাতিক সম্পর্ক কোথায়?

 

খ) এ স্বত্বেও কিছু বিশেষজ্ঞ বলেন যে উচ্চ রক্তচাপ এবং বেশী নুন খাওয়া সমানুপাতিক। তাঁরা নাকি জনমানুষের মধ্যে গবেষণা করে এমন পরিসংখ্যান পেয়েছেন। নুন খাওয়া বেশী হলে রক্তচাপ বাড়ে এবং কম হলে, তা কমে। নুন খাওয়া কমালে, রক্তচাপ কতটা কমতে পারে? তাঁরা বলেছেন যে উচ রক্তচাপ যাদের নেই তাঁদের সিস্টোলিক প্রেশার কমতে পারে ৪.২ মিমি আর ডায়াস্টোলিক প্রেশার ২.১ মিমি। আর উচ্চ রক্তচাপ যাদের আছে, তাঁদের জন্য নুন খাওয়া কমালে রক্তচাপ কমতে পারে সিস্টোলিক ৫.৪ আর ২.৮ মিমি। এটুকু তারতম্য আমাদের প্রেশার মাপতে গিয়েই যে অনেক সময় হয়ে থাকে সেটা বোঝার জন্য তো ডাক্তার হতে হয়না। এবং মানুষের শরীরের অবস্থার তারতম্যের জন্যেও এটুকু তারতম্য হয়ে থাকে।

এর জন্য কতটা নুন খাওয়া কমাতে হবে ? ৪.৫ গ্রাম। একবার চামচে মেপে দেখবেন নাকি ৪.৫ গ্রাম নুন কতটা হয়? অতটা নুন আমরা কেউ খাওয়ার সঙ্গে খাই? খাওয়া সম্ভব? আর, বাকি রইল রান্নায় দেওয়া নুন। চারজনের জন্য মাংসের ঝোল রাঁধলে ওই ৪.৫ গ্রাম নুন সেই রান্নায় দেওয়া হতে পারে। কিন্তু অতটা মাংস কেউ একা খায় না। আর চারজনের জন্য তৈরী ঝোলে কতটা নুন দিলে, সেই ঝোলের কতটা খেলে, শরীরের মধ্যে কতটা নুন প্রবেশ করে, সেই হিসেব কি কেউ করে দেখেছেন? না, তো। তাহলে এটা কি ধরনের বিজ্ঞান হোলো? কি সিদ্ধান্তে এর থেকে আমরা পৌছতে পারবো?

 

গ) বিশেষজ্ঞরা অবশ্য স্বীকার করে নিয়েছেন যে শরীরে সোডিয়াম এর মাপ কম হয়ে গেলে, যা বহুদিন নুন কম খাওয়ার কারণে হতে পারে, মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষগুলো ফুলে উঠে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতার নানারকম বিঘ্ন ঘটতে পারে, স্ট্রোক হতে পারে এবং ব্যক্তিটি কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতে পারেন।

তাঁরা একথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে দিনে ২ গ্রাম এর থেকে কম নুন খেলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে। এও স্বীকার করে নিয়েছেন যে এখনো অবধি এমন কোনো প্রমাণ নেই যে কম পরিমাণ নুন খেলে উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগে শরীরের ক্ষতি হতে পারে।

এ স্বত্বেও কিন্তু শেষ মেষ তাঁরা এই নিদানই দিয়েছেন যে বেশী নুন খেলে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।

দেখে শুনে কেমন যেন মনে হচ্ছে যে, যেন তেন প্রকারেণ জনমানুষের মধ্যে নুন ব্যবহার কমানোই উদ্দেশ্য।

 

ঘ) বলা হয়েছে যে আফ্রিকা এবং পূর্ব এশিয়ার জনমানুষের মধ্যে নুনের ব্যবহার বেশী, তাই উচ্চ রক্তচাপ এর প্রকোপ বেশী। এই হিসেবের মানদণ্ডে একটু গরমিল আছে। রক্তচাপ এর স্বাভাবিক মাত্রা কতটা? সেটা কিভাবে স্থির করা হয়? আফ্রিকার জনমানুষের ক্ষেত্রে এর হিসেব কি ইয়োরোপের সেই হিসেবের সঙ্গে মিলবে? জিনগত তারতম্য, পরিবেশগত তারতম্যের কোনো প্রভাব কি সেক্ষেত্রে মানা হবে না? আফ্রিকার মানুষের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে তার একটা সাধারণ মান পাওয়া গেলে, তবেই তো আফ্রিকার মানুষের রক্তচাপের স্বাভাবিক মাত্রা বের করা যেতে পারে। এই সংক্রান্ত বড় আকারের ক্লিনিক্যাল গবেষণা কি আফ্রিকা বা এশিয়ায় হয়েছে? না, কি ইয়োরোপের মানুষের স্বাভাবিক মাত্রা নির্ধারণ করে নিয়ে, সেই মাপেই মাপা হচ্ছে এশিয়া, আফ্রিকার মানুষের রক্তচাপ? আর, এই যে দশকের পর দশক ধরে স্বাভাবিক রক্তচাপ এর মাত্রাকে কমিয়ে আনা হচ্ছে, তারই বা বিজ্ঞানটা কি? কোন রক্তচাপে কোন জিনগত বৈশিষ্ট্যের মানুষের শরীর সুস্থ থাকে, সমস্ত মহাদেশে, সমস্ত দেশে তার ক্ষেত্র সমীক্ষা না চালিয়ে কিভাবে কয়েক জন মাত্র বিশেষজ্ঞ মিলে একটা দুটো সেমিনারে এই সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন?

 

ঙ) আচ্ছা, এমন নয় তো যে বিজ্ঞানের ধুয়া তুলে আফ্রিকা এবং এশিয়ার মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ বেশী রয়েছে এটা দেখিয়ে তাঁদের একাধারে ওষুধের ওপর বেশী নির্ভরশীল করে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে আর অন্যদিকে তাঁদের মধ্যে নুন ব্যবহার কমানোর চেষ্টা হচ্ছে?

কর্পোরেটদের স্বার্থ থাকতে পারে জনমানুষকে বেশী বেশী করে ওষুধ নির্ভর করে ফেলায়। কিন্তু, নুন ব্যবহার কমাতে বলে তাদের কি লাভ?

নুন ব্যবহৃত হয় সহজে খাবার রক্ষনাবেক্ষন করার জন্য। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে, নুনের যে বিকল্প ব্যবহার করা হয় তার দাম পড়ে নুনের থেকে অনেক বেশী। জনমানুষ যদি নুন ব্যবহার কমিয়ে দেয় এবং সেই নুনের ভাণ্ডারের একটা অংশ যদি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে ব্যবহার করা যায়, তবে লাভ তো সেই শিল্পেরই। বকলমে কর্পোরেটদের। আর নুন ব্যবহার কমিয়ে যদি জনমানুষের মধ্যে অসুস্থতার হার আর একটু বাড়ে, তাহলে ফার্মা কোম্পানি এবং কর্পোরেটদের লাভ তো বাড়বেই।

 

এই যুগ হচ্ছে প্রচার মাধ্যমের যুগ। কর্পোরেট প্রচার মাধ্যমের যুগ। এই প্রচার মাধ্যমের দ্বারাই জনমানুষের জীবনযাপন এবং চেতনাকে প্রভাবিত করে চলেছে কর্পোরেটরা। বলা ভাল, নিয়ন্ত্রন করে চলেছে। বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞদের যে সব সংস্থা, সমিতি ইত্যাদি রয়েছে, এমনকি বিশ্ববিদ্যাল্যগুলো, সেগুলোও কর্পোরেটদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এবং এই নিয়ন্ত্রণ শুধু কর্পোরেট প্রচারের প্রভাবে নয়, লগ্নীর দ্বারাও বটে। বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্থা, সমিতির অস্তিত্ব, এমনকি বিশেষজ্ঞদের বিশেষজ্ঞ হিসেবে অস্তিত্বও নির্ভরশীল হয়ে রয়েছে কর্পোরেটদের লগ্নীর ওপরে। সুতরাং আজকের যুগের বিজ্ঞানে কর্পোরেট স্বার্থই রক্ষিত হবে।

জনমানুষের জন্য তাই আমাদের প্রশ্ন তুলে যেতে হবে। আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষমতায় চেষ্টা করে যেতে হবে আমাদের নিজেদেরই সজাগ, সচেতন রাখার জন্য।

 

তথ্যসূত্র:

 

১। Levinsky, Norman G, Fluids and Electrolytes, Harrison’s Principles of Internal Medicine, 13th (internatonal) ed., Pgs 242-247, Vol. 1, McGraw Hill, 1994.

 

২। Youssef, Ghada Syed, Salt And Hyepertension: Current Views, European Society of Cardiology: E Journal of Cardiology Practice, Vol.22, No. 3, 16 Feb 2022. https://www.escardio.org/Journals/E-Journal-of-Cardiology-Practice/Volume-22/salt-and-hypertension-current-views#:~:text=It%20has%20been%20shown%20that,4.2%2F2.1%20mmHg%2C%20respectively

 

লেখক সম্পর্কে

GRAPH_AVATAR_IMG
ডা. ভাস্কর চক্রবর্তী লেখক পেশায় চিকিৎসক।কলকাতায় থাকেন।