দেশের এক বড় সংখ্যক জনগণ আয়ুষ্মান ভারত বা স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পে ইতিমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এজাতীয় স্বাস্থ্যবীমা প্রাথমিক ও আউডডোর পরিষেবায় কার্যকরী নয়। প্রসঙ্গত, সারা ভারতে চিকিৎসা পরিষেবার পিছনে জনতা যা খরচ করেন, তার প্রায় ৬৬ শতাংশ ব্যয় হয় আউটডোর চিকিৎসা ও ওষুধপত্র কিনতে,যা এরূপ চটকদারী স্বাস্থ্যবীমা প্রকল্পের আওতার বাইরে। ফলস্বরূপ সামান্য কিছু জটিল রোগের চিকিৎসায় কেবলমাত্র স্বাস্থ্যবীমা প্রযোজ্য। খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এড়িয়ে যেতে, কারণ তাতে কর্মক্ষেত্রে দৈনন্দিন মজুরির রাস্তা বন্ধ হয়। এদিকে বছরের শেষে প্রিমিয়ামের প্রায় পুরো টাকাই করদাতাদের পকেট থেকে যায় বীমা কোম্পানিগুলির পকেটে। এই বীমা ভিত্তিক স্বাস্থ্যকাঠামো স্বাস্থ্যের অধিকারের নাম করে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে স্বাস্থ্য পরিচয়পত্র বা হেলথ আই ডির মধ্যে বেঁধে ফেলে মানুষকে একধরনের স্বাস্থ্য নজরদারীর দিকে ঠেলে দেওয়ার রাস্তা পরিস্কার করছে। মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকারের স্লোগান 'সকলের জন্য স্বাস্থ্য' আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে বীমা কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন। রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেছেন শ্রী সুমিত ঘোষ।
কৃষিকে এদেশের মুনাফাখোররা বলে অলাভজনক। কিন্তু স্বাস্থ্য? ২০১৯-এর মন্দার বাজারেও স্বাস্থ্য ছিল লাভজনক বিনিয়োগ ক্ষেত্র। ২০২০-২১-এর লকডাউন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি মুনাফা-তন্ত্রের প্রেম এতটাই বেড়ে যায় যে বিশ্বজোড়া বাড়ন্ত বেকারত্বের মাঝেই মুনাফাখোর ধনকুবেররা আরও ফুলে ফেঁপে ওঠে। ২০১৪-র সারদা কান্ডে মুখ পোড়ার পর পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার তামিল নাড়ুর এআইএডিএমকে-র ধাঁচে সরকারী প্রকল্পের ঘনঘটার বাঁশী বাজিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামে। এই প্রকল্পগুলির অন্যতম কন্যাশ্রীতে যেমন পূর্বতন বামফ্রন্টের আমলের একই ধরণের প্রকল্পের থেকেও বরাদ্দ কমানো হয়েছে, তেমনই ২০১৬ সালে ঘোষিত হওয়া স্বাস্থ্যসাথীর আসল উপলক্ষ্য থেকেছে সরকারী খরচে বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বুস্ট আপ। সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকাঠামোগত উন্নতির দিকে লক্ষ্য না দিয়ে, বাজেটে স্বাস্থ্যের বরাদ্দ না বারিয়ে এহেন প্রকল্পের আমদানি স্বাভাবিকভাবেই কর্পোরেট মহলে তৃণমূল কংগ্রেসের মান-সম্মান বারিয়ে দিয়েছে।
স্ট্যাটিস্টার হেলথ স্কোর ইন্ডেক্স অনুযায়ী ভারতের আন্তর্জাতিক অবস্থান ১১৩ (স্কোর: ৬৬.২) [১]। পড়শি দেশগুলির মধ্যে ভারতের থেকে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমার। ২০২০-তে স্বাস্থ্য খাতে কেন্দ্র সরকার বরাদ্দ করেছে জিডিপির মাত্র ২.৯৬% [২]। পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংক্রান্ত তথ্য নীতি আয়োগের পোর্টালে না দিয়ে নিজেদের অপদার্থতার বিশ্লেষণের সুযোগই রাখেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যের সংজ্ঞায় ‘পূর্ণ শারীরিক, সামাজিক এবং মানসিক’ সুস্থতার কথা বলা হলেও আমাদের দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিপুল খরচ এবং সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার জাঁতাকলে পিষতে থাকা সাধারণ মানুষের জন্য তৃণমূল সরকারের দাওয়াই হল সরকারী খরচে স্বাস্থ্যের ‘বাজার’-কে চাঙ্গা করা। ডোল রাজনীতির মাধ্যমে বেসরকারি বীমার পরিসর বৃদ্ধির এই নীল নকশা স্বাস্থ্য সাথী কিংবা কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের আয়ুষ্মান ভারত উভয় প্রকল্পের চরিত্রের মধ্যেই পরিলক্ষিত [৩]। উল্লেখ্য, সরকার স্বাস্থ্য সাথী মারফৎ চিকিৎসা সংক্রান্ত অর্থ বহনে প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই ডোলেরও একটা সীমা আছে। বিশেষ করে অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে সেই সীমাবদ্ধতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে [৪]। বাকি খরচ রোগীর পরিবারকে নিজেদের পকেট থেকেই দিতে হবে। ফলে এই ধরণের প্রকল্প কিছুটা প্রাথমিক অর্থ সাহায্য মারফৎ জনগণকে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার দিকে প্রলোভন দেখাবে আর সেই ফাঁদে পা দিলে বাকি দায় রোগীর পরিবারের ব্যক্তিগত সমস্যা। অনেকটা ফাটকা বাজারের বিনিয়োগের বিজ্ঞাপনের মত কাজ করছে এই প্রকল্প। একদিকে এই ধরণের প্রকল্পগুলি সারা বিশ্বে নয়াউদারবাদী ব্যবস্থার অর্থনৈতিক মডেলের বাস্তবায়নে সাহায্য করছে আর অন্যদিকে এই প্রকল্প সংক্রান্ত দুর্নীতি তৃণমূলের লুম্পেন বাহিনীর পকেট ভরাতে সাহায্য করছে। এলাকার জনসংখ্যার চেয়ে বাড়তি স্বাস্থ্য সাথী কার্ড বিলি করে অতিরিক্ত সংখ্যার সেই কার্ড ব্যবহার করে নিজেদের পরিচালিত সরকারের থেকেই টাকা তোলার তৃণমূলের র্যাকেট তৈরি হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় [৫]।
আমাদের দেশে নয়াউদারবাদের অনুপ্রবেশের সময় থেকেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও ডাক্তারি বিদ্যার বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত হলেও পূর্ণাঙ্গ ব্যবসায়িক সাফল্য পাওয়া যায়নি। তাই ঘুরপথে কর্পোরেটদের সাহায্য করতে সরকার নিজের কোষাগার উজার করতে ব্যস্ত। যদি সরকারের সত্যিই জনগণের স্বাস্থ্যের অধিকার সুনিশ্চিত করার সদিচ্ছা থাকত তাহলে তারা স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি, সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকাঠামোগত উন্নতি, সরকারী হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি বহু চর্চিত এবং দাবী তোলা বিষয়গুলোয় জোড় দিত। কিন্তু তারা বাহ্যিক অলংকরণ ছাড়া আর কোনও কিছুতেই মনোনিবেশ না করে নিজেদের কোষাগার মুনাফাখোরদের কাছে উন্মুক্ত করতে উদ্যত। ওই আর কি… ঝিনচ্যাক ছাড়া কিছু থাকবে না!
তথ্যসূত্র
১। https://www.statista.com/statistics/1290168/health-index-of-countries-worldwide-by-health-index-score/
২। https://data.worldbank.org/indicator/SH.XPD.CHEX.GD.ZS?locations=IN
৩। https://www.anandabazar.com/west-bengal/kolkata/personal-opinion-of-a-doctor-regarding-the-insurance-policy-of-state-government-1.1250358
৪। https://bangla.hindustantimes.com/bengal/districts/bone-operation-wont-be-allowed-under-swasthya-sathi-card-in-private-hospitals-except-few-conditions-check-here-31698907650256.html
৫। https://www.ganashakti.com/news/fake-swastha-sathi-card