গ্রাফ ওয়েবসাইটে পূর্ব প্রকাশিত
(তৃতীয় কিস্তি)
এই চলতি কোভিড-১৯এর জন্মই তো ১৯এ, নাহলে কোভিডের পদবি ১৮, ১৭ যা খুশি হতে পারত। অর্থাৎ ১৯এর আগে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব ছিল অজানা। ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে সবে যখন এই ভাইরাসের অস্তিত্ব জানা গেছে, এই কোভিড-১৯এর উৎসের রহস্য যখন একেবারেই ধোঁয়াশা, তখনই ৮০জন বিখ্যাত ভাইরোলজিস্ট বিখ্যাত ল্যান্সেট পত্রিকায় লিখে ফেললেন (২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২০) “যারা বলছেন এই ভাইরাসের জন্ম প্রকৃতি থেকে নয়, সেইসব চক্রান্ত-তাত্ত্বিকদের আমরা তীব্রভাষায় ধিক্কার জানাই। … আমরা সরাসরি স্পষ্ট ভাষায় বলছি এই ভাইরাসের জন্ম প্রাকৃতিক”। ল্যানসেট আন্তর্জাতিক খ্যাত পত্রিকা। সেই পত্রিকায় যে কোনও লোকের লেখা ছাপা হবার কথা নয়। তাই এই ৮০জন ভাইরোলজিস্ট যে অতি নির্ভরযোগ্য এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। চক্রান্ত-তাত্ত্বিকদের বিরুদ্ধে এই বিষোদ্গার করা চিঠির মুসাবিদা কে করে দিয়েছিল জানেন? পিটার দাসজাক। যিনি ‘জিওএফ’-এর সূত্রে উহান ল্যাবে টাকা পাঠানোর মূল কারিগর। যিনি উহান ল্যাবে শ্রীমতী শি’-এর সঙ্গে এই ভাইরাস ম্যানুফ্যাকচারিং প্রোজেক্টের অংশীদার। কী মনে হয়? বিশ্বাসে মিলায় ভাইরাস, তর্কে বহুদূর?
ঠাকুরঘরে কে রে? আমি তো কলা খাইনি! এখনও সার্স-২ ভাইরাসের উৎস নিয়ে অনেক রহস্য। এখনও অনেক কিছু জানা দরকার। কিন্তু কিছু চক্রান্ত-তাত্ত্বিক এটা ল্যাবোরেটরি ম্যানুফ্যাকচার্ড বলে সন্দেহ করছে। শুধু সন্দেহ, সিদ্ধান্ত নয়। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়বে না তো? দাসজাকের সঙ্গে শি’র চুক্তি। দাসজাকের সঙ্গে ফাউচি, ফ্রান্সিস। এঁদের সঙ্গে জিওএফ। জিওএফের সঙ্গে মার্কিন সরকারের অনুদান। অতএব কিছু বুঝে ওঠার আগেই আর একবার মস্তিষ্ক প্রক্ষালণ করতে হবে। ১৭ই মার্চ, ২০২০। আবার একটা চিঠি। এবার পৃথিবীর বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা নেচার। এখানে একদল প্রবীন বিখ্যাত ভাইরোলজিস্ট স্ক্রিপ্স রিসার্চ ইন্সটিটিউট-এর ক্রিশ্চিয়ান অ্যাণ্ডারসন-এর নেতৃত্বে একটি পত্র লিখলেন, এবং বললেন যারা এই সার্স-২ ভাইরাস উহান ল্যাবে ম্যানুফ্যাকচার্ড বলছে তারা চক্রান্ত-তাত্ত্বিক। তারা লিখলেন ““Our analyses clearly show that SARS-CoV-2 is not a laboratory construct or a purposefully manipulated virus,”। তার মানে কোভিড-১৯এর অস্তিত্বের জানান দেওয়ার মাত্র চার-পাঁচ মাসেই বুঝে ফেলা গেল, আর যাই হোক না কেন, এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ম্যানিপুলেট করে ল্যাবোরেটরিতে তৈরি নয়।
বেশ। হু কি করছিল? প্রায় ন’মাস পরে হু-এর একদল প্রতিনিধি গেল চিনের হুবেই প্রদেশে। ওই প্রদেশেই উহান ল্যাব। তারা ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় অসুখের ওপর বিস্তৃত সমীক্ষা করে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল যে গত ডিসেম্বরের আগে এই রোগের তেমন নজরে পরার মত কোনও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এই প্রতিনিধিদলের সদস্যদের নির্বাচন চীনা সরকারের পরামর্শ এবং কিছুটা নজরদারিতেই হয়েছিল। দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন সেই পিটার দাসজাক। প্রতিনিধিরা ওখানে যাবার আগে, ওখানে যাবার পর, ওখান থেকে ফিরে এসেও বারবার বলতে লাগল, ল্যাব থেকে লিক করে এই ভাইরাসের জন্ম হওয়া প্রায় অসম্ভব। হু’ও একই সঙ্গে বারবার বলতে লাগল, এই প্যানডেমিকের কারণ ল্যাব হতেই পারে না। অথচ এই প্রতিনিধি দলের কাছে চীনা কর্তৃপক্ষ উহান ল্যাবের সমস্ত তথ্য গোপন করে রেখেছিল। এমনকি ল্যাবের ডেটাবেসও খুলতে দেওয়া হয়নি। তারা খুব সামান্য তথ্য জানিয়েছিল, যা মিথ্যা হতে পারে, বিপথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যেও হতে পারে। আবার ৩০শে মার্চ, ২০২১-এ হু একটা ১২০পাতার রিপোর্ট প্রকাশ করে জানাল, এই ভাইরাসের জন্মসূত্র বুনো। কোনও এক মধ্যস্থর মারফৎ মানুষের শরীরে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ল্যাব থেকে লিক হবার কোনও সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। বাস, হয়ে গেল। একদিকে বিখ্যাত নেচার, ল্যানসেট পত্রিকা, সঙ্গে জগদ্বিখ্যাত ভাইরোলজিস্টদের দল, আবার ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন ওরফে হু বলে দিয়েছে, কনফার্ম করেছে এই ভাইরাসের জন্ম কোনও প্রাণী থেকেই, ল্যাবে ম্যানুফ্যাকচার্ড নয়। অমনি মিডিয়া, বিভিন্ন নামী সাংবাদিক এবং ডাক্তারবাবুরা তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করে দিল এই সার্স-কোভিড-১৯-এর উৎস একেবারেই প্রাকৃতিক। যারা বলছে এই ভাইরাস জেনেটিক্যালি ম্যানুফ্যাকচার্ড তারা আসলে চক্রান্ত-তাত্ত্বিক। এঁদের অনেককেই আপনারা ইদানিং মিডিয়ার দৌলতে চিনে ফেলেছেন।
যাদের চক্রান্ত-তাত্ত্বিক বা কনস্পিরেসি থিওরিস্ট বলা হচ্ছে, তারা কেউ একবারও বলেনি যে তারা নিশ্চিত এই ভাইরাসের উৎস উহান ল্যাব বা ওই জাতীয় কোনও ল্যাব-এ জেনেটিক্যালি ম্যানুফ্যাকচার্ড, যেমনটা জুরাসিক পার্কে গল্পের শুরুতেই বলা হয়েছিল, হ্যাঁ জেনেটিক্যালি ম্যানুফাকচার্ড ডাইনসর। তারা এও বলেনি যে, এর উৎস কোনও বুনো জন্তু। জেনেটিক্যালি মডিফায়েড সিড যেমন দীর্ঘদিনের গবেষণার ফসল, তেমনি একথা কেউই অস্বীকার করতে পারছে না যে আমেরিকার জিওএফ বা চিনের উহান ল্যাবে কৃত্রিম জীবাণু-চর্চা হয়। তাহলে? যারা গোয়েবেলিয় মিথ্যা রচনা করে চলেছে তারা চক্রান্ত-তাত্ত্বিক নাকি যারা বারবার সন্দেহ প্রকাশ করছে, কেন এবং কীভাবে’র প্রশ্ন তুলছে, তারা?
এই চক্রান্ত-তত্ত্ব বা কনস্পিরেসি থিওরির ইতিহাসও অতি চমৎকার। অনেকেই জানেন না, এই চক্রান্ত-তত্ত্বের মূল প্রবক্তা ছিল ‘সিআইএ’। মনে থাকতে পারে এককালে বামপন্থীরা কমিউনিস্ট-বিরোধীদের সম্ভাব্য ‘সিআইএ এজেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এক অধ্যাপককেও সিআইএর এজেন্ট বলা হত। তিনি হেসে বলতেন, হ্যাঁ, আমার সংসার তো সিআইএর টাকায় চলে। ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট কেনেডি খুন হন। এই খুনের জন্য পরিচিত এক মার্ক্সবাদী এবং প্রাক্তন সেনানী লি হার্ভে অসওয়াল্ড এর ঘাড়ে দোষ চাপানো হয়। তিনিও এক আততায়ীর হাতে খুন হন। প্রেসিডেন্টের খুনের তদন্তের জন্য কমিশন হয়, আর দশজন প্রত্যক্ষ্যদর্শী হঠাৎ “স্বাভাবিক” মৃত্যুর শিকার হন, কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দান পর্ব শেষ হওয়ার আগেই। তাঁদের মৃত্যুর পেছনে সরকার কোনও আস্বাভাবিকতা খুজে পাননি। সেই কমিশন বলে প্রেসিডেন্টের খুনটাও প্রায় স্বাভাবিক, এর পেছনে কোনও চক্রান্ত নেই। যারা এই খুনের পিছনে কোনও রহস্য আছে বলেছিল, যারা দশজন সাক্ষীর “স্বাভাবিক” মৃত্যুর পেছনে কোনও রহস্য আছে বলেছিল, তাদের সিআইএ চক্রান্ত-তাত্ত্বিক বলেছিল। সেই প্রথম কনস্পিরেসি থিওরি জনপ্রিয় হল। তারপর থেকে যখনই রাষ্ট্রীয় মতের বিরুদ্ধে অন্য কোনও মত উঠে এসেছে তৎক্ষণাৎ তাকে চক্রান্ত-তত্ত্ব বা কনস্পিরেসি থিওরি বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যমত সহ্য করা হবে না।
আজ, মূলধারার মিডিয়া, সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল, ইন্টারনেট তীব্র মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে জনসাধারণকে বোঝানোর গোয়েবেলসীয় পদ্ধতির অসামান্য প্রয়োগ করে চলেছে। যদিও ১৮ জন বিজ্ঞানীর একটি দল লিখেছেন, মহামারীর ঠিকঠিক উৎস জানার জন্য তদন্ত দরকার আর প্রাকৃতিক নাকি ল্যাব থেকে স্পিলওভার, উভয় সম্ভাবনাকেই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার উচিত।
এবার দেখা যাক, অনেকের ভবিষ্যৎ বলতে পারার স্বর্গীয় দক্ষতা। কোথায় লাগে আমাদের বাবাজীদের। “তোর কপালে চাকরি নাচছে”, “না, তোর মেয়ের বিয়ে সুখের হবে না” এইরকম প্রেডিকশানের সঙ্গে আমরা পরিচিত। মহামারী হওয়ার আগেই আমরা কাউকে কাউকে আসন্ন মহামারীর ভয়ানক বিপদ সম্পর্কে কথা বলতে দেখেছি। সেটাও কি বাবাজী স্টাইল?
এই যে ফাউচি আর পিটার দাসজাকের জীবাণু-চর্চা, এর পেছনে একজন বিখ্যাত ফিল্যানথ্রপিস্ট ছিলেন। নাম বিল গেটস। জেনেটিক্যালি উন্নত মানুষ কীভাবে তৈরি করা যায়, বিশেষত বিভিন্ন জাতির ‘ইন্টার রেস’ সঙ্গমের মধ্যে দিয়ে (ইউজেনিক্স) এবং কীভাবে বিশ্বের লোকসংখ্যা কমিয়ে ফেলা যায় সেই নিয়ে তার ফাউন্ডেশন কাজ করে। গেটস ২০১৮ সালে ঘোষণা করলেন, মারাত্মক এক প্যানডেমিক আসন্ন। তিন কোটি মানুষ মারা যাবে। সমস্ত ভ্যাক্সিন তৈরির পিছনে প্রধান বিনিয়োগ তার। অক্সফোর্ড আর অ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘টাই-আপের’ পিছনেও তিনি। সমস্ত বড় বড় ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানীগুলোর প্রধান বিনিয়োগকারি বিল গেটস।
পোলিও ভ্যাকসিন নিয়ে কেলেংকারীর কথা আমাদের দেশের নির্ভরযোগ্য বিজ্ঞান পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। পরে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছিল। যেসব শিশুকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত পোলিও ভ্যাকসিন দেওয়া কথা তাদের দেওয়া হত ভ্যাক্সিনের দুই ফোঁটা। বিল গেটস নাকি ফোঁটার সংখ্যা বাড়াতে বলেছিলেন। ফল কি হল? প্রথমত ভারত সরকার তাঁকে ২.৫ বিলিয়ন ডলারের বরাত দিল। আজকের টাকার হিসেবে এটা প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। ২০০০ সাল থেকে ২০১৭ সাল অব্দি বিল গেটসের এই জনসেবার মূল্য প্রায় ৫ লক্ষ ভারতীয় শিশুর পঙ্গু হয়ে যাওয়া। বিল, তাঁর প্রতিষ্ঠান এবং ‘হু’ অবশ্য জানিয়েছে যে, এসব মিথ্যা প্রচার। কিন্তু এইডস ভ্যাক্সিন নিয়ে আফ্রিকাতেও যে বিল গেটস-এর জনসেবার ক্ষতচিহ্ন বহন করে চলেছে বহু মানুষ; তার কী হবে?
(ক্রমশ)