"দু'বেলা দু'মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোনো দাবি

..............................................

আমার সামান্য দাবি, পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর

...............…....................

...... মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাই:

দু'বেলা দু'মুঠো পেলে ছেড়ে দেব অন্য-সব দাবি। "

     সরু-মোটা কাঁকড়ে ভরা যে কোনো চালেরই শানকি ভরা  ভাত পেলে ছেড়ে দেওয়া যায় সব কিছু।বাড়ি গাড়ি টাকাকড়ি,খ্যাতির লোভ,সব-সব-সব ছেড়ে দেওয়া যায়। আর যদি এই দাবি না মেটে?

তাহলে কবি দেখে নেবেন।

তিনি লণ্ডভণ্ড করবেন।

বাধাবেন দক্ষযজ্ঞ । 

'ইষ্টানিষ্ট' মানার কোনো দায় নেই তাঁর।

  বেঁচে থাকার, টিঁকে থাকার প্রাথমিক অমোঘ অনিবার্য শর্ত খাদ্য।ক্ষুধা নিবৃত্তির উপকরণ।ভাত হলে ভাত।রুটি হলে রুটি।যেখানে যেমন মেলে।যার যেমন অভ্যেস।

   যদি না মেলে? না মিললে সব বরবাদ।

হৃদয়ের প্রীতি,

মনের মাধুরী,

মননের দ্যুতি।

    এই গ্রহে ৭৩৫ মিলিয়ন মানুষ খালিপেটে রাতের বেলা বিছানায় এলিয়ে পড়ে।প্রায় প্রতি দশ জনে একজন।আর বিশ্বের চার ভাগের একভাগ ক্ষুধার্ত মানুষ বাস করে ইন্ডিয়া বা ভারত নামক দেশটিতে।

   সাম্প্রতিক প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে আমাদের জন্মদেশের স্থান ১২৫-এর মধ্যে ১১১।বিগত বছরে যা ছিল ১২১-এর মধ্যে ১০৭।অর্থাৎ সাধারণ মানুষের সাধারণ ভাবে বেঁচেবর্তে থাকার জন্য তাদের মুখে উপযুক্ত পরিমাণে ভাত-রুটি জোগানর কাজে ভারত রাষ্ট্র ডাহা ফেল।ক্লাসরুমের লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র।দেশ চালনার হাল-দাঁড় যাদের হাতে তারা বাঁধা গতে হল্লা তুলেছেন।

"এই রিপোর্ট ভুয়ো"।

"পরিসংখ্যান ভেজালে ভরা"।

"মতলব,বিশ্বমঞ্চে ভারতের মুখে কালিমালেপন"।

   বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সরকারি হোমরাচোমরাদের হইচইয়ের যথার্থতা বিষয়টি আমাদের আলোচনায় আপাতত মুলতুবি রাখছি।তার আগে জেনে নেওয়া যাক, প্রতি বছর নিয়ম করে যারা বিশ্ব ক্ষুধা সূচক প্রস্তুত করে তারা কারা এবং এই সূচক নির্মাণে তারা কোন মাপকাঠি ব্যবহার করে।

   Concern Worldwide  এবং  Welthungerhilfe, দুই অসরকারি সংস্থা ২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছর নিয়ম করে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক (GLOBAL HUNGER INDEX) প্রতিবেদন প্রকাশ করে।সেই প্রতিবেদন থেকে পৃথিবীবাসী জানতে পারে বিভিন্ন দেশের মানুষের কেমন মানের খাদ্য কতটা পরিমাণে জোটে।অথবা আদৌ জোটে কিনা।

    Concern Worlwide-  এর আত্মপ্রকাশ ১৯৬৮ সালে, আয়ারল্যান্ডে।পঞ্চাশটা দেশে এদের কার্যকলাপ বিস্তৃত।শিক্ষা,স্বাস্থ্য,পুষ্টি,লিঙ্গসাম্য এবং জীবিকা এদের ক্রিয়া-কেন্দ্র।Concern--এর রিপোর্ট বলছে ২০২২ সালে  বিবিধ কারণে দুর্গত তিন কোটি ছয় লক্ষ মানুষ সংস্থার সহযোগিতায় উপকৃত হয়েছে।

   Welthungerhilfe --এর আত্মপ্রকাশ ১৯৬২ সালে,তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে।ধর্ম ও রাজনীতির সংস্রবহীন একটি স্বাধীন অসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।প্রতিষ্ঠার পর থেকে এশিয়া,আফ্রিকা,ল্যাটিন আমেরিকায় ১০৩৬৯টি প্রকল্পে সংস্থাটি ৪°২ বিলিয়ন ইউরো খরচ করেছে।ক্ষুধা ও দারিদ্রের অবসান Welthungerhilfe--এর ঘোষিত লক্ষ্য।

   একটা ১০০ পয়েন্ট স্কেলে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের ফলাফল(ক্ষুধার তীব্রতা) নির্ণীত হয়। শূন্য এখানে সবচেয়ে ভালো।একশ সবচেয়ে মন্দ।অর্থাৎ পরীক্ষাটি স্কুল কলেজের পরীক্ষার ঠিক বিপরীত।যে ছাত্রী বা ছাত্র যত কম নাম্বার পাবে,সে তত ভালো ছাত্রী বা ছাত্র।যে যত বেশি পাবে,সে তত খারাপ।এই পরীক্ষাতেও প্রথম বিভাগ,দ্বিতীয় বিভাগ,তৃতীয় বিভাগ,স্টার এইভাবে ক্ষুধার তীব্রতা অনুযায়ী ফলাফলের মান ভেদের ব্যবস্থা আছে।

   ১০০ পয়েন্ট স্কেলে যেসব দেশের স্থান ৯°৯ বা তার নীচে সেই দেশগুলি কম তীব্র খিদের দেশ।যাদের স্থান১০°০ থেকে ১৯°৯-এর মধ্যে তারা মাঝারি তীব্রতার খিদের দেশ।স্কেলের ২০°০ থেকে ৩৪°৯-এর মধ্যে যাদের স্থান তারা গুরুতর তীব্রতার খিদের দেশ।যেসব দেশ স্কেলের ৩৫°০ থেকে ৪৯.৯ পয়েন্টের -এর মধ্যে অবস্থান করে তারা বিপজ্জনক তীব্রতাসম্পন্ন খিদের দেশ।আর ৫০ পয়েন্টের উপরে যাদের স্থান তাদের খিদের তীব্রতা অতি বিপজ্জনক।

    চারটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডে খিদের তীব্রতার পরিমাপ করা হয়।সেগুলি হল--১ঃ জনজীবনে অপুষ্টি  (UNDERNOURISHMENT),২ঃ বিকাশ-রুদ্ধ শিশু (CHILD STUNTING),৩: শিশু অপচয় (CHILD WASTING),৪ঃ শিশু মৃত্যুহার (CHILD MORTALITY)।

  * জনজীবনে অপুষ্টি বলতে বোঝায় সামগ্রিক জনসংখ্যার কত শতাংশের প্রয়োজনীয় পরিমাণ ক্যলোরি সম্পন্ন খাদ্য জোটে না।

  * বিকাশ-রুদ্ধ শিশু (CHILD STUNTING) বলতে বোঝায় পাঁচ বছরের কম বয়স্ক কত শতাংশ শিশুর দৈর্ঘ্য বয়সের তুলনায় কম।

  * শিশু অপচয় (CHILD WASTING) বলতে বোঝায় পাঁচ বছরের কম বয়স্ক কত শিশুর ওজন দৈর্ঘ্যের তুলনায় কম।

  * শিশু মৃত্যুহার (CHILD MORTALITY) বলতে বোঝায় পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে প্রতি হাজার শিশুর কতজন মারা যায়।

   এই চারটি মানদণ্ডের প্রয়োগভিত্তিক সম্মিলিত ফলাফলেই নির্দিষ্ট হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জঠরাগ্নির তাপ-উত্তাপ।সর্বশেষ বাৎসরিক পরীক্ষায় ভারতের ফল হতাশজনকই নয়,রীতিমতো দুশ্চিন্তাউদ্রেককারী।মোট ১০০-র মধ্যে ২৮°৭ পয়েন্ট পেয়ে ১২৫ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান একশত একাদশ।এরকম ভেবে আশ্বস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই যে,ভালো ছাত্র পাকেচক্রে পরীক্ষায় খারাপ করে ফেলেছে।পরের বার রেজাল্টের জেল্লায় পরিবার-পাড়া-প্রতিবেশীর মুখে হ্যালোজেন জ্বালিয়ে দেবে।এ-ছাত্র বরাবরই দু'কান কাটা রেজাল্ট করে।

  * ২০১৪-৭৬টি দেশের মধ্যে ৫৫

    ২০১৫-১০৪টি দেশের মধ্যে ৮০

    ২০১৬-১১৮টি দেশের মধ্যে ৯৭

   ২০১৭-১১৯টি দেশের মধ্যে ১০০

   ২০১৮-১১৯টি দেশের মধ্যে ১০৩

   ২০১৯-১১৭টি দেশের মধ্যে ১০২

   ২০২০-১০৭টি দেশের মধ্যে ৯৪

   ২০২১-১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১

   ২০২২-১২১টি দেশের মধ্যে ১০৭

                                                                                                      

   একটি বিষয় সবিশেষ গুরুত্ব সহ উল্লেখ না করলেই নয়।২০১৪ সালে ১০০-র মধ্যে ১৭°৮ পয়েন্ট পেয়ে ভারত মাঝারি ক্ষুধার্ত দেশের সারিতে ছিল।সেই বছরেই "সবকা সাথ সবকা বিকাশ" আওয়াজ তুলে প্রবল পরাক্রমে দিল্লির মসনদে আসীন হয় হিন্দুত্ববাদী সরকার। তার পরের বছর ২০১৫-য় বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের অর্জিত পয়েন্ট  ২৯°০ হওয়ায় সে গুরুতর ক্ষুৎকাতর দেশগুলির সারিভুক্ত হয়।তারপর থেকে চিত্রনাট্যে কোনো বদল নেই।শুধুই অপুরিত খিদের নোনা ডোবার নিঃসীম অন্ধকারে অনিঃশেষ তলিয়ে যাওয়া।

   এ দেশের হাট-বাট-মাঠ-কল-কারখানার আম জনতা,রোদে পোড়া জলে ভেজা,অসুখে ওষুধ না পাওয়া,উৎসবে নতুন পোশাক না জোটা আম জনতা দেশের মাতব্বরদের সঙ্গে একটা ব্যাপারে নিপুণ সঙ্গতে পারদর্শী।তা হল,পাকিস্তানকে দেখে নেওয়ায়।পাকিস্তানকে বুঝে নেওয়ায়।যে বিষয়ে যতই পিছিয়ে থাকি না কেন,পাকিস্তানের থেকে এগিয়ে থাকাটা পরম প্রাপ্তি।ক্ষুধা সূচকে ভারতের অবস্থা কি পাকিস্তানের থেকে ভালো? না।২০২৩-এর সূচকে পাকিস্তান ভারতের থেকে নয় ধাপ ভালো অবস্থায় রয়েছে।১২৫টা দেশের মধ্যে ভারত ১১১।পাকিস্তান ১০২।ভারতের স্কোর ২৮°৭,পাকিস্তানের ২৬°৬।তালিকায় ভারতের নীচে রয়েছে মাত্র ১৪টি দেশ।

  শুধু ২০২৩-এই নয়,২০২২-এও ভারত পাকিস্তানের পিছনে।ভারত ১০৭।পাকিস্তান ৯৯।

  ২০২১-এও গল্পে বদল নেই।পাকিস্তান ৯২।ভারত ১০১।

   ২০২০-তেও ছবি একই আছে।প্রতিবেশী এগিয়ে,আমরা পিছিয়ে।পাকিস্তান ৮৮।ভারত ৯৪।

   কিন্তু পাকিস্তান ক্ষুধা সূচকে  ভারতের থেকে ভাল অবস্থানে থাকার অর্থ এই নয় যে সেই দেশের সাধারণ মানুষ ভাত-রুটির হাহাকার মুক্ত।পাকিস্তানও ভারতের মতোই গুরুতর ক্ষুৎকাতর দেশগুলির সারিতে দাঁড়িয়ে।খাদ্য নিরাপত্তার নিরিখে প্রতিবেশী "শত্রু" দেশটিরও উঁচু গলায় বলার মতো কিছু নেই।

    প্রতিবেশী যে সমস্ত দেশের(বাংলাদেশ,নেপাল,শ্রীলংকা) সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে বিশেষ কোনো তিক্ততা নেই নাগরিকের মুখে  সঠিক পরিমাণে উপযুক্ত মানের খাদ্য জোগানয় তাদের তুলনায় এই দেশ অনেকটাই পিছিয়ে।সর্বশেষ প্রকাশিত ক্ষুধা সূচকে শ্রীলংকা,নেপাল,বাংলাদেশের স্থান যথাক্রমে ৬০,৬৯ ও ৮১।শুধু তাই-ই নয় দক্ষিণ এশিয়ার বড়দাদা ভারত যেখানে গুরুতর তীব্রতার খিদের দেশগুলোর সারিভুক্ত,নেহাৎই ক্ষুদ্র এই প্রতিবেশী দেশগুলোর খিদের তীব্রতা মাঝারি মানের।

  ২০২২-এও ভারত(১০৭) শ্রীলংকা(৬৪),নেপাল(৮১),বাংলাদেশের(৮৪) থেকে অনেকটাই পিছিয়ে।

  ২০২১-এও মন্দির রাজনীতির দেশ(১০১) শ্রীলংকা(৬৫),নেপাল(৭৬),ও বাংলাদেশের(৭৬) সঙ্গে পাল্লা কষতে পারেনি। 

  ২০২০-তেও ছবির কোনো বদল নেই।ভারত(৯৪),শ্রীলংকা(৬৬),নেপাল(৭৩),বাংলাদেশ(৭৫)।

  খাদ্য সংকটের তীব্রতা হ্রাসে  কতিপয় যে কটি দেশের উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে তার মধ্যে আছে নেপাল ও বাংলাদেশ।২০১৫-য় ২৬°২ পয়েন্ট পেয়ে বাংলাদেশ ছিল গুরুতর ক্ষুৎকাতর দেশগুলির একটি।২০২৩-এ ১৯°০ পয়েন্টে বাংলাদেশ এখন মাঝারি তীব্রতার ক্ষুধা সম্পন্ন দেশ।২০১৫-য় ২১°৩ পয়েন্ট পেয়ে নেপাল গুরুতর তীব্রতার ক্ষুধা সম্পন্ন দেশ ছিল।২০২৩-এ সেই দেশের খিদের তীব্রতা মাঝারি।১০০ পয়েন্ট স্কেলে তার স্থান ১৫°০ পয়েন্টে।

   যদিও বর্তমান নিবন্ধের বিষয়-কেন্দ্র পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের খিদে সংকট, তবু ভুবন জুড়ে খিদে পরিস্থিতিও আমাদের আলোচনায় মনোযোগের দাবি রাখে।কারণ উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম কোনো গোলার্ধই খিদের হাহাকার মুক্ত নয়।এমন কোনো দেশ নেই যেখানে জঠরাগ্নির জ্বালা নেই।অঞ্চল ভেদে তীব্রতার হেরফের আছে।

   দক্ষিণ এশিয়া এবং সাব সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলদ্বয় গত দুই দশক ভূমন্ডলে নিরবচ্ছিন্নভাবে সর্বাধিক তীব্র ক্ষুধার শিকার।২০২৩-এর বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে এই দুই অঞ্চল ২৭°০  পয়েন্ট পেয়ে গুরুতর তীব্রতার ক্ষুধা সারণীতে স্থান নিয়েছে।২০০০ সালে সর্বাধিক ক্ষুৎপীড়িত এই দুই অঞ্চলে খিদের তীব্রতা ছিল বিপজ্জনক।অর্থাৎ  GHI  স্কেলে ৩৫°০ থেকে ৪৯°৯-এর মধ্যে।২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে জঠরাগ্নির তীব্রতা হ্রাসে এই দুই অঞ্চলেই উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা যায়।কিন্তু ২০১৫ আর ২০২৩- এর ফলাফলের তুলনা করলে দেখা যায় খিদের সংকট মোচনে অগ্রগতি স্তব্ধ।এবং এই লক্ষণ দক্ষিণ এশিয়া আর সাব সাহারান আফ্রিকার বৈশিষ্ট্য নয়,গোটা পৃথিবীর ক্ষেত্রেই সত্য যে,ভুখা মানচিত্রে অভুক্ত/অর্ধভুক্তের ভিড় কমার লক্ষণ নেই। 

   অঞ্চল ভিত্তিক বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের ফলঃ

  সাব সাহারান আফ্রিকা--

   ২০০০--৪২°৮

   ২০০৮--৩৩°৬

   ২০১৫--২৭°৯

   ২০২৩--২৭°০

   দক্ষিণ এশিয়া--

   ২০০০--৩৭°৭

   ২০০৮--৩৪°১ 

   ২০১৫--২৮°৬

   ২০২৩--২৭°০

পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা-

   ২০০০--১৬°২

   ২০০৮--১৪°১

   ২০১৫--১৩°২

   ২০২৩--১১°৯

 ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়া-

   ২০০০--১৩°৪

   ২০০৮--১০°৫

   ২০১৫--৮°০

   ২০২৩--৮°৬

  পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া--

   ২০০০--১৮°৬

   ২০০৮--১৩°৭

   ২০১৫--৯°৬

   ২০২৩--৮°৩

   ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া

   ২০০০--১৩°৫

   ২০০৮--৮°৯

   ২০১৫--৬°৭

   ২০২৩--৬°১

  Concern Worldwide ও  Weltthungerhilfe--প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচক প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,ইংল্যান্ড,অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো অনেক দেশের ক্ষুধা পরিস্থিতি সংক্রান্ত কোনো আলোচনা নেই। কিন্তু আর যাই হোক দীন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মাতব্বর দেশটির(মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) খিদের ভূগোলে নজরদারি না চালালেই নয়।মাতব্বর দেশটিকে আমরা যতই নন্দনকানন কল্পনা করি না কেন,সে কাননে শুধু বেলাগাম ভোগের বিলোল উপাচারই নেই ,না-মেটা খিদের বিষ তরুও আছে।

   Food Research and Action Centre জানাচ্ছে প্রায় ৯০ লক্ষ পঞ্চাশোর্ধ বয়সের মানুষ স্থায়ী খাদ্য বিপন্নতার মধ্যে দিন কাটান।খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ৪৪°২  মিলিয়ন মার্কিন নাগরিকের জীবন সঙ্গী।প্রতি কুড়িটা মার্কিন পরিবারের মধ্যে একটি পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এতটাই তীব্র যে নিয়মিত প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্যের সংস্থান করে উঠতে পারে না।

   "বুক ডুবিয়ে ক্ষুধার মিছিল চলে", কবির এই উচ্চারণ  ভূগোল ও রাজনীতির সব সীমান্ত উজিয়ে নিদারুণ ভাবে সত্য।২০২৩-এর বিশ্ব ক্ষুধা সূচক হিসাবে ন'টি দেশ--বুরুন্ডি,মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র,কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র,লেসোথো,মাদাগাসকার,নাইজের,সোমালিয়া,দক্ষিণ সুদান ও ইয়েমেন--খিদের তীব্রতায় বিপজ্জনক স্তরে অবস্থান করছে।আরও ৩৪টি দেশ খিদের তীব্রতার নিরিখে রীতিমতো সঙ্গীন অবস্থায় রয়েছে।

  ২০১৫ সালে জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদে (United Nations General Assembly) গৃহীত প্রস্তাবে ২০৩০ সম্পাদ্য কার্যাবলী (2030Agenda) নামে ১৭টি সুস্থায়ী উন্নয়ন পরিকল্পনা সূচী (SUSTAINABLE DEVELOPMENT GOALS) নির্দিষ্ট করা হয়।গুরুত্বের বিচারে তালিকার সর্বপ্রথমে স্থান পায় দারিদ্রের অবসান (No Poverty) এবং দ্বিতীয় স্থান পায়  ক্ষুধা মুক্তি(Zero Hunger)।কিন্তু  সর্বশেষ বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে এক বিবর্ণ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত স্পষ্ট প্রতীয়মান।কম করে ৫৮টি দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে কম খিদের স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারবে না।নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে অপুষ্টি,বিকাশ-রুদ্ধ শিশু,শিশু অপচয় এবং শিশু মৃত্যুহার কোনো ক্ষেত্রেই সন্তোষজনক পরিবর্তন দিবাস্বপ্ন  মাত্র।

    উন্নয়নের উড়ান চন্দ্রযানে পৌঁছলেও, ভারত নামক বৃহত্তম গণতন্ত্রের কোটি কোটি নাগরিকের কাছে শানকি ভরা  ভাতের চেয়ে সুন্দরতর কোনো স্বপ্ন নেই। জনসংখ্যার ১৬°৬ শতাংশ, অর্থাৎ, প্রায় ২৪ কোটি ভারতবাসীর পেট ভরা খাবার জোটে না।শিশু অপচয়ের(Child Wasting)  অর্থাৎ দৈর্ঘ্যের তুলনায় কম উচ্চতার শিশুর সংখ্যায় ভারতের স্থান সর্বপ্রথম।শতাংশের হারে  ১৮°৭(প্রায় ২ কোটি ২৫ লক্ষ)।বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার  ক্ষেত্রে এই হার যথাক্রমে ১১°০%,  ১৩°১% । আবার,বিকাশ-রুদ্ধ শিশু(Child Stunting)অর্থাৎ, বয়সের তুলনায় কম বৃদ্ধি শিশুর ক্ষেত্রেও এদেশ পিছিয়ে পড়াদের মধ্যে অন্যতম। ৩৫°৫ শতাংশ (প্রায় ৪কোটি ২৬ লক্ষ) পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর ঠিকঠাক বাড়বৃদ্ধি নেই,যখন নিকট প্রতিবেশী শ্রীলংকায় বিকাশ-রুদ্ধ শিশুর হার ১৩°১ শতাংশ ও বাংলাদেশে ২৩°৬ শতাংশ।পাঁচ বছরের কম বয়সী  শিশু মৃত্যুর হার ভারতে ৩°১শতাংশ।পরমাণু বোমের গৌরবহীন বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার ক্ষেত্রে শিশু মৃত্যুর হার যথাক্রমে ২°৭ ও ০°৭ শতাংশ।

    কিন্তু কেন শিশুর এই বাড়বৃদ্ধিহীনতা,কেন তার বয়সের সঙ্গে বেমানান ওজনস্বল্পতা?কারণ "ছেঁড়া মা আর খোঁড়া শিশুর মধ্যে স্তন্যহীন অনন্ত শূন্যতা"।হ্যাঁ,স্বাস্থ্যহীন শৈশবের অন্যতম কারণ হাড় জিরজিরে মায়ের দল।যাদের শরীর আছে, স্বাস্থ্য নেই।আর সেই স্বাস্থ্যহীন শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে রক্ত নেই।মাতৃগর্ভেই ভারতীয় শিশু অপুষ্টির হানায় দিশাহারা হয়। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়ঃসীমার ভারতীয় মেয়েদের ৫৮°১ শতাংশ রক্তাল্পতার শিকার।ভারতের থেকে খারাপ অবস্থানে রয়েছে মাত্র তিনটি দেশ।নাইজেরিয়া ৫৮°৫ শতাংশ,মরিটানিয়া ৬১°২ শতাংশ এবং মালি ৬৩°০ শতাংশ।

   কথায় আছে দুর্জনের ছলের অভাব হয় না।ভারত রাষ্ট্রও মানুষের অস্তিত্বের প্রধানতম মৌল প্রয়োজন মেটানর ধারাবাহিক নির্লজ্জ ব্যর্থতাকে ঢাকাচাপা দিতে বানানো অজুহাত আর গলার জোরকে হাতিয়ার করে।প্রতিবারের মতো এবারেও বিশ্ব ক্ষুধা সূচককে উড়িয়ে দিয়েছে কারণ এই সূচক খিদের এক ভ্রান্ত পরিমাপ,গুরুতর পদ্ধতিগত ত্রুটিতে ভরা এবং বিদ্বেষপূর্ণ উদ্দেশ্য সঞ্জাত।ভারত সরকারের একটা বড় আপত্তির কারণ হল যে-চারটি মানদণ্ডকে ভিত্তি করে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক নির্মিত হয় তার তিনটিই শিশু-কেন্দ্রিক।সুতরাং,দেশের মাতব্বরদের দাবি আলোচ্য  সূচক সমগ্র জনসংখ্যার খাদ্যাবস্থার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।  আপত্তির বিশেষ ধরনটিই  শাসকের চরম সংবেদনহীন উদ্ধত লজ্জাহীনতার প্রমাণ।অভুক্ত শিশু অথচ ভরপেট পরিবার, পৃথিবীর কোনো সমাজেরই এরকম অতলস্পর্শী নির্বিবেক অধোগমন হয় নি।অনাহার ক্লিষ্ট, ফ্যাকাশে-দৃষ্টি অপুষ্ট শিশু  সমাজের সামগ্রিক অন্নহীনতার মাত্রার প্রতিফলক।সব বয়সের নারী পুরুষেরই পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন।তবু কবির কলমেও শিশুর উল্লেখ,"ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ,চায় দুটো ভাত, একটু নুন"।

   পরিসংখ্যানের সূত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে শাসক তার অযোগ্যতাকে আড়াল করার চেষ্টা করে।কিন্তু সেখানেও পার পাওয়া কঠিন।যে-দুই সংস্থা---Concern Worldwide ও  Welthungerhilfe--- সালওয়ারি বিশ্ব খাদ্য সূচক প্রস্তুত করে তারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যেসকল তথ্যসূত্রের সাহায্য নেয়  তা হলঃ UN Food and Agriculture Organization(FAO),United Nations Children's Fund(UNICEF),World Health Organization(WHO),World Bank,Demographic and Health Surveys(DHS) Programme,UN Inter-agency Group for Child Mortality Estimation(UN IGME)।শুধু তাই-ই নয়,ভারত সরকারের নিজস্ব পরিসংখ্যানও তার কাছে যথেষ্ট বিড়ম্বনাদায়ক।National Family Health Survey 5 (2019-2021)-তথ্য অনুসারে  দেশের ৩৫% শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম (Stunted)  এবং ১৯% শিশুর ওজন তাদের দৈর্ঘ্যের তুলনায় কম (Wasted)।বিশ্ব  স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী  ৩০%-এর বেশি কম উচ্চতা আর ১৫%-এর বেশি কম ওজন জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক।

   পৃথিবীতে প্রতিরাতে কমবেশি ৭৫ কোটি মানুষ পেটে খিদে নিয়ে ঘুমোতে যায়। প্রতি দশজনে প্রায়  একজন।কিরকম ঘুম তাদের হয় তা ভরাপেট মানুষদের অনুভব করতে হলে বিশেষ সাধনার প্রয়োজন।আবার শুধু পেট ভরলেই চলে না।দরকার সুষম আহারের।তবেই না শরীরের গড়ন-গঠন ঠিকঠাক হয়। জাতি সংঘের  Food And Agriculture Organization  জানাচ্ছে ২০২২ সালে ৩০০ কোটি পৃথিবীবাসীর উপযুক্ত পুষ্টিগুণ সমন্বিত খাবার জোটেনি।বাসি-পচা-পোকাধরা খাবারে পেট ভরলেও দেহযন্ত্র বিকল হতে পারে।ভোমার ছোট ভাইয়ের পরিণতি হতে পারে।বাদল সরকারের "ভোমা" নাটকের ভোমার "মা মরেছিলো সাপের কামড়ে।বাপকে কুমীরে টেনে নিয়ে গেছে ভোমার চোখের সামনে।ছোট ভাইটা লোনা জলে তেঁতুল মিশিয়ে খাওয়া সহ্য করতে না পেরে পেটের ব্যামোয় গেলো"

    জনসমাজে অভুক্তের সংখ্যা কমানর জন্য,শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা সহ সব বয়সের নারী-পুরুষের খিদেয় লাগাম পরানর জন্য স্বাধীনতা বা ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে অনেক পরিকল্পনা প্রকল্প যোজনার ভাবনা ও তাদের কিছু নিস্পৃহ-উদাসীন-আংশিক রূপায়ণ হয়েছে।এদের মধ্যে হালে যেগুলোর খুব বোলবোলাও তারা হল  Eat Right Movement,POSHAN Abhiyan,Mid-day Meal Scheme,Pradhanmantri Matru Vandana Yojna,National Food Security Act 2013, Mission Indradhanush,Integrated Child Development Scheme,PM Garib Kalyan Yojna । কিন্তু আজও গ্রাম-শহর-মফস্বলের কোটি কোটি নাগরিক ভরপেট সুষম আহার থেকে আলোক বর্ষ দূরে অবস্থান করে।তাই বাদাবন থেকে বন্ধ কারখানার শ্রমিক ঝুপরিতে নিযুত মানুষের শূন্য চাউনিতে ভোমার সংলাপের প্রতিধ্বনিঃ "ভাত হোলো বাবু?ভোমার ক্ষুধা লাগে"

    বাংলার ওপারের কবি লিখেছেন,"দু'বেলা দু'মুঠো পেলে ছেড়ে দেব অন্য-সব দাবি"।বাংলার এপারের কবি লেখেন পোড়া বাসি বা ভেজাল মেশানো রুটির বিনিময়ে "হেসে দিতে পারি স্বদেশের স্বাধীনতা"।খিদের জ্বালা এমন জ্বালা যে ধর্মাধর্ম চুলোয় যায়।   তাই কুকুরের সাথে ভাত নিয়ে লড়াই করতে করতে যে-ন্যাংটো ছেলেটা  একদিন পাগলা মেহের আলি হয়ে যায়, সে এ'রাস্তায় ও'রাস্তায় ছুটতে ছুটতে বলে বেড়ায়,"সব ঝুট হ্যায়!সব ঝুট হ্যায়!সব ঝুট হ্যায়! সব ঝুট হ্যায়''!ভাতের জন্য লড়তে লড়তে মেহের আলি পাগল হলেও তারই সত্য দর্শন ঘটেছে।তাই তার ব্রম্ভান্ড-কাঁপানো চীৎকার, "সব ঝুট হ্যায়!"

   উত্তর পাহাড় থেকে দক্ষিণ সাগর পর্যন্ত মেহের আলিদের উপচে পড়া ভীড়ের তোলপাড়ের অপেক্ষায় থাকা...

 

-----------------------------------------------

 

 

তথ্যসূত্র : 

* 2023 WORLD HUNGER INDEX

Power of Youth In Shaping Food Systems

*The World'Hungriest Countries by ACTION AGAINST HUNGER

*Hunger Increase in Restaurants for the Rich,a Serious Decline in Eating Places for Common People by Vidyadhar Date

*Status of India in Global Hunger Index SDGs:Challenges and initiatives

*Global Hunger Index 2023: India Reports Highest Child Wasting Rate by Arya Rohini

* Malnutrition by Action against Hunger

* Starved of data: India's hungry people go missing from FAO report by T.K.Rajalakshmi

*Hunger and food insecurity,FAO Report

* How do Indian states perform as far as hunger eradication is concerned by Nandlal Mishra

* On the Occasion of World Day,Our Demand for a Dignified Right to Food and Life for All by Aysha and Gangaram Paikra,Convenors,Right to Food Campaign

* Public Distribution System is much more than PMGKAY by Aysha and Gangaram Paikra,Convenors,Right to Food Campaign

 

লেখক সম্পর্কে

GRAPH_AVATAR_IMG
সন্দীপন মিত্র (সন্দীপন মিত্র)