২০২২ থেকে ২০২৩সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক সারণীতে ভারতের স্থান ১২৫টি দেশের মধ্যে ১০৭ থেকে নেমে ১১১নম্বরে পৌঁছেছে এবং দেখা যাচ্ছে শিশুমৃত্যু, অপুষ্টি আর অ্যানিমিয়ার ক্ষেত্রে ভারতের পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আবার পৃথিবীর যে পঞ্চাশটি দেশে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ সর্বনিম্ন ভারতবর্ষ সেই তালিকাতেও রয়েছে। পৃথিবীর যে সব দেশে চিকিৎসার সব থেকে বেশী খরচ রোগী বা তার পরিবার নিজেরা বহন করেন ভারত সেই তালিকায় রয়েছে পঞ্চম স্থানে। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও জনস্বাস্থ্যের বেহাল দশা। সরকারি তথ্য অনুসারে ২০১৯-২০২১ সময়সীমায় ভারতবর্ষের ৩৬টি রাজ্য ও ইউনিয়ন টেরিটরির মধ্যে আমাদের রাজ্য শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে রয়েছে সারণীর অষ্টম স্থানে। বয়সের অনুপাতে কম ওজনের শিশু এবং মহিলা অপুষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের রাজ্য রয়েছে সারণীর নবম স্থানে। বিশেষ করে করোনা মহামারীর সময় থেকে আমরা আরও বেশী করে দেখেছি যে দেশের মানুষের সার্বিক স্বাস্থ্য গড়ে তোলার দিকে বিন্দুমাত্র নজর না দিয়ে কেবল সংক্রামক রোগের চিকিৎসা এবং স্বল্পপরীক্ষিত টিকা ব্যবহার করে গণটিকাকরণ গুরুত্ব পেয়েছে। শিশুদের মিড ডে মিলের বরাদ্দ বাড়ে নি। দেশের মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে নিয়ে আসা হচ্ছে ফর্টিফায়েড চাল এবং জি এম শস্যের মতো বিতর্কিত প্রযুক্তি।

 

আমাদের সংগঠন জনস্বাস্থ্য মোর্চা ২০২২ সালে পত্তনের সময় থেকে সাজানো অতিমারীর স্বরূপ মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। আমরা বলেছি যে গঙ্গায় ভেসে আসা লাশের ছবি বা ড্রোন উড়িয়ে শ্মশানের জ্বলন্ত চিতার ভিডিও দেখিয়ে সেদিন প্যানিক আর গণ হিস্টিরিয়া তৈরি করা হয়েছিল। নানা কায়দায় মৃত্যুহারের পরিসংখ্যান বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল। আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম করোনা চিকিৎসার প্রোটোকল নিয়ে। অতিমারি ভাঁওতা তৈরির প্রক্রিয়ার পিছনে যে অর্থনৈতিক কারণগুলি সেদিন উপস্থিত ছিল সেগুলো আমরা মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি, যেখানে কর্পোরেটদের একচেটিয়া লুঠ আরও ব্যাপক এবং সংগঠিত ভাবে চালানোর জন্য বিশ্বব্যাপী একটি প্রক্রিয়া চলছে। এর ফলে নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভব হচ্ছে, নামে-বেনামে বহুজাতিক শিল্পনিগমগুলি কার্যত রাষ্ট্রকে এবং জাতিসঙ্ঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো অতিরাষ্ট্রিক সংস্থাগুলোকে পরিচালনা করছে। ‘উন্নত’ পশ্চিমী অর্থনীতিগুলো ভয়ানক মন্দার পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আজ। ২০১৯-এ মহামারী মহড়া শুরু হবার ঠিক আগে অর্থনীতি ছিল অত্যন্ত সঙ্কটজনক অবস্থায়। দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী বিলিয়োনেয়ার ক্লাবের কাছে তখন মন্দা থেকে বাঁচার একটা মরিয়া চেষ্টা চলছে। সেই মরিয়া চেষ্টারই অঙ্গ এই ‘মহামারী’। এই ‘কোভিড মহামারীর’ অজুহাতে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসছে এমন সব আইন কানুন যেখানে অধিকাংশ মানুষ তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্বাধীনতা ও মর্যাদাসম্পন্ন জীবনধারণের মৌলিক অধিকার থেকে আরও বঞ্চিত হবে। শুধু তাই নয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহামারী চুক্তি বা আগামী দিনে যে জনস্বাস্থ্য বিল আসতে চলেছে তার মধ্যে দিয়ে মানুষকে এক ধরনের স্বাস্থ্য নজরদারীর মধ্যে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। এধরনের 'একুশে আইনের' বিরোধিতা করতে হবে। একের পর এক সংক্রামক রোগের ভীতি তৈরি করা এবং জিন বদল করা ভ্যাকসিন নিতে বাধ্য করার ধারাবাহিক একটি প্রক্রিয়া জারি রয়েছে। জিন বদল করা ভ্যাকসিন কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করছে কিনা তা নিয়ে কোন পরীক্ষা নিরীক্ষার খবর সাধারণ মানুষকে জানানো হচ্ছে না। জিন পরিবর্তন প্রযুক্তির দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে বহুকাল ধরে। সেই স্বল্পপরীক্ষিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অতি দ্রুততার সাথে বাজারে নিয়ে আসা হয়েছিল করোনা টিকা। বিতর্কিত প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি এই করোনা টিকা কিন্তু ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই গণহারে প্রয়োগ করা হয়েছিল। এই ধরণের ভ্যাকসিন (বিশেষ করে জিন পরিবর্তিত) জোর করে নেওয়ানোর বিরোধিতা করতেই হবে। সংগঠিত এবং অসংগঠিত সরকারী-বেসরকারী উভয়ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি কিভাবে ভ্যাকসিন নেওয়াকে কাজে আসার শর্ত করা হয়েছে বা স্কুল-কলেজ খোলার শর্ত করা হয়েছে। এদিকে সুপ্রীম কোর্টে সরকার হলফনামা দিয়ে বলেছে যে নাগরিকরা স্বেচ্ছায় ভ্যাকসিন নিয়েছে, ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দায় সরকারের নয়। এই দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। কর্পোরেটদের স্বার্থে তাদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে বিশ্বকে নিয়ে আসার এই প্রক্রিয়া চরম জনবিরোধী এবং দমনমূলক। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আজ সময়ের দাবী।

এই সময়ে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের কাছে জনস্বাস্থ্য হয়ে উঠেছে জনমানুষের ওপর আক্রমণের হাতিয়ার, হাতিয়ার যা তাকে সুযোগ দিচ্ছে সাংবিধানিক পদ্ধতিরও তোয়াক্কা না করে ঘুরপথে যেকোনো দমনমূলক আইন পাশ করানোর - ‘শ্রম কোড’ থেকে শুরু করে ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’-একাধিক উদাহরণ আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি জনস্বাস্থ্য নিয়ে শাসকরা এতটাই চিন্তিত? দেশের জনমানুষের সার্বিক স্বাস্থ্যের ছবিটা তো অন্য কথা বলছে।

আমাদের দেশের চিকিৎসা-ব্যবস্থা মুনাফা-ভিত্তিক, একচেটিয়া কর্পোরেটদের লুঠের মৃগয়াক্ষেত্র। সরকারী হাসপাতালগুলোকে ধীরে ধীরে রুগ্ন করে দেওয়া এবং বেসরকারী নার্সিং হোম আর ডায়াগ্নস্টিকের রমরমা ব্যবসা চালানোর মাধ্যমে মানুষের পকেট কাটা ন্যায্যতা প্রাপ্ত হয়েছে। আর ডাক্তাররাও এই ব্যবসা চক্রের অঙ্গ হয়ে উঠেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে। ২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মোট ৯২ বিলিয়ন ডলারের মোট প্রায় ৬২% গেছে রোগীর পকেট থেকে। এদিকে সরকারের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ দিন দিন কমছে। এ বছরের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপির ২.২% থেকে কমে হয়েছে জিডিপির ১.৯%; যা আসলে দেশের সমগ্র বাজেটের শতাংশের হিসেবে আরও কম। আগে দেশের বাজেটের শতাংশের হিসেবে এই হিসেব দেওয়া হোতো। এখন সেই হিসেবে এই বরাদ্দ এতো কমে গেছে যে হিসেবটাই পাল্টে দেওয়া হয়েছে।

জনগণকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেবার নাম করে একটি বুজরুকি আমদানী করেছে কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারগুলো- যার নাম স্বাস্থ্যবীমা। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আয়ুস্মান ভারত প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেন। পোষাকি 'মোদিকেয়ার' নামের বাৎসরিক ৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবীমা প্রকল্পে ১০ কোটি পরিবারকে আওতাভুক্ত করা হবে বলা হয়। বাৎসরিক খরচ হবে প্রায় ১২০০০ কোটি। কেন্দ্রের মতো রাজ্য সরকারও এনেছে, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প। দুটো বীমাই জনগনকে বিনামূল্যে পরিষেবা দেবার নাম করে কার্যত বীমা কোম্পানির পকেট ভরার ব্যবস্থা। এজাতীয় স্বাস্থ্যবীমা প্রাথমিক ও আউডডোর পরিষেবায় কার্যকরী নয়। প্রসঙ্গত, সারা ভারতে চিকিৎসা পরিষেবার পিছনে জনতা যা খরচ করেন, তার প্রায় ৬৬ শতাংশ ব্যয় হয় আউটডোর চিকিৎসা ও ওষুধপত্র কিনতে,যা এরূপ চটকদারী স্বাস্থ্যবীমা প্রকল্প মোটেও কভার করেনা! ফলস্বরূপ সামান্য কিছু জটিল রোগের চিকিৎসায় কেবলমাত্র বীমা প্রযোজ্য। খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এড়িয়ে যাওয়া, কারণ তাতে কর্মক্ষেত্রে দৈনন্দিন মজুরির রাস্তা বন্ধ হয়। এদিকে বছরের শেষে প্রিমিয়ামের প্রায় পুরো টাকাই করদাতাদের পকেট থেকে যায় বীমা কোম্পানিগুলির পকেটে। এই বীমা ভিত্তিক স্বাস্থ্যকাঠামো স্বাস্থ্যের অধিকারের নাম করে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে স্বাস্থ্য পরিচয়পত্র বা হেলথ আই ডির মধ্যে বেঁধে ফেলে মানুষকে একধরনের স্বাস্থ্য নজরদারীর দিকে ঠেলে দেওয়ার রাস্তা পরিস্কার করছে। মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকারের স্লোগান 'সকলের জন্য স্বাস্থ্য' আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে বীমা কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন। বীমা নির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নয়, সকলের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করতে হবে সরকারী স্বাস্থ্য কাঠামোতে। তাই বীমা কোম্পানির বরাত দেওয়া বেসরকারী হাসপাতালের উপর নির্ভরতা নয়, বিনামূল্যে, যুক্তিপূর্ণ ও সঠিক মানের সরকারী স্বাস্থ্যপরিষেবা হয়ে উঠুক আগামীর স্বাস্থ্য আন্দোলনের দাবী।

 

আমাদের অঙ্গীকার হোক স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেসরকারীকরণ প্রতিহত করা, পরিকাঠামো ও ব্যয়বৃদ্ধিতে জোর দেওয়ার বিষয়ে সরকারকে বাধ্য করা। জনমানুষের স্বাস্থ্যের বুনিয়াদ হোলো রোগ প্রতিরোধ, পুষ্টিকর খাবার, পানীয় জল, বসবাসের এবং কর্মস্থলের পরিবেশ ইত্যাদি। স্বাস্থ্য ভিক্ষা নয়, জনতার অধিকার।

১৯৪৬ সালের ভোরা কমিটির রিপোর্ট সরকারের কাছে সুপারিশ করেছিল যাতে দেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব সরকার নেয়। কিন্তু শেষ অবধি ভারতীয় সংবিধানে স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।

 

বীমা নিবিড় স্বাস্থ্য পরিষেবার সাথে জুড়ে যায় মেডিকেল কমপ্লায়েন্স বা বাধ্যতামূলকভাবে ডাক্তারের কথা শুনে চলার বিষয়টি। করোনার সময় আমরা দেখেছি কিভাবে বকলমে অপরীক্ষিত টিকাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল জীবিকার শর্ত হিসেবে। বীমানিবিড় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্যা হল মানুষের চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করার ওপর বীমা কোম্পানিগুলো নানান নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে থাকে। ভারতবর্ষের প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রয়েছে চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করার। বীমা নিবিড় স্বাস্থ্য পরিষেবার নামে মানুষের এই সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না।

করোনা মহামারীর সময় পাড়ার বাজার বন্ধ রেখে অনলাইনে বেচা কেনা চালিয়ে কোন কর্পোরেট গোষ্ঠীর সুবিধা করে দেওয়া হয়েছে তা বিষদে বলার দরকার পড়ে না। আমাদের রাজ্যে আমরা দেখেছি করোনা মহামারীর জন্য প্রায় দুবছর স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখে অনলাইন শিক্ষার প্রহসনে শিশুদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার খেলা চলেছে। তার পরবর্তী সময়তেও বেশ কয়েকবার গরমের অজুহাতে বা অন্যান্য নানান ধর্মীয় কারণে অনিয়মিতভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। আতঙ্ক তৈরি করে বারে বারে স্কুল বন্ধ করার চেষ্টা রুখে দিতে হবে। যে কোন অজুহাতে ডেকে আনা পূর্ণ বা আংশিক লকডাউনের বিরোধিতা করতে হবে।

 

ইতিমধ্যে নানা মহলে এমন আলোচনা শোনা যাচ্ছে যে আমাদের রাজ্যে নাকি ৮০০০ স্কুল বন্ধ হতে চলেছে। যদি তাই হয় তাহলে এর পরিণতি মারাত্মক। স্কুলে জোর করে অপরীক্ষিত বা জিন পরিবর্তিত ভ্যাকসিন দেওয়া চলবে না। এ বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের বরাদ্দ ভয়ংকরভাবে কমানো হয়েছে। অথচ পরিসংখ্যান বলছে মিড ডে মিল খেয়ে যে প্রজন্ম বড় হয়েছে তারা যখন মা হচ্ছে তাদের বাচ্চাদের মধ্যে স্বাভাবিক শারীরিক বিকাশ ও বৃদ্ধির হার অনেক বেশী। শিশুদের পুষ্টির অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।

রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা যথাযথ তৈরি হওয়ার জন্য পুষ্টিকর খাদ্য এবং সুস্থ পরিবেশের গুরুত্ব অপরিহার্য। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার সমৃদ্ধ খাদ্যশস্য, জিন পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি শস্য, ফর্টিফাইড চাল, প্রভৃতি বিতর্কিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুষ্টির চাহিদা মেটানোর বিরোধিতা করছে জনস্বাস্থ্য মোর্চা। জিন প্রযুক্তির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির বিষয়ে জানা যেতে পারে, গাছপালা, পশুপাখি এবং মানুষের ওপর দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে। খাদ্য ও পানীয় দ্রব্য, শস্য, আনাজ, গবাদি পশু, এবং প্রতিষেধকে জিন বা অন্য যে কোন স্বল্প-পরীক্ষিত প্রযুক্তি যার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল জানা নেই তা গণহারে প্রয়োগ করা যাবে না।

 

আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞান ও সংশ্লিষ্ট অপরাপর বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রগুলির সংহতিকরণ, অবহেলিত ও প্রায় নিশ্চিহ্ন প্রাচ্য বিদ্যাশৃঙ্খলার সাথে আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রকে সংহত করতে চাই। এরই পাশাপাশি, রাষ্ট্রীয়, আধা-রাষ্ট্রীয়, ও বিরাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির দ্বারা পরিপোষিত ভুয়ো ও অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি ও তার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উপায়ে রোগীদের টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অপকৌশলের বিরোধিতা করাও আমাদের কাজ। জনমানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব আছে এমন যে কোনও বিষয়ে গবেষণাকে আমরা উৎসাহ প্রদান করবো। জনমানুষের প্রয়োজনে এই ধরণের সমস্ত গবেষণালব্ধ তথ্য আমরা প্রকাশ করবো মুদ্রন মাধ্যম বা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি জীবন যাপনের কোনও মৌলিক ক্ষেত্রে বৃহৎ পুঁজির একচেটিয়া আধিপত্য চলবে না। সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অনুসারে আমাদের সংগঠনের মতামত ও কর্মধারাগত বিশিষ্টতা অক্ষুণ্ন রেখে ভাতৃপ্রতিম যেকোন সংগঠনের সঙ্গে আমরা যৌথভাবে সাধারণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করব। আমাদের যাবতীয় বক্তব্য দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এবং বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে প্রচার করবো।

দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এবং ভাতৃপ্রতিম সংগঠনদের কাছে আমাদের আবেদন চিকিৎসা পরিষেবার ধারাবাহিক বেসরকারিকরণ এবং বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যবীমার নামে কর্পোরেট লবিকে পুষ্ট করার চক্রান্ত বাতিল করুন। পাড়ায় পাড়ায় ইউনিট গড়ে তুলুন যাতে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ব্লক হাসপাতাল বা সদর হাসপাতালগুলিতে সরকার উপযুক্ত পরিষেবা দিতে বাধ্য থাকে। স্বল্পপরীক্ষিত এবং বিতর্কিত জিন পরিবর্তন প্রযুক্তিতে তৈরি খাদ্য বা টিকার সর্বাঙ্গীণ বিরোধিতা করুন, সকলকে এর বিপদ সম্পর্কে সচেতন করুন। সংক্রামক রোগের ভয় দেখিয়ে MR, MMR, HPV, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, প্রভৃতি হরেক রকম জি এম টিকা নিতে মানুষকে বাধ্য করা হচ্ছে। এগুলির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হোন, শিশুদের এগুলির প্রভাব থেকে রক্ষা করুন। নিজের এলাকার জন প্রতিনিধিদের কাছে নিম্নোক্ত দাবীগুলো তুলুন।

 

এই অবস্থায় দাড়িয়ে জন স্বাস্থ্য মোর্চা দেশের এবং রাজ্যের সরকারের কাছে ন্যূনতম কিছু দাবী রাখছে।

যে রাজনৈতিক দলগুলো বিধানসভা বা লোকসভায় যাওয়ার জন্য ভোটে লড়বে তাদের কাছে আমাদের দাবী যে এই দাবীগুলো তুলুন। এই দাবীগুলো বাস্তবায়নের পক্ষে ব্যবস্থা নিন।

 

আমাদের দাবীঃ-

 

১। পুষ্টিকর খাদ্যের অধিকার, সুস্থ পরিবেশে বাঁচার অধিকার জনস্বাস্থ্যের প্রাথমিক দাবীসকলের জন্য সুষম আহার সুনিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। খাদ্যের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যাতে জন মানুষের আয়ত্ত্বের মধ্যে থাকে, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। সেই লক্ষ্যেই রেশন ব্যবস্থাকে দৃঢ় করতে হবে। পরিস্রুত পানীয় জল যাতে সব শহরবাসী, এবং গ্রামবাসীর কাছে পৌছোয় সেই উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। পরিবেশ-বান্ধব জ্বালানির দাম যাতে জন মানুষের আয়ত্ত্বের মধ্যে থাকে, সেই লক্ষ্যে তাতে যথেষ্ট ভর্তুকি দিতে হবে। আমাদের মতো দেশে যেখানে শিশু অপুষ্টির হার অত্যন্ত আশঙ্কাজনক সেখানে বিশেষ জোর দিতে হবে সরকারি বিদ্যালয়গুলির মিড ডে মিল কর্মসূচীতে। পরিমাণমতো সুষম পুষ্টিকর আহার সারাবছর প্রত্যেক স্কুল পড়ুয়াকে মিড ডে মিলে দিতে হবে। মিড ডে মিল খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

 

২। জনস্বাস্থ্য মানে শুধু চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান নয়, এর একটি সার্বিক দিক আছে- জন মানুষের স্বাস্থ্য গড়া এবং রোগ প্রতিরোধ মূলক স্বাস্থ্যের দিকটিতে জোর দিতে হবে। প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন প্রযুক্তি নয়, চিকিৎসা ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে বিজ্ঞানের মৌলিক নীতিগুলোকে। চিকিৎসার নামে বুজরুকি বন্ধ করতে হবে

 

৩। সরকারী হাসপাতালে এবং সমস্ত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বিনামূল্যে যুক্তিপূর্ণ স্বাস্থ্য পরিষেবা আমাদের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবাকে উন্নত করায় নজর দিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

 

৪। ভারতবর্ষের প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রয়েছে চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করার। মানুষের এই সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না।

 

৫। খাদ্য ও পানীয় দ্রব্য, শস্য, আনাজ, গবাদি পশু, এবং প্রতিষেধকে জিন বা অন্য যে কোন স্বল্প-পরীক্ষিত প্রযুক্তি যার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল জানা নেই তা গণহারে প্রয়োগ করা যাবে না।

 

৬। সকলের জন্য স্বাস্থ্য-কে সুরক্ষিত করতে হবে, স্বাস্থ্যবীমা কোনও বিকল্প নয়।

 

৭। লকডাউনের সময় ডি এম আক্টের জুলুমবাজি দিয়ে গণতান্ত্রিক পরিসরকে হত্যা করার যে চক্রান্ত আমরা দেখেছিলাম তার পুনরাবৃত্তি রুখে দিতে হবে। জনস্বাস্থ্য বিলের মতো দানবীয় আইন এনে জনস্বাস্থ্যকে কাজে লাগিয়ে অঘোষিত জরুরি ব্যবস্থা জারী করা বা মানুষকে স্বাস্থ্য নজরদারীর ঘেরাটোপে বেঁধে ফেলা চলবে না। একই কারণে হু মহামারী চুক্তিতে ভারতের সই করা চলবে না। নানান অজুহাতে চাপানো লকডাউনের বিরোধিতা করে যেতে হবে ধারাবাহিকভাবে।

 

৮। জিন পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মতো নতুন, স্বপ্ল-পরীক্ষিত এবং বিতর্কিত প্রযুক্তির টিকা গণহারে প্রয়োগ করার বিরোধিতা করছে জনস্বাস্থ্য মোর্চাকরোনার টিকার ক্লিনিকাল ট্রায়ালের সম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশ করতে হবে, টিকার কার্য্যকারীতা এবং পার্শ্বপ্তিক্রিয়ার তথ্য সরবরাহ করতে হবে। জনতার মধ্যে হৃদরোগ ও টিকার নানান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যখন লাগামছাড়া মাত্রায় পৌঁছেছে, আদালতে প্রশ্ন উঠেছে সরকারের ভূমিকা নিয়ে। এর দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে না সরকার। ভ্যাক্সিনের পাশ্বপ্রতিক্রিয়ায় প্রতিটা মৃত্যুর জন্য জবাব চাইছি সরকারের কাছে। কোভিডের সময়ে যক্ষ্মা, ক্যানসার সহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসা না পেয়ে কত মানুষ মারা গেল তার হিসেব দিক সরকার

 

৯। জন মানুষের বাসস্থান তৈরীতে সরকারকে অগ্রনী ভূমিকা নিতে হবে। গ্রামে এবং শহরে জন মানুষের বাসস্থান তৈরীতে সরকারকে কারিগরি সাহায্য এবং ভর্তুকি দিতে হবে। প্রতি বাড়িতে পাকা পায়খানার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখার জন্য সরকারকে আর্থিক এবং কারিগরি সাহায্য দিতে হবে।

 

১0। কারখানার ভেতরে এবং আশেপাশে পরিবেশের মান রক্ষা করার দায় সরকারকে নিতে হবে। কারখানা এবং বসতি উভয় ক্ষেত্রেই প্লাস্টিক বর্জন, কঠিন বর্জ্য পদার্থের যথাযথ ব্যবস্থা করা, এবং গাছ কাটার বিরুদ্ধে নীতি প্রনয়ণ করে তা কার্যকরী করতে হবে। জলাশয় এবং নদী সংরক্ষণের উদ্যোগ সরকারকে কার্যকরী ভাবে নিতে হবে। অবৈজ্ঞানিক এবং বেআইনি পদ্ধতিতে উন্নয়নের নামে ধারাবাহিক প্রকৃতি ধ্বংস করার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলুন।

 

 

জনস্বাস্থ্যকে হাতিয়ার করে সরকার (বকলমে কর্পোরেট) সাধারণ মানুষের ওপর আজ এক অভূতপূর্ব ধারাবাহিক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। নিজেদের তাগিদেই আজ আমাদের সংগঠিতভাবে এই আক্রমণকে প্রতিহত করতে হবে। জনস্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা এবং সেই অধিকার আদায়ের জন্য মানুষকে সংগঠিত করা জনস্বাস্থ্য মোর্চার আগামী দিনের লক্ষ্য।

 অক্টোবর, ২০২৩