নাগরিক অধিকারের মধ্যে যে অধিকারগুলির সাথে জড়িয়ে রয়েছে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক যাপন তার মধ্যে ন্যূনতম হলো, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। শিক্ষা ও সংস্কৃতির অধিকার কে শুধুমাত্র সংবিধানের ধারার মধ্যে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বহু লড়াই লড়তে হয়েছে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে বহু বছর ধরে। খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থান, ও স্বাস্থ্য কিন্তু আজও, সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। তথাকথিত স্বাধীনতার সাত দশক পেরিয়েও আমরা দেখেছি, অনাহার, অপুষ্টি, নিরক্ষরতার বেড়া টপকাতে পারেনি আমাদের দেশ। সামাজিক বৈষম্য, অসম বন্টনের আর্থ সামাজিক পরিকাঠামোই টিকে থেকেছে বহাল তবিয়তে। ১৯৮০র দশকে ভিত্তি তৈরী করে, ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিক থেকে ভারতরাষ্ট্র ক্রমে তার দরজা উন্মুক্ত করতে থাকে বৃহৎ লগ্নীকারীদের বিশ্ব বাজারে। বিদেশী লগ্নী ও বিদেশী ঋণ হাত ধরাধরি করে নিয়ে আসে একগুচ্ছ কাঠামোগত সংস্কারের দাবী। কাঠামোগত সংস্কারের শর্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত ঋণ স্বাস্থ্য বা শিক্ষার মতো জন-উন্নয়নমূলক কাজে খরচা করা যায় না। এই কাঠামোগত সংস্কারের ফলে পথ খুলে যায় দেশীয় বড়ো পুঁজিপতিদের জন্যও। সময়ের ঢাল বেয়ে এগোতে থাকে দুর্বার বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া। স্বাধীনতার পরেই যে জনকল্যানকামী রাষ্ট্র (welfare state) হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে সেটা পরিবর্তিত হয়ে পুঁজিকল্যানকামী রাষ্ট্র হয়ে গেছে। অর্থনীতির ভাষায় এমন রাষ্ট্রকেই বেশ কিছুকাল যাবত 'নব্য-উদার' বা neo-liberal আখ্যা দেওয়া হচ্ছে।যদিও এই উদারনৈতিকতা জনমানুষের জন্য কোনো উদারতা নয়। এ হোলো পুঁজিপতিদের জন্য রাষ্ট্রের উদারনৈতিকতা। বিগত বছরগুলির অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে যে উদারনীতির পথে হাঁটা ভারতবর্ষে উন্নয়ন-উচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। মানুষ বারে বারে গৃহহীন হয়েছে 'উন্নয়নের' স্বার্থে। খাদ্যের সংকট, অধরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা - এগুলো হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সমস্যা নয়। এসব কিছু ছিলোই, আছেই। তবুও 'উদার' উন্নয়নের নামে সমস্যা বেড়েছে বৈ কমে নি। রেল, বীমা, ব্যাঙ্ক, প্রভৃতি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে এগিয়েছে। বিলগ্নীকরণের নামে সরকারি শিল্পোদ্যোগের সম্পত্তি বেচার হিড়িক চালু হয়েছে অনেক বছর হল। তদুপরি গত দুইবছর ধরে আমরা পরিচিত হলাম আরেক নতুন সংকটের সাথে যার পরিনামে নাগরিক অধিকারগুলি শুধু যে লঙ্ঘন করা হলো তা নয় বরং তাকে পুরোপুরি পরিণত করা হলো খোলা বাজারের পণ্যে।

২০২০র মার্চ মাসে মুলধারার মিডিয়াগুলি আপনাকে আমাকে দেখাতে লাগলো চিন, ইটালির ছবি। 'কোভিড'-এ মৃত মানুষের ছবি। শুরু হলো আতঙ্কের প্রচার। সাধারণ মানুষের মনে এই আতঙ্কের চাষ করেই মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ঘোষিত হল লকডাউন। স্তব্ধ হয়ে গেল সমাজের সেই অংশের মানুষের সুস্থ সামাজিক জীবনের দাবী যাদের রুটি-রুজির প্রশ্নটি যুক্ত থাকে প্রতিদিনকার জনজীবনের সাথে। আতঙ্ক আর সাবধানতার ভাষ্যে মানুষ ঘরবন্দী হলেন। আমাদের বন্দীত্ব শুরু হল 'সামাজিক দূরত্ব'-এর সরকারি নির্দেশ মেনে। বন্ধ হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি হাসপাতালগুলিতে বন্ধ হলো সাধারণ চিকিৎসা। এমনকি ক্যান্সার, কিডনি সংক্রান্ত চিকিৎসার পরিষেবাও তখন মিললো না আর। লোকাল ট্রেনসহ অন্যান্য গণপরিবহন ব্যাবস্থা বন্ধ করা হলো। রোজগারহীন হলেন রেল হকার থেকে শুরু করে বিরাট অংশের শ্রমজীবি মানুষ যাদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকা লোকাল ট্রেনের চলার সাথে জড়িয়ে থাকে। আপনার পাড়ার ছোট ব্যবসার ওপর লকডাউনের নামে চলেছে পুলিশি জুলুম যদিও খোলা থেকেছে বৃহৎ পুঁজি নির্ভর সামগ্রী সম্ভারের হোম ডেলিভারি। আকস্মিক এই লকডাউন এক ধাক্কায় সমাজের বৃহৎ অংশকে সামাজিক ও অর্থনীতিক পরিমণ্ডলের বাইরে বের করে দিতে চাইলো। কারণ এরা বড়ো পুঁজির খরিদ্দার নয়। " ... ছেঁড়া জুতো পায়ে বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে " মাত্র। ঘরের সন্তানকে পাঠায় পাড়ার সরকারি বিদ্যালয়ে, প্রয়োজনে দ্বারস্থ হয় সরকারি চিকিৎসা পরিষেবার। এবং আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এইসব মানুষ যে সমস্ত ছোট ও খুচরো উদ্যোগের সাথে যুক্ত তাদের সম্মিলিত পুঁজি ভারতবর্ষের অর্থনীতির এক সুবৃহৎ অংশ। সরকারের পক্ষপাতপুষ্ট বড়ো পুঁজি ও বিদেশী পুঁজি বিগত কয়েক দশক ধরেই নানা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পদ্ধতিতে দখল নিতে চাইছিল এই বাজারের। অধুনা যেমন, দেশী-বিদেশী বৃহৎ লগ্নীকে সরকারি তরফে নানাপ্রকার বিশেষ ছাড়, স্বচ্ছ প্রশাসনের নামে বিমুদ্রাকরণ ও নেটভিত্তিক অর্থ লেনদেনে উৎসাহপ্রদান, এবং অঘোষিত 'জরুরি অবস্থা' জারি করে ছোট ও খুচরো উদ্যোগকে প্রতিযোগিতা থেকে অপসৃত করার এই হালের প্রচেষ্টা)
প্রচারমাধ্যাম অনায়াসেই অপবিজ্ঞান আর আতঙ্কের সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখে রাষ্ট্র, এই অমানবিক অর্থহীন স্বাস্থ্যবিধি প্রকরণের প্রতি সম্মতি আদায় করে নিলো সমাজের সেই শ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে যাদের লকডাউনে রুজি-রুটি মার যায়নি অথবা রোজগার বন্ধ হলেও সঞ্চয়ের জোর যাদের আছে। রেল হকার, স্থানীয় বাজারের বিক্রেতা, পরিচারিকা, শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের জীবন আসলে এই রাষ্ট্রের বা তার কোনো অঙ্গের কাছে কোনকালেই অর্থবহ ছিল না। তাই চাল, আলু, ডাল আর ছোলার রেশন দিয়েই সরকার খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চেয়েছে। 'কোভিড' থেকে বাঁচতে একদিকে প্রচার করা হয়েছে পুষ্টিকর সুষম খাদ্য খেতে অথচ শ্রমজীবি শ্রেণীর মানুষের পুষ্টি থেকেছে অনালোচিত, অপ্রাসঙ্গিক। দুইকেজি চালের ত্রাণ খাদ্যের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা এনে দিতে পারেনি। ডোল দিয়ে কোনদিন খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যায়ও না। বরং যেটা কিছুটা হলেও নিশ্চিত করা যায় তা হল সাধারন মানুষের ক্ষোভকে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বেঁধে রাখা। খাদ্য সংগ্রহের লাইনে দাঁড় করিয়ে তার ক্ষোভকে অন্য পথে চালিত করা। এবং এই সব লাইনে অব্যবস্থার ব্যবস্থা করে, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও মারামারিকে ইন্ধন দিয়ে তাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া।

খেয়াল করে দেখুন বিগত দুই বছরে যখন কোভিড বিধিকে মান্যতা দিয়ে আমি আপনি সামাজিক দূরত্ব পালনের দায় ঘাড়ে নিয়েছিলাম, বিধানসভা, লোকসভা, রাজ্যসভা, বিচারালয়তে ঠিক এই সময়েই, আমাদের দরজায় খিল দিয়ে রাখার সুযোগকে ব্যবহার করে নিয়েছে রাষ্ট্র। রেলের একটা বড় অংশকে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দিয়েছে সরকার। বেসরকারি সংস্থাগুলোতে চলেছে লাগামহীন ছাঁটাই। বন্ধ হয়েছে কল কারখানা, অফিস কাছারী, কমেছে মজুরি। আমাদের ঘাড়ে এসে চেপেছে, কৃষিবিল গুলো, শ্রমকোড গুলোর মতো কালা কানুন এবং নয়া শিক্ষা নীতির মতো শিক্ষার ওপর সরাসরি আক্রমণ।

স্কুল শিক্ষা বন্ধ রেখে শুরু করে দিয়েছে ই-স্কুল তথা অনলাইন পড়াশোনা। অনলাইন শিক্ষায় সামাজিক যৌথতা হারিয়ে শিক্ষার্থীদের একদিকে যেমন মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে অন্যদিকে শিক্ষা হয়ে গেছে নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য বরাদ্দ। ভারতবর্ষের মতো দেশে বাস্তবতা এটাই যে একবেলার খাবার সুরক্ষিত হলে তথা মিড ডে মিল পেলেই সরকারি শিক্ষার সুযোগ পায় সমাজের নব্বই শতাংশ শিক্ষার্থী। সেখানে স্কুল বন্ধ রেখে, মিড ডে মিল বন্ধ রেখে সমাজের বৃহৎ অংশের শিক্ষার অধিকার হয়েছে অপহৃত। সরকারি উদ্যোগে অনলাইন শিক্ষাকেই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু যে ছাত্রটির বাবা লকডাউনে রোজগারহীন হয়ে পড়েছেন তিনি চারশো টাকা ব্যয় করে মোবাইল রিচার্জ করবেন কোথা থেকে? বা যে দেশের বিশাল অংশে আজকেও নেট পরিষেবা নেই তারা শিক্ষা পাবে কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সরকার প্রয়োজন মনে করেনি। প্রয়োজন মনে করেনি, যখন শিক্ষা হয়ে যায় রিচার্জ নির্ভর তথা বাজারের পন্য তখন তা কি আর অধিকারের অন্তর্গত থাকে? এসব উত্তর তো দেয়নি, তার উপরে এই সময়েই শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিয়ে শিক্ষাকে পণ্য বানাতে স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড চালু করেছে রাজ্য সরকার। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের ঋণ নিয়ে পড়ার বন্দোবস্ত করেছে এই সরকার। এই ঋণ দেবে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাঙ্ক। শিক্ষার অধিকারকে নস্যাৎ করে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির মুনাফা বৃদ্ধি করার দায় নিয়েছে খোদ রাজ্য সরকার। সেখানে শিক্ষার্থীদের অবৈতনিক পড়াশোনার অধিকার অনিবার্য্যভাবেই আক্রান্ত হয়েছে। যদিও ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়। এই কোভিডকালেই আনা হয়েছে নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতি, ২০২০। যেখানে শিক্ষার বেসরকারিকরণের যাবতীয় ব্যবস্থা পাকাপাকি করার প্রস্তাব রয়েছে ।প্রস্তাবিত হয়েছে সরকারি স্কুলগুলিকে পিপিপি মডেলের আওতায় আনার পরিকল্পনাও। ছাত্র সংখ্যার বিচারে কিছু স্কুল উঠিয়ে দিয়ে সেইসব স্কুলের বাকি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অন্য স্কুলে নিয়ে যাওয়া হবে পঠন পাঠনের জন্য। জেলা স্কুল ধাঁচে ব্লক বা মহকুমায় একটা স্কুল থাকবে। আর PPP Model এ স্কুল হবে। স্কুল গুলোর প্রাইভেট পার্টনার হিসেবে কারা থাকবে? স্বাভাবিকভাবেই যাদের মূল লক্ষ্য মূলধন বাড়ানো। যারা আপনার দেশে ত্রাতার মুখোশ পড়ে ভ্যাকসিনের পসরা সাজিয়েছে, সেই বৃহৎ পুঁজিই। বলা যেতে পারে, জাতীয় শিক্ষা নীতি, ২০২০ কে কার্যকরী করতেই শিক্ষার বেসরকারিকরণের দায়িত্ব নিয়েছে রাজ্য সরকার। ব্যবহার করেছে লকডাউনকে। শ্রেণীকক্ষ থেকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে সরিয়ে দিয়ে জ্ঞানদাত্রী পদে সরকারি মদতে নিয়োগ করা হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে তৈরি কিছু 'অ্যাপ'। এবার বুঝছেন বাইজুস, টিউটোপিয়ার এত ঢক্বানিনাদ কেন? শিক্ষার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বা বিশ্লেষণ ক্ষমতার বিকাশ ঘটানোর বোধ করি আর প্রয়োজন নেই। শিক্ষার উদ্দেশ্য বহুদিনই পাল্টে গেছে। শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য কেবলমাত্র পেশাগত কর্মজগতের চাহিদার কথা মাথায় রেখে 'মানবসম্পদ' উৎপাদন করা। এই নয়া শিক্ষানীতি কার্য্যকর করার মধ্যে দিয়ে তার বোধহয় ষোলোকলা পূর্ণ হবে।

স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের ছবিটাও অবিকল এক। সরকারি হাসপাতালগুলিতে পিপিপি মডেলের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল কয়েক দশক আগেই। এই পিপিপি মডেলের একটা প্রচলিত বাংলা অনুবাদ আছে - পাবলিকের পয়সায় পুঁজির মুনাফা। এই মডেলে প্যাথলজিক্যাল কেন্দ্রগুলি সরকারি হাসপাতালের মধ্যেই বেসরকারি সংস্থার অধীন ছিল। অর্থাৎ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীকে ওষুধ কিনতে হত হয় পিপিপি মডেল এর দোকান থেকে অথবা বাইরে থেকে। পরীক্ষা করাতে হত নিজের পকেট থেকেই। নাগরিকদের সম্মতি আদায়ের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা ছিল এক বাধ্যতামূলক অধিকার হারানোর ব্যবস্থা। এরপর কোভিড পরিস্থিতি সরকারি স্বাস্থ্য কাঠামোর ভগ্নদশাকে আরেকবার সামনে এনে উন্মোচিত করলো সরকারের দেউলিয়াপনাকে। কোভিডের অজুহাতে অন্যান্য সমস্ত রোগের চিকিৎসা এক ধাক্কায় বন্ধ করে দেওয়া হল। পরিসংখ্যান বলছে ২০২০ সালে ভারতে যক্ষ্মা রোগের প্রাদুর্ভাব ১৩% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২০তে এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে। যে সব রোগে আগে চিকিৎসা অনেক সহজলভ্য ছিল সেইসব রোগের চিকিৎসাও আজ সাধারন মানুষের কাছে অধরা হয়ে গেছে। বহু সরকারি হাসপাতালে গত দুবছর বেড খালি থাকলেও কোভিড ছাড়া অন্য রুগী ভর্তি নেওয়া হয়নি বা আউটডোরেও চিকিৎসা মেলেনি। এর ওপর স্বাস্থ্য সাথী কার্ডের মাধ্যমে রাজ্য সরকার সরকারী হাসপাতালের স্বাস্থ্য পরিষেবাকে পরিণত করেছে বেসরকারি বীমা কোম্পানীর পণ্যে। বেসরকারি হাসপাতালে, বেসরকারি বীমা কোম্পানির মুনাফা লোটার বন্দোবস্ত করছে সরকারী কোষাগার থেকে। রাজ্য সরকারের প্রচেষ্টাতেই সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য আজ বেসরকারি বীমা কোম্পানীর মুনাফার মৃগয়াক্ষেত্র।
পরিকল্পিতভাবেই সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে ভেঙে ফেলা হয়েছে, ১৯৯০ এর দশক থেকেই। সেই ধারারও বোধহয় ষোলো কলা পূর্ণ হয়েছে এই কোভিড কালে। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার আজ অবলুপ্তপ্রায়।

আমাদের পর্যবেক্ষণ :-
১) ছোট ব্যবসায়ী, অসংগঠিতক্ষেত্রের শ্রমিক, কৃষক, কৃষিশ্রমিক সহ সমাজের শ্রমজীবি মানুষ লকডাউনে যেভাবে সর্বস্বান্ত হয়েছেন যে জীবন জীবিকার বিপন্নতার সময়ে বাধ্য হয়েই সরকারি ত্রাণ আর প্রকল্প নির্ভর হয়ে পরেছেন তারা। সরকারের উদ্দেশ্যও ছিল তাই। মানুষের অধিকার বিপন্ন করে, সরকারি ভিক্ষের লাইনে দাঁড় করিয়ে তাদের স্বত্যন্ত্র জীবিকা নির্বাহের উপায়কে চিরকালের মত নস্যাৎ করে বৃহৎ পুঁজির বাজার দখল করার প্রকল্পকেই মদত দিয়েছে রাষ্ট্র।
২)লকডাউন নাগরিকদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করেছিল। রাষ্ট্র ঘোষিত কোভিড ভাষ্যের বিপরীতে বিকল্প ভাষ্যও যে উঠে আসছিল তা রাষ্ট্রীয় মদতেই চেপে দেওয়া হয়েছে , সুযোগ করে দিয়েছে লকডাউন।
৩) সংক্রমণের ভয় দেখিয়ে, আতঙ্ক ছড়িয়ে সংক্রমণকেই মুখ্য সমস্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। উচ্চমধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একাংশের জীবিকা ও উপার্জন নিশ্চিত ছিল। তাই লকডাউন, কোভিড বিধি মেনে চলায় তাদের সমর্থন ছিলোই। সরকার সেই সমর্থনকেই ব্যবহার করেছিল। নাগরিকদের পারষ্পরিক আর্থ - সামাজিক নির্ভরতা ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়েছিল লকডাউনের কারণেই। এই নির্ভরতার জায়গা নিল শপিং মল থেকে শুরু করে অ্যামাজন, ফ্লিপ কার্টের মতো একচেটিয়া পুঁজি। বৈষম্য বাড়লো। একচেটিয়া পুঁজির কারবারিদের মুনাফা বাড়লো। মধ্যবিত্তরা নিম্নবিত্তে পরিণত হলেন। নিম্নবিত্তরা কোথায় গিয়ে দাঁড়ালেন জানা গেলনা। কেউ কাজ হারালেন, কেউ চুক্তিভিত্তিক কাজে কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হলেন আবার কেউবা প্রতিকূল এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পেরে আত্মহত্যাও করলেন।সামাজিক অস্থিরতার এই সময়টাই উপযুক্ত ছিল একের পর এক জনবিরোধী আইন, বিল পাস করানোর। সেই কাজ রাষ্ট্র সেরেও ফেললো।

এই আগ্রাসী বেসরকারিকরণের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হল সামগ্রিকভাবে লকডাউনের বিরোধীতা করা। সংগঠিত সম্মিলিত মানুষের গলার জোর সবথেকে বেশি। আমাদের সাংবিধানিক অধিকার যাতে কারো অযত্নে ছুঁড়ে দেওয়া দান না হয়ে যায় তা নিশ্চিত করার স্বার্থে, বড়ো পুঁজির থাবা থেকে বাঁচতে, সঙ্গবদ্ধ হওয়াই আজ আশু প্রয়োজন ।

এই খসড়াটি সম্পর্কে আপনার মতামত পাঠাতে পারেন এই ইমেইল ঠিকানাটি spambots থেকে রক্ষা করা হচ্ছে। এটি দেখতে হলে আপনার জাভা স্ক্রিপ্ট সক্রিয় থাকতে হবে। -এ।