খাদ্য - বস্ত্র - বাসস্থান নিঃসন্দেহে মানব জীবনের সব থেকে মৌলিক চাহিদা। কিন্তু মানুষ যেহেতু পশুমাত্র নয়, সে মানুষ - অর্থাৎ মান ও হুশ আছে যার এমন প্রাণী, অতএব এই তিনটি মৌলিক চাহিদা ব্যতিরেকেও তার জীবনে আরো কিছু আবশ্যিক চাহিদা রয়েই যায়। যেমন সুস্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং এক সুস্থ সমাজবদ্ধ জীবন যার জন্য একান্তভাবে প্রয়োজন ব্যাক্তিগত ও সমষ্টিগত মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। সমাজবদ্ধ জীবন সুসংহত করার এই চাহিদা থেকেই তৈরী হয় সংগঠিত হওয়া বা সমবেতভাবে প্রয়োজনে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আবশ্যিকতা।

বিভিন্ন রাষ্ট্রের সংবিধানে জীবনের অধিকার মানুষের fundamental right বা মৌলিক অধিকাররূপে স্বীকৃত। ভারতীয় সংবিধানেও তাই। আর জীবনের অধিকার সুনিশ্চিত করতে গেলে উপরিউক্ত ছটা অধিকারকে বাদ দিয়ে সেটা সম্ভব নয়। একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোয় দেশের মানুষ রাষ্ট্রের সরকারকে অছি রাখে বা দায়িত্ব দেয় সাধারণ মানুষের এই অর্জিত অধিকারগুলিকে বলবৎ রাখার।
কিন্তু সর্ষের মধ্যেই যে ভূত! গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বারে বারে বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে অধিকারের রক্ষক সরকার হয়ে উঠেছে মুখ্য অধিকার হরণকারী। যখন এইসমস্ত দেশের জনতা পথে নেমেছে সরকারকে তার দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন করতে তখন সরকার তাদের ওপর বিবিধ দমন - পীড়ন নামিয়ে এনেছে। জনতা ও রাষ্ট্রের এই দ্বন্দ্বে জয় কখনো হয়েছে জনতার, কখনো বা সরকারের পক্ষে।

বিগত দুই বছরে আমরা দেখেছি পৃথিবী জুড়ে অধিকাংশ দেশের সরকার কোভিডের দোহাই দিয়ে জনস্বাস্থ্যের সংজ্ঞাকে দুমড়ে - মুচড়ে জনস্বাস্থ্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের জন্য। যে সরকারকে আস্থাভরে মানুষ অছি রেখেছিল তার দাঁত - নখ বের হয়ে পাশবিক চেহারা ক্রমশ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভারত রাষ্ট্রও একই কাজ করেছে।

ফিরে তাকানো যাক ২০২০ সালের মার্চ মাসে। গোটা দেশ জুড়ে তখন CAA – NRC বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। ঠিক এই সময়েই ঝুলি থেকে বেরলো করোনার ভূত। 'জনস্বাস্থ্য' -এর অজুহাতে হারিয়ে গেল ' নাগরিকত্ব ' ঘিরে যতো প্রশ্ন ছিল। অপহৃত হল জমায়েত করা, সভা করা, শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ - প্রতিরোধ করার নাগরিক অধিকার। দেশ জুড়ে তখন মঞ্চ ভাঙার ছবি। বলপূর্বক উঠিয়ে দেওয়া হল শাহিনবাগ আন্দোলন। সরকারি ও বেসরকারি অনুদানপুষ্ট প্রচারমাধ্যমগুলো একজোটে সমস্ত আন্দোলনকারীদের ' অপরাধী ' চিহ্নিত করলো। সরকারের সাথে মিডিয়াও ফরমান জারি করলো প্রত্যেক মানুষকে গৃহবন্দী করার। মখমলের দস্তানার তলা থেকে বেরিয়ে এলো শাসকের ধারালো নখ।
গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমের নক্কারজনক ভূমিকা নিয়ে প্রচুর আলোচনা নানাদিকেই হয়েছে। দেখা যাক গণতন্ত্রের বাকি তিনটি স্তম্ভের কি ভূমিকা ছিল এসময়ে। প্রথমে আমরা আলোচনা করব বিজ্ঞ বিচারক বর্গের ভূমিকা নিয়ে।
লকডাউন শুরু হতে না হতে ২০ মার্চ, ২০২০ দিল্লি হাইকোর্ট অর্ডার দেয় ১৯৬৩ সালের লিমিটেশন অ্যাক্টের ৪নং ধারা মোতাবেক আদালতের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এরপর সুপ্রিম কোর্ট একটি অর্ডারে বলেন -" এক্সট্রিমলি আর্জেন্ট ম্যাটার" ছাড়া আদালতে আর কোন কাজকর্ম হবেনা। শুধুমাত্র অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শুনানি হবে ভার্চুয়াল বা অনলাইন মাধ্যমে। এর ফলে প্রচুর মামলা জমে যায়। বহু বিচারধীন বন্দীকে বেল জোগাড় করতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। সবটাই হয় প্রচলিত কোভিড ভাষ্যকে ব্যবহার করে। ২০১৯ সালে ভারতবর্ষের সমস্ত বিচারালয় মিলিয়ে নিষ্পত্তি না হওয়া মামলার সংখ্যা ছিল মোট ৩.৩কোটি। ২০২০ - ২০২১ সালে নিয়মিতভাবে বিচারব্যাবস্থাকে অনিয়মিত করে রাখার ফলে প্রায় ১৯% বৃদ্ধি ঘটে এই সংখ্যার। বিচারব্যাবস্থা সাধারনের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।

এরপর দেখা যাক বিধান প্রণয়নকারী পারিষদবর্গ যারা বিধানসভা, লোকসভা, রাজ্যসভায় ' গণতান্ত্রিক ' পদ্ধতি মারফত সাধারণ জনতা কর্তৃক নির্বাচিত হন, তাঁরা কি ভূমিকা রেখেছেন এসময়ে।
২০২০র সেপ্টেম্বর মাসে বর্ষাকালীন অধিবেশনে ২২টি বিল (১৬টি লোকসভায় ও ৬ টি রাজ্যসভায়) নতুনকরে পেশ করা হয়। মোট ২৫টি বিল কার্যত আলোচনা ছাড়া পাশ হয়। স্বল্প সময়ের অধিবেশনে গড়ে প্রতিদিন ২.৭ টি বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। এইসময় - ৩টি কৃষিবিল, এপিডেমিক ডিজিজ সংশোধনী, মন্ত্রীদের বেতনবৃদ্ধির বিল, কোম্পানি আইন সংশোধনী, কোম্পানি দেউলিয়া হওয়ার কোড, শ্রমকোড, বিদেশী বিনিয়োগ সংশোধনী, স্বাস্থ্য, শিক্ষা সহ জম্মু - কাশ্মীরের সরকারি ভাষা বদল প্রভৃতি একগুচ্ছ বিল পাশ করা হয় নিতান্ত অগণতান্ত্রিক ভাবে।

সংসদীয় গণতন্ত্রে আইন প্রণয়ন করা মানে ফরমান জারি করা নয়। মন্ত্রণা, পরামর্শ, আলোচনা - প্রতি আলোচনা, প্রয়োজনে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ মণ্ডলীর উপদেশ - এসবের সংশ্লেষে প্রতিটি নতুন আইন হওয়া উচিত এক পরিণত চিন্তা পদ্ধতির প্রকাশ। বিগত দশ বছরে বারে বারে এই পদ্ধতিকে বুড়ো আঙুল দেখানো হয়েছে। ২০১৪ সালে বারে বারে রাজ্যসভায় নাকাল হয়ে সরকার জরুরি অবস্থার 'ভান' করেছে। সংসদ চালু থাকাকালীন আলোচনা পাশ কাটিয়ে সরকারপক্ষ একতরফাভাবে বেশ কয়েকটি ordinance বা অধ্যাদেশ জারি করে। এইসব অপকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য - বীমা বিলে ৪৯% বিদেশি লগ্নীর অধ্যাদেশ, কয়লা ব্লক বেসরকারি সংস্থাকে নিলাম করার অধ্যাদেশ, জমি অধিগ্রহণ বিলে আমূল পরিবর্তনের জন্য অধ্যাদেশ। ২০১৪য় হাত পড়ে শ্রম আইনেও। কার্যত 'কারখানা' শব্দটির সংজ্ঞা বদলে দিয়ে এক ধাক্কায় দেশের ৮০% শ্রমিকের ন্যুনতম মজুরি, নির্দিষ্ট কাজের ঘণ্টা, ওভারটাইম, ভবিষ্যনিধি (PF) , ESI প্রভৃতি সুযোগ সুবিধা নাকচ করে দেওয়া হয়। এমনিতেই দেশের প্রায় ৫০০ বিশেষ আর্থিক অঞ্চল (SEZ) বা বিশেষ রপ্তানি অঞ্চলে (EPZ) শ্রমিকের অধিকারের কথা 'প্রেতের অট্টহাসির' মতো শোনায়। সংগঠিত অন্য ক্ষেত্রেও ন্যুনতম মজুরি না দেওয়া এবং PF – ESI এর টাকা মেরে দেওয়াই দস্তুর - সাধারন শ্রমিকের হাজার হাজার কোটি টাকা অনাদায়ী হয়ে পড়ে আছে। এরপর ২০১৯ সালে সরকার কোমর বেঁধে নামে পুরনো ৪৪টি কেন্দ্রীয় শ্রম আইন বাতিল করে চারটি নতুন শ্রমকোড আনার জন্য। সরকারপক্ষের যুক্তি হল এই নতুন শ্রমকোড নুইয়ে পড়া জাতীয় অর্থনীতিকে আবার চাঙ্গা করে তুলবে। ব্যবসা বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে দেশের সর্বত্র ।
এই চারটি নতুন বিলের মধ্যে একটি (ন্যুনতম মজুরি সংক্রান্ত আইন) পাশ হয় ২০১৯ সালে এবং বাকি তিনটি কোড পাশ হয় ২০২০র বর্ষাকালীন অধিবেশনে। বলাই বাহুল্য এক্ষেত্রে বিতর্ক বা আলোচনার অবকাশ বিশেষ ছিল না। সরকারপক্ষ নির্দ্বিধায় আস্থা রাখে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর। দেশজুড়ে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন প্রতিবাদ জানাচ্ছে এই চারটি নতুন আইনের বিরিদ্ধে। শ্রম আইনের এই নতুন সংস্কার প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষকে সাধারন খেটে খাওয়া মানুষের বধ্যভূমিতে পরিণত করবে । ২০১৭ সালে সৎপতি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ন্যুনতম দৈনিক মজুরি যা হওয়া উচিত ছিল তা এই আইনে ফলিত হয়নি। এই নতুন আইনে শ্রমিক হারাতে চলেছে তার সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার এবং নিয়োগকর্তা পাচ্ছেন ’hire and fire at will’ এর স্বাধীনতা। সাধারন মানুষের স্থায়ী চাকরির স্বপ্ন চিরকালের জন্য চলে যাবে ইতিহাসের মণিকোঠায়। ইতিমধ্যেই উত্তরপ্রদেশ সরকার নতুন আইন মোতাবেক ১২ ঘণ্টার শ্রমদিবস লাগু করার চেষ্টা করেছে। এক্ষেত্রে যেটা লক্ষণীয় তা হল কার্যত এতদিন ৮ঘণ্টা শ্রমদিবসের আইন বলবত থাকলেও কার্যক্ষেত্রে দেখা যেত তা পালিত হচ্ছেনা। বিশেষ করে বেসরকারি ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমদিবস সংক্রান্ত আইন এর আগেও মেনে চলা হতো না। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা এই নতুন শ্রমকোড। বহু বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জিত ৮ঘণ্টার শ্রমদিবসের অধিকার এবার আইন করে ছিনিয়ে নেওয়া হল । আর এর বিরুদ্ধে আপনি - আমি রাস্তায় নেবে প্রতিবাদ করতে পারবো না - ওই যে আরও কিসব (নতুন ও পুরনো মিশিয়ে ) আইন চালু আছে যেমন মহামারী আইন, DM Act, ইত্যাদি। অতএব আইনমাত্রই এখন ফরমান। শ্রমিকের অধিকার ও শ্রমের নিশ্চয়তার বিপ্রতীপ অবস্থানে থাকা দেশি-বিদেশি বেসরকারি পুঁজির চাটুকারে পরিণত হয়েছে রাষ্ট্র। জনতার অছি আজ পুরোপুরি জনবিমুখ ।

২০২০র ২০শে সেপ্টেম্বর, রবিবার রাজ্যসভার এক বিশেষ অধিবেশনে ধ্বনি ভোটের মাধ্যমে পাশ করা হয় তিনটি কৃষিবিল। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, যে বিষয়ে ঐক্যমত নেই, সেই বিষয়ের ওপর বিল ধ্বনিভোটের মাধ্যমে পাশ করানোর এই প্রক্রিয়া চরম অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রতিক ভারতীয় ইতিহাসে নজিরবিহীন। ভারতবর্ষের কৃষিক্ষেত্রে সংকট নতুন নয়। বরং কৃষির সংকট না বলে এটাকে কৃষকের সংকট বলা ভালো। কারণ ভারতবর্ষে পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বেশি আবাদযোগ্য জমি রয়েছে। চাল উৎপাদনে আমাদের দেশ প্রথম, ফল ও সব্জি উৎপাদনে দ্বিতীয়। গবাদি পশুর সর্ব বৃহৎ ভাণ্ডার এদেশে। কিন্তু এমন কৃষিসমৃদ্ধ দেশে কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা সেই নব্বই-এর দশকের শেষ ভাগ থেকেই প্রায় সকলের গা-সওয়া হয়ে গেছে। সমীক্ষা বলছে ২০২০ সালে এধরনের আত্মহত্যার ঘটনা তার আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৮% । UPA ও NDA সরকার ধারাবাহিকভাবে কৃষিক্ষেত্রে যা যা সংস্কার এনে গেছে তাতে ক্রমশ দেশজ কৃষি ও বণ্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। উচ্চপ্রযুক্তি নির্ভর রপ্তানিমূলক বাণিজ্যিক কৃষি ব্যবস্থার পথ সুগম হয়েছে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ভারতের কৃষিভাণ্ডার বিশ্বের খাদ্যসংকটে খাদ্যপন্য জোগান দেবে কিন্তু এদেশের সাধারন মানুষ অনাহারক্লিষ্ট ও অপুষ্টি জর্জরিতই থাকবে। এপ্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো ২০২১ সালে ভারতের Global Hunger Index score হল ২৭.৫ এবং GHI rank ( ১১৬ টি দেশের মধ্যে ) হল ১০১।
২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের পর কেন্দ্রীয় সরকার দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের আওয়াজ তোলে। সরকার বিপ্লবের ডাক দিলে বোঝা যায় বিপদ শিয়রে আসীন। এই দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের ডাক আদতে ছিল চুক্তিচাষের পথ সুগম করা ও রপ্তানিযোগ্য বাণিজ্যিক ফসলের চাষাবাদ বৃদ্ধি। চুক্তিচাষের শর্ত অনুযায়ী ঋণপ্রদায়ী সংস্থা ঠিক করবে কি চাষ হবে, কোন বীজ দিয়ে চাষ হবে, ফসলের দাম কত হবে, এমনকি ফসলের চাহিদা আছে কিনা সেটাও। ভারতবর্ষের ও গোটা পৃথিবীর উচ্চ আয় সম্পন্ন মানুষের চাহিদা নির্ধারণ করবে কি ধরনের চাল চাষি তার জমিতে রুইবে। কৃষকের শ্রম ও জীবনের বিনিময়ে সচ্ছল শহুরে মানুষের খাবার থালায় বাসমতী চালের অভাব হবে না। বাসমতী চালের সুগন্ধ যে সাধারন কৃষকের ক্রয় ক্ষমতার গণ্ডির এক্কেবারে বাইরে শুধু তাই নয়, তার সন্তানের জন্য মোটা চালের ভাত জোটানোই কৃষকের প্রতি দিন কার বেঁচে থাকার লড়াই।
কৃষককে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কৃষিজমির কথা এসেই পড়ে। ২০০০ সালের পর থেকে নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, কলিঙ্গনগর, নিয়মগিরি, নর্মদা উপত্যকা প্রভৃতি স্থানে সরকার বা বাণিজ্যিক সংস্থা দ্বারা উন্নয়নের নামে জমি দখলের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন আগুনের মতো বারে বারে জ্বলে ওঠে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, অসরকারি - স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও নানা সামাজিক সংস্থার আলাপ-আলোচনা এবং টানাপোড়েনের পর ২০১১ সালে UPA সরকার জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত আইনে কিছু পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয় । কিন্তু ২০১৪ সালে অধ্যাদেশ জারি করে আবার খর্ব করা হয় জমির মালিক বা কৃষকের অধিকার। এরপর ২০২০ সালে পাশ হওয়া তিনটি কৃষিবিলকে কৃষকের কফিনে শেষ পেরেক বলা যেতে পারতো। মান্ডি ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলুপ্তির সাথে সার্বিক বেসরকারিকরনের পথ খুলে দিত এই তিনটি কৃষি বিল। কিন্তু সরকারি দমন পীড়নকে তোয়াক্কা না করে সর্বভারতীয় স্তরে যৌথ কৃষক মঞ্চ তৈরি হয় ও দীর্ঘ এক বছরব্যাপী সংগ্রামের মাধ্যমে কৃষক সংগঠনরা কেন্দ্রীয় সরকারকে বাধ্য করে ২০২১ সালের শীতকালীন অধিবেশনে এই তিনটি কৃষিবিল প্রত্যাহার করতে। অগণতান্ত্রিক উপায়ে পাশ করানো আইন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অপসৃত হয়। বিগত দুই বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেখানে বারে বারে গণতন্ত্রের কাঠামোয় ভাঙ্গন লক্ষ্য করা গেছে সেখানে কৃষক আন্দোলনের এই সাফল্য নিঃসন্দেহে খেটে খাওয়া মানুষের জয়।

তবে রাষ্ট্রের যে ভয়াল চেহারা (জাতীয় ও রাজ্যস্তরে) বিগত কয়েক দশক ধরে ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছিল, যা এখনো অবধি করোনাকালে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে, তার অবলুপ্তি কোন বিচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সম্ভব নয়। এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য যে তিনটি কৃষিবিল প্রত্যাহার করা হলেও সংগ্রামী কৃষকদের সমস্ত দাবী এখনো সরকারপক্ষ বলবত করেনি। ফসলের ন্যূনতম সহায়কমূল্য যাতে কৃষকরা পায় তার জন্য কৃষক সংগঠনের অংশগ্রহণে এক কমিটি গঠনের লিখিত প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছিল। জমায়েত করার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের জন্য সংগ্রামী কৃষকদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা দায়ের হয়েছিল সেগুলিও এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। অর্থাৎ 'গণতন্ত্রের স্তম্ভ গুলো' মোটেই অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ড থেকে বেরিয়ে আসেনি।

সবশেষে দেখবো বিগত সময়ে শাসনকার্যের পরিচালকমণ্ডলী বা নির্বাহিকবর্গের কি ভূমিকা ছিল। কথায় বলে, জমিদারের পেয়াদা ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। ২০২০র মার্চ মাস থেকেই কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যস্তরের নির্বাহিকমণ্ডলী মহামারী আইন ও DM Actকে হাতিয়ার করে লকডাউন পালন করার একের পর এক ফরমান জারি করে যাচ্ছে। সংবিধানে স্বীকৃত স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা ও জীবিকা নির্বাহ করার আধিকার আজ এইসব ফরমানের সামনে ভুলুণ্ঠিত। স্বাস্থ্যমন্ত্রক ও কেন্দ্রীয় সরকার (কোর্টে হলফনামা মারফত) যদিও জানাচ্ছে যে টিকাকরণ বাধ্যতামূলক বা আবশ্যিক নয়, তবুও রাজ্যস্তরে বিভিন্ন executive order এর ফরমানে টিকাকে আনলকের শর্ত হিসেবে রাখা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে পার্কে ভ্রমণ করতে গেলে বা বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে রাত্রি যাপন করার জন্য টিকাকরণ আবশ্যিক। আর পরিবহন, পর্যটন, নির্মানশিল্প, রেস্তোরাঁ, বিভিন্ন বেসরকারি উদ্যোগ (এর মধ্যে IT এবং ITES sector অন্তর্গত) প্রভৃতি ক্ষেত্রে টিকাকরণ জীবিকার শর্ত। এবিষয়ে কলকাতা উচ্চ আদালত জনস্বার্থ মামলা খারিজ করে দিয়েছে । এরকম খটমট বিষয় নিয়ে আদালত বিতর্কে জড়াতে চায় না। একদিকে ধারাবাহিক লকডাউন, লকডাউনের জন্য জীবিকার অনিশ্চয়তা, অনিয়মিত রেল ও অন্যান্য পরিবহন পরিষেবা এবং অন্যদিকে সংকুচিত মিড ডে মিল ও ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসা রেশন ব্যাবস্থা । এসবের মাঝে দেশের সর্বোচ্চ চাল উৎপাদন কারী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ অভুক্ত। ২০২০ সালের অক্টোবর - নভেম্বর মাসে হওয়া একটি সমীক্ষায় উঠে আসে যে বিগত ৩০দিনে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৮.৭% মানুষ রাতে অভুক্ত ঘুমোতে গেছে এবং ৪৪% মানুষ খাদ্যসংস্থানের জন্য ধার করতে বাধ্য হয়েছে। যদিও প্রায় ৬৫% মানুষ তাদের দৈনন্দিন খাদ্যের চাহিদা কমিয়ে এনেছে, তা সত্ত্বেও ঋণের বোঝা তারা এড়াতে পারেনি।
লকডাউনের ভরপাই এর আর্জি, সামগ্রিকভাবে লকডাউনের বিরোধীতা, বা বকলমে টিকাকরণকে বাধ্যতামূলক করা বন্ধ করা - এইসব দাবীর জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আজ দেশের মানুষের কাছে বিচারব্যাবস্থার দরজা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ । এগুলো বোধ করি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুর তালিকায় পড়েনা। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ২৬শে মে ২০২১ কর্ণাটক উচ্চ আদালতের একটি রায় (যেটিকে পরবর্তী কালে সুপ্রিম কোর্টও মান্যতা দিয়েছে) । একটি জনস্বার্থ মামলায় বাদীপক্ষের দাবী ছিল পরীক্ষাধীন টিকা ব্যাবহার করে গণটিকাকরণ চালানো অনুচিত এবং বাধ্যতামূলক টিকাকরণ অসাংবিধানিক সুতরাং গণটিকাকরণ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখতে হবে। উচ্চ আদালত মামলাটি খারিজ করে দেয় ও আদালতের সময় নষ্ট করার জন্য দুজন আবেদনকারীর ৫০০০০ টাকা করে জরিমানা ধার্য করে।

সাধারন মানুষের কাছে সুবিচার আজ পুরোপুরি অধরা হয়ে গেছে। সংসদের সদর দরজাও সাধারণ মানুষের কাছে বেশ কিছুদিন হল বন্ধ। সংসদীয় কাজ অনেকাংশেই চলে গেছে নির্বাহিক মণ্ডলীর হাতে। নির্বাহিক মণ্ডলী ও সংবাদমাধ্যম বহু বছর ধরেই শাসকশ্রেণির তল্পিবাহক। রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের মুখোশ খসে পড়েছে। প্রতিরোধই একমাত্র নিরাময়।

এই খসড়াটি সম্পর্কে আপনার মতামত পাঠাতে পারেন এই ইমেইল ঠিকানাটি spambots থেকে রক্ষা করা হচ্ছে। এটি দেখতে হলে আপনার জাভা স্ক্রিপ্ট সক্রিয় থাকতে হবে।-এ।