খাদ্য ও স্বাস্থ্য ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রথমত ও প্রধানত প্রয়োজন পুষ্টি যা আমরা খাদ্য থেকে পাই। তাই জনস্বাস্থ্যের কথা ভাবতে হলে আগে জনগণের জন্য সুসম ও পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজনীয় যোগান ও জনগণের কাছে তা সহজলভ্য করার কথা ভাবতে হবে। এর উল্টো দিকে, খাদ্যের মধ্যে ক্ষতিকারক উপাদান থাকলে তা হবে ব্যক্তি ও জনসমষ্টির সুস্বাস্থের পরিপন্থি। তাই জনস্বাস্থ্যের ওপর জিএমওর প্রভাব বুঝতে হলে আগে এটা জানা দরকার জিএমও কি, এক্ষেত্রে খাদ্যের উপাদানে ক্ষতিকারক কিছু থাকে কিনা এবং থাকলে তা স্বাস্থ্যের কতটা ক্ষতি করতে পারে। কারণ ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে খাদ্যগুন আর বিবেচ্য হতে পারে না।

 

খাদ্যের একটা বড় অংশ আসে চাষাবাদের মাধ্যমে উৎপন্ন খাদ্যশস্য থেকে। খাদ্যশস্য বাদ দিয়ে অর্থকরী ফসলও চাষ করা হয়। ১৯৯০ এর দশক থেকে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে জীন প্রযুক্তির দ্বারা পরিবর্তিত অর্থাৎ জেনেটিকালি মডিফাইড অর্গানিজম, সংক্ষেপে জিএমও চাষ শুরু হয়। এই জেনেটিকালি মডিফাইড বা জিএম বীজ দিয়ে চাষ করলে তা জনস্বাস্থ্যের ওপর কি প্রভাব ফেলতে পারে তা বুঝতে হলে আমাদের সার্বিক ভাবে তিনটি দিক থেকে এর প্রভাব বুঝতে হবে,

১. জনস্বাস্থ্যের ওপর জিএমও বীজ থেকে এবং যে পদ্ধতিতে সেই চাষ করা হয় তার থেকে উৎপন্ন খাদ্য অর্থাৎ শস্য, সবজি, ফল খাওয়ার প্রভাব।

২. যারা সেই চাষ করছেন অর্থাৎ চাষীদের ওপর এই পদ্ধতিতে চাষের প্রভাব এবং

৩. এই চাষের ফলে সামগ্রিক পরিবেশের ওপর অর্থাৎ জলবায়ু, মাটি, বাস্তুতন্ত্র ইত্যাদির ওপর প্রভাব।

এই তিনটি বিষয়ই জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।

 

এই তিনটি বিষয় বোঝার আগে জিএমও চাষের ইতিহাস সম্পর্কে দু চার কথা বলে নেওয়া যাক। জিএম বীজ দিয়ে চাষের বিষয়টা বুঝতে গেলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে সবুজ বিপ্লবের সময়টা দেখতে হবে। ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ এই সময়টাকে সবুজ বিপ্লবের সময় বলা যেতে পারে। সবুজ বিপ্লবের পরের সময়টা অর্থাৎ ১৯৯০ থেকে শুরু করে তারপরের সময়কে জিএমও চাষের সময় বলা যায়। সবুজ বিপ্লবের সময়ে ফলন বাড়ানোর লক্ষে ক্রসব্রিডিং এবং কিছু বিশেষ ধরনের বীজ নির্বাচন করে চাষ শুরু করা হয়, ফোর্ড ফাউন্ডেশন এবং রকেফেলার ফাউন্ডেশন এর পৃষ্ঠপোষকতায়[১]। উদ্দ্যেশ্য ছিল রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ফলন বাড়ানো। অনেক গাছই রাসায়নিক সারের প্রতি সংবেদনশীল অর্থাৎ রাসায়নিক সারের প্রভাবে গাছগুলোর ক্ষতি হয়। যেমন বহু প্রজাতির ধান গাছই রাসায়নিক সারের প্রভাবে নুয়ে পড়ে, একে ধান গাছের নেতিয়ে পড়া বা ঢলে পড়া রোগ বলা হয়। এর কারণ কান্ডের দৃঢ়তা কমে যাওয়া যা প্রধানত নাইট্রোজেন যুক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে হয়। দেখা যায় ধান গাছের উচ্ছতা কম হলে, রাসায়নিক সারের প্রভাবে নুয়ে পড়ার প্রবণতা কমে যায়। সবুজ বিপ্লবের সময় সেই ধান গাছগুলোকেই নিবাচিত করা হয় যেগুলোর উচ্চতা কম যাতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ফলন বাড়ানো যায় এবং গাছ ঢলে না পড়ে। আবার এই নাইট্রোজেন যুক্ত সার ব্যবহারের ফলে ধানগাছের কাণ্ড দুর্বল হয়, যে কারণে রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে না, ফলত কীটনাশকের ব্যবহার বাড়াতে হয়। ক্রমশ দেখা যায় এই ধরনের চাষে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও প্রচুর জলের প্রয়োজন হচ্ছে এবং ফলন ধরে রাখতে হলে তা উত্তরোত্তর বাড়াতে হচ্ছে[২]। ৮০ দশকে এসে দেখা যায় সবুজ বিপ্লবের রং বিবর্ণ হয়ে গেছে। কারণ হিসেবে রোগ ও পোকার আক্রমণকে দায়ী করা হয় যা জিএমও বীজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। জিএমও বীজ আনার পেছনে যে যুক্তিগুলো খাড়া করা হয় তার মধ্যে প্রধান হলো, এই বীজ রোগ ও পোকার আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারবে।

 

অর্থাৎ জিএমও চাষের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে হলে, ফলন বাড়ানোর লক্ষে সবুজ বিপ্লবের ভিত্তিকে আগে মেনে নিতে হয় কারণ জিএমও চাষও একই ভিত্তির ওপর দাড়িয়ে আছে।

 

সবুজ বিপ্লবের মূল ভিত্তি ছিল অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করে ফলন বাড়ানো। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে চাষ করে, প্রাথমিক ভাবে ফলন বাড়লেও পরে তা কমতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে IR8 ধানের ফলনের হিসেব দেখা যাক। IR জাতের ধানগুলো তৈরী হয় সবুজ বিপ্লবের সময়, ফিলিপন্সের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রে, যেমন IR8,IR36 ইত্যাদি। ১৯৬৬ সাল থেকে IR 8 ধানের ফলন প্রতি বছর আমন মরশুমে প্রতি হেক্টরে ০.২ টন করে এবং বোরো মরশুমে ০.২৬ থেকে ০.৪৭ টন করে কমতে থাকে[৩] যার প্রধান কারণ রোগ ও পোকার উপদ্রব। ক্রমশ দেখা যায়, কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার উত্তরোত্তর না বাড়ালে এই ধানগুলোর ফলন ধরে রাখা সম্ভব নয়, সঙ্গে প্রয়োজন প্রচুর জল যা জৈব চাষের তুলনায় অনেক বেশি।

 

দাবি করা হয়েছিল সবুজ বিপ্লবের সময়ের ধানগুলো প্রাক সবুজ বিপ্লবের ধানের তুলনায় উচ্চ ফলনশীল(?)। তুলনামূলক বেশি ফলন বললে কার তুলনায় সেটাও বলতে হয়। প্রাক সবুজ বিপ্লব সময়কে ধরলে যদি শুধু আমাদের দেশের ধানের কথা ধরা হয় তাহলে, প্রায় লক্ষাধিক প্রজাতির ধান ছিলো আমাদের দেশে। সেই সব ধানের প্রজাতিকেই নিম্ন ফলনশীল বলে দেওয়াটা শুধু তথ্যের বিকৃতি নয় বরং তাকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত বিকৃতি ভাবারও কারণ আছে। IR গোত্রের ধানগুলোর ফলন, যা আমাদের দিশী ধানের থেকে উচ্চফলনশীল বলে প্রচার করা হয়েছিল, সেগুলোর ফলন প্রজাতি ও চাষের সময়ের ওপর নির্ভর করে ৩.৬ থেকে ৯.৫ টন প্রতি হেক্টর বলে ধরা যায়। এই ফলন খরিফ মরশুমে কম ও বোরো মরশুমে বেশি। মনে রাখতে হবে এই ফলন প্রথম দিকের এবং সর্বোচ্চ ফলনের তথ্য অনুযায়ী। এবার আমাদের দেশীয় ধানের কিছু তথ্য দেখা যাক। দক্ষিণভারতের তিনটি জেলার ধানের ফলনের হিসেব নিচে দেওয়া হলো[৪]

১.মাদুরা - সাল ১৭৯৬ - ফলন ৩.২ টন/হেক্টার, ২.চিঙ্গলেপুট - সাল ১৭৮৮ - ফলন ২.৯ টন/হেক্টার এবং

৩. জেলা কোয়েম্বাটুর - সাল ১৮০৭ - ফলন ৭.৪৩ টন/হেক্টার।

মনে রাখতে হবে এই সময় কোনো রাসায়নিক সার বা কীটনাশক প্রয়োগ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না এবং সম্পূর্ণ দেশজ পদ্ধতিতে চাষাবাদ হতো।

স্বাধীন ভারতে ধান চাষের তথ্যর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো ১৯৪৯-৫০ সালে ভারত সরকারের কৃষি পন্ডিত পুরষ্কার বিজেতা কৃষক শ্রী জে. সি. পানি প্রতি হেক্টরে ৬.৮ টন ধান ফলিয়ে ছিলেন। ১৯৫০-৫১ ও ১৯৫১-৫২ সালে কৃষি পন্ডিত পুরষ্কার বিজেতা কৃষক শ্রী ভাল্লাইয়া গোন্ডার ও শ্রী জে. সি সাংঘাইয়া যথাক্রমে প্রতি হেক্টরে ১১.৪৭ টন ও ১২.৫৯ টন ধান ফলিয়ে ছিলেন (Press Information Bureau G O I 1955)। ড. আর. এইচ. রিচারিয়া দেখেন মধ্যপ্রদেশের কৃষকেরা তাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে দেশীয় ধানের চাষ করে ভালো ফলন ফলাতে পারছেন। সেখানকার একটি জাতের ফলন হেক্টরে ৯ টনেরও বেশি ছিলো (Richharia 1977)। ১৯৭৮ সালের মধ্যে রিচারিয়া ৭৮০০ দেশীয় ধানের জাত থেকে নির্বাচন করে ১৫০০ টি উন্নত জাত তৈরী করেন, যাদের কোনো কোনোটির ফলন প্রতি হেক্টরে ৫ থেকে ৭ টন বা তারও বেশী ছিলো।

এই বাংলায়ও এমন ধান আছে যেগুলোর ফলন সবুজ বিপ্লবের ধানের কাছাকাছি যেমন বাঁশতারা, শিউলি, সবানসাল, যুগল ইত্যাদি[৫]। এই সব তথ্য দেখলেই বোঝা যাবে যে প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক, সব সময়ই আমাদের দেশী ধানের মধ্যে এরকম অনেক প্রজাতি ছিল ও আছে যা সবুজ বিপ্লবের ধানের তুলনায় সমপরিমাণ ফলন ও কিছু ক্ষেত্রে বেশি ফলন দিতে পারতো ও পারে। দুঃখের বিষয় সংরক্ষণের অভাবে এগুলোর অনেক প্রজাতিই আজ হয়তো হারিয়ে গেছে।

 

এছাড়া আরো একটা দিক আছে। জমির চরিত্র, আবহাওয়া ও জলবায়ু এবং জমির উচ্চতার পার্থক্যের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন প্রজাতির ধান চাষ হয়। আমাদের দেশেই কোথাও বৃষ্টি বেশি কোথাও কম হয়, কোথায় জমি 3 মাস জলের তলায় থাকে কোথাও পাহাড়ের ঢালে চাষ হয় যেখানে জমিতে জল দাড়াতে পারে না। এরকম বহু ক্ষেত্রেই সবুজ বিপ্লবের ধান চাষ করা সম্ভব নয়।

 

অর্থাৎ সবুজ বিপ্লবের ভিত্তি ও কর্মপদ্ধতি প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়।

 

এর পরবর্তী সময়ে এলো জিএমও। জেনেটিকালি মডিফাইড কথার অন্তর্নিহিত অর্থ হলো পরীক্ষাগারে কৃত্রিম উপায়ে জীনের বদল ঘটিয়ে এক বিশেষ ধরনের বীজ তৈরী করা যা আগে প্রাকৃতিক ভাবে ছিল না বা তৈরী হয়নি। জিএম বীজ তৈরীর মূল তাত্ত্বিক ভিত্তি ও সবুজ বিপ্লবের ভিত্তি একই, অর্থাৎ বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহার করে বেশি ফসল ফলানো। সবুজ বিপ্লবের সময় রোগ পোকার আক্রমণ ফলন বাড়ানোর ক্ষেত্রে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জিএম বীজ রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম বলে দাবি করা হয় যা জিএমও চাষের প্রেক্ষিত তৈরী করে।

 

একটি ফসলের গুণগত মান, ফলন, স্বাদ, রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা এই সব কিছুই নির্ভর করে তার জীনগুলোর ওপর, আরো নির্দিষ্ট করে বললে কিছু বিশেষ বিশেষ জীনের ওপর। এখন সেই নির্দিষ্ট জীনগুলো একত্রিত করে যদি বিশেষ কিছু বীজ তৈরী করা যায় তাহলে তার মধ্যে সব গুনই থাকবে। এই নীতিকে সম্বল করেও জিএমও চাষের সপক্ষে যুক্তি খাড়া করা হয়।

 

কিন্তু বাস্তবে এর বিপরীতও হতে পারে অথবা একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে অন্য সমস্যা তৈরী হতে পারে। একটা উদাহরণ দেখা যাক। ধান গাছের নুয়ে পরা (বিশেষত নাইট্রোজেন সার ব্যবহারের ফলে), ধান চাষের একটি সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সবুজ বিপ্লবের সময় নির্বাচিত ধান গাছগুলোর উচ্চতা কম রাখার চেষ্টা করা হয়। sd1 জীন ধান গাছের উচ্চতা কম রাখতে সাহায্য করে। এই জীনের প্রভাবে জিব্বারেলিন হরমোনের উৎপাদন ব্যাহত হয়, যে কারণে গাছের উচ্চতা বেশি বাড়ে না। আবার এই sd1 এর কারণেই ধান গাছের কান্ডে লিগনিন নামক বহুশর্করার পরিমান কমে যায়। লিগনিন কান্ডকে দৃঢ়তা দেয়, তাই sd1 জীনের প্রভাবেও কান্ডের দৃঢ়তা কমে। লিগনিন কান্ডে ছিদ্রকারি পোকার বিরুদ্ধে গাছকে প্রতিরোধ ক্ষমতা যোগায়। sd1 জীনের প্রভাবে এই প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। অর্থাৎ একটি জীনগত পরিবর্তনে একদিকে যেমন সুবিধা হচ্ছে, অন্য দিকে তেমনি অসুবিধাও তৈরী হচ্ছে। এছাড়া জীন পরিবর্তনের ফলে অন্য কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা আছে কিনা তা জানার জন্য দীর্ঘকালীন পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন, বিশেষত খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে তা নিতান্তই জরুরি।

 

এই জীন পরিবর্তন এর আর একটি কারণ হলো, গাছের অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক সহ্য করার ক্ষমতা তৈরী করা। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে গাছের ক্ষতি হয়, জীন পরিবর্তিত বীজ থেকে তৈরী গাছগুলোর অতিরিক্ত রাসায়নিক সার সহ্য করার ক্ষমতা থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যাবহারে গাছগুলোর রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করার প্রাকৃতিক ক্ষমতা কমে যায়। তাই জিএম বীজ থেকে জন্মানো গাছের সুরক্ষার দিকটাও জেনেটিক মডিফিকেশন এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে জিএম বীজ কোনো কোনো বিশেষ ধরনের রোগ বা পোকার আক্রমণ আটকাতে পারলেও সব পোকার আক্রমণ আটকাতে পারছে না। সুতরাং কীটনাশকের ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ছে কারণ রাসায়নিক সার আগেই তাদের প্রকৃতিক ভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।

 

Bt তুলোর চাষের উদাহরণ এ ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে। bt তুলো পিঙ্ক বোলওয়ার্ম আটকাতে সক্ষম। পিঙ্ক বোলওয়ার্ম তুলোর জন্য একটি মেজর পেস্ট। কিন্তু পিঙ্ক বোলওয়ার্ম মরলেও সাদা মাছি, যাব পোকা এগুলো কিন্তু মোরল না। বরং উল্টে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় এরা প্রচুর পরিমানে বেড়ে ফসল নষ্ট করে দিলো। ফলত কীটনাশকের ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়ল, এমনকি কীটনাশক ব্যাবহার করে অনেক সময় ফসল বাঁচানো গেল না।

 

এবার বাস্তুতন্ত্রের বিষয়ে আশা যাক। প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত ও ক্রমবর্ধমান কীটনাশক ও আগাছা নাশক ব্যাবহারের ফল চূড়ান্ত ক্ষতিকারক। কীটনাশক ব্যবহারের ফলে শুধু মাত্র যে ক্ষতিকারক পোকারা মারা যায় তা নয়, সব ধরনের পোকাই মারা যায়। যেমন ধান ক্ষেতে যে ধরনের পোকা দেখা যায় তাদের চার ভাগে ভাগ করা যায় - ১. শাকাশি প্রজাতি, ২. মাংসাশী প্রজাতি, ৩. কিছু প্রজাতির খাদ্য প্ল্যাঙ্কটন আর পচনশীল জৈব পদার্থ, আর ৪. কিছু পরজীবী। শাকাশি প্রজাতিগুলির মধ্যেই কোনো কোনো টা ধানের ক্ষতিকর পোকা বা পেষ্ট হয়ে ওঠে কারন তারা ব্যাপকহারে ধানগাছের বিভিন্ন অংশ খেয়ে ফেলে ফলনের ক্ষতি করে দেয়।

 

আবার এই মাংসাশী পোকারা শাকাশি পোকাদের খেয়ে ফেলে, বেশ কিছু পরজীবী পোকাও এই শাকাশি পোকাদের ক্ষতি করে, এদের বন্ধু পোকা বলে। কীটনাশকের প্রভাবে এই বন্ধু পোকার সংখ্যাও কম যায়। একই সাথে জৈব সারের ব্যবহার কমার ফলে জলমগ্ন ধান জমিতে জৈব পদার্থ কমে যায় ফলে যথেষ্ট পরিমানে zoo plankton তৈরী হয়না, যে পোকারা প্ল্যাঙ্কটন অথবা পচনশীল জৈব পদার্থ খায় তদের সংখ্যা তেমন বাড়েনা, ফলে তাদের যে মাংসাশীরা খায় তাদের সংখ্যাও বাড়েনা। এর ফলে ক্ষতিকারক পোকার সংখ্যা প্রাকৃতিক ভাবে কমার উপায় বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও ধান জমিতে থাকা মাছ, ব্যাঙ, গিরগিটি পোকার সংখ্যা কমাতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। কীটনাশকের প্রভাবে এগুলোও মারা যায়।

 

কিছু পোকা আবার খুব দ্রুত বিভিন্ন বিষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। র্যা চেল কারসনের লেখা বিখ্যাত বই দি সাইলেন্ট স্প্রিং থেকে জানতে পারা যাচ্ছে যে ১৯৮৫ সালের মধ্যেই প্রায় সাড়ে চারশো রকমের পোকা বিভিন্ন বিষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী করে ফেলেছিল। এই সব পোকাদের শরীরে বিষ ঢুকবে কিন্তু তারা মরবে না। কিন্তু কোনো ব্যাঙ বা গিরিগিটি যদি এরকম ১০০ টি পোকা খায়, তাহলে এই ১০০ পোকার দেহে সঞ্চিত বিষ তার দেহে ঢুকবে এবং সেটি মরে যাবে। আবার ধরা যাক ব্যাঙটি ৮০ টি পোকা খেলো, ফলে মরলো না কিন্তু ঐ ৮০ টি পোকার বিষ তার দেহে সঞ্চিত থাকলো। কোনো সাপ এই ধরনের ১০ টি ব্যাঙ খেলো, তাহলে ৮০০ টি পোকার বিষ সেই সাপের দেহে ঢুকবে এবং সাপটি মরে যাবে। বস্তুত পরিভাষায় যাকে বলে Biological Magnification। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে জৈব স্যারের ব্যাবহার বন্ধ করা এবং রাসায়নিক সার ব্যবহার উত্তরোত্তর বাড়ানোর ফলে ফসলে যখন পেস্টের আক্রমণ হয় তখন তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রনের প্রাকৃতিক উপায় সব দিক থেকেই ক্রমশ বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং ক্রমবর্ধমান কীটনাশকই হয়ে পড়ে একমাত্র ভরসা।

 

এছাড়াও নাইট্রোজেন যুক্ত সার এই পেস্টদের বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরী করে, ফলে দেখা যায় আগে যে পোকা তেমন ক্ষতিকারক ছিল না, সেগুলোও ফসলের অতিরিক্ত ক্ষতি করছে। ধান ক্ষেতে মাছ চাষের ফলে শুধু যে প্রোটিনের চাহিদা মিটত তাই নয়, তা বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করতো ও ধান চাষের সামগ্রিক উপকার করত। অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার এই সব কিছুকেই একদিকে ধংস করেছে অন্যদিকে ক্ষেত থেকে বেরোনো জলের মাধ্যমে আশপাশের জমি, পুকুর ও নদীর জল সব কিছুকেই দূষিত করছে এবং মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর শরীরে ঢুকে বিভিন্ন অসুখের উৎস হয়ে উঠছে। এসবের সঙ্গে জমির লবণাক্ত হয়ে পড়া, ধান চাষের জমিগুলোতে সারা বছর জল জমে থাকার ফলে মাটির জলস্তর বেড়ে যাওয়া, আবার অন্য চাষের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ জল ব্যাবহারের ফলে জলস্তর নেমে যাওয়ার মত সমস্যাগুলোও আছে যা বাস্তুতন্ত্রের সামঞ্জস্যকে বিঘ্নিত করছে।

 

মানব শরীরে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের কুফল আজ অনেকেই জানেন, যা জিএমও অথবা হাইব্রিড চাষ দুক্ষেত্রেই হয়। সিসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম এর মত ধাতু থাকার ফলে অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যাবহারে যকৃৎ, ফুসফুস এবং কিডনির রোগ হয়। আমাদের শরীরের জন্য এই কীটনাশক অত্যন্ত ক্ষতিকর। ত্বকের নানা রকম সমস্যা বাদ দিয়েও, কীটনাশকের প্রভাবে বিভিন্ন ক্ষতি করতে পারে, যেমন - অন্ত্র ও পাচন ক্রিয়ার সমস্যা, স্নায়ু তন্ত্রের সমস্যা, শ্বাসপ্রশ্বাস প্রক্রিয়ার সমস্যা, প্রজনন প্রক্রিয়ার সমস্যা প্রভৃতি, অর্থাৎ কীটনাশক মানব দেহে বিষক্রিয়াও ঘটাতে পারে।[৬]

 

এই শারীরিক ক্ষতি যাঁরা কীটনাশক নিয়ে কাজ করছেন অর্থাৎ যাঁরা কীটনাশক তৈরী, বন্টন অথবা মাঠে প্রয়োগ করছেন এবং যাঁরা সেই কীটনাশক যুক্ত খাবার গ্রহণ করছেন উভয়েরই হতে পারে, কারণ দেখা যাচ্ছে যে এই কীটনাশকের অবশেষ খাবারের মধ্যেও থেকে যাচ্ছে।

 

অন্যান্য আগাছা নাশক এবং কীটনাশকের প্রভাবেও ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেড়ে যায়। পাঞ্জাবের দিকে তাকালেই এর সত্যতা বোঝা যাবে। এখন পাঞ্জাবকে অনেকেই ভারতবর্ষের ক্যান্সার ক্যাপিটাল বলছেন।[৭,৮] গোটা দেশের মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা এখানেই সব থেকে বেশি। এর কারণ হিসেবে প্রধানত কীটনাশক, আগাছা নাশক আর রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যাবহারকেই দায়ী করা হয়। আর সবুজ বিপ্লবের পরে আমরা দেখেছি, এই তিনটির ব্যাবহার উত্তরোত্তর না বাড়ালে ফলনের পরিমাণ কমতে থাকে। এমন কি এখন অতিরিক্ত পরিমাণে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করেও ফলনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।

 

জিএমও চাষের ভিত্তি তৈরী করেছিল জীন পরিবর্তিত বীজের এক বিশেষ ক্ষমতা যা কীটনাশক ও আগাছা নাশক সহ্য করতে সক্ষম। অর্থাৎ কীটনাশক বা আগাছা নাশক ব্যাবহারের ফলে রোগ পোকা অথবা আগাছা মারা যাবে কিন্তু গাছের ক্ষতি হবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো, হলো তার বিপরীত। জিএমও চাষ করে তৈরী হলো সুপার উইড, সুপার পেস্ট আর ধ্বংস হলো জীববৈচিত্র।[৯]

 

আগাছানাশকের কথা বলতে হলে মনসান্টোর তৈরী রাউন্ড আপ নামক আগাছা নাশকের কথা না বললে বিষয়টা সম্পূর্ণ হয় না। মনসান্টো রাউন্ড আপ নামের আগাছা নাশক বাজারে নিয়ে আসে এবং রাউন্ড আপ রেডী বীজ নিয়ে আসে, যে বীজ দিয়ে চাষ করলে গাছগুলো রাউন্ড আপ আগাছা নাশকের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। মনসান্টোর তৈরী এই রাউন্ড আপ আগাছা নাশক নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে গবেষক ড. রবার্ট বেলে দেখেন যে রাউন্ড আপ খুবই বিষাক্ত এবং এর ফলে কোষ বিভাজনের জটিলতা তৈরী হয় এবং তা ক্যান্সারের দিকে নিয়ে যেতে পারে[উৎস - গ]।

 

এবার এই জিএমও খাদ্য খাওয়ার ফলাফলগুলো একটু দেখে নেওয়া যাক। প্রাণীদের ওপর পরীক্ষায় দেখা গেছে, জিএমও খাদ্য যকৃৎ, অন্ত্র, বৃক্ক ও মূত্রাশয়ের এবং প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যা তৈরী করতে পারে। এমনকি ক্যান্সার হওয়াও অসম্ভব নয়। জীন পরিবর্তিত শস্য চাষের অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন গবেষকের গবেষণা থেকে এরকম সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে জীন পরিবর্তিত শস্যের চাষ পরিবেশ তথা জনস্বাস্থের সুদুর প্রসারী ও অপুরনীয় ক্ষতি সাধন করতে পারে। [১০,১১,১২]

 

কানাডায় অবাধে জীন পরিবর্তিত Bt খাদ্যশস্যের চাষ হয়, সেখানকার একটি হাসপাতালের সমীক্ষায় দেখা গেছিলো গর্ভবতি মা ও গর্ভস্থ ভ্রুনের রক্তে এই পরিবর্তিত জীনের অবশেষে বা bt বিষ রয়েছে যা মানুষের শরীরে নানান জটিলতা, এলার্জী, এমনকি ক্যান্সারও সৃষ্টি করতে পারে।[১৩]

 

জীন পরিবর্তিত ফসলে এমন কিছু জীন থাকে যা প্রকৃতিক ভাবে কখনই ওই ফসলে ছিলো না। এই জীন সৃষ্ট প্রোটীন গুলি মানুষের শরীরে কি প্রতিক্রিয়া ঘটাবে তা অজানা। সব প্রোটিন শরীরের জন্য উপকারী নয়, যেমন ধরাযাক সাপের বিষ। বিশুদ্ধ প্রোটিন হলেও তা শরীরের জন্য উপকারী নয়। তেমনি জীন পরিবর্তিত প্রোটিন শরীরে কি কি প্রভাব ফেলতে পারে তা জানার জন্য দীর্ঘ ও গভীর পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রয়োজন। এই পরীক্ষা বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার দ্বারা হওয়া দরকার, কোনো একটি সংস্থার তথ্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়া কখনোই উচিত নয়। যারা এই বীজ তৈরী করেছে শুধু তাদের দেওয়া তথ্যকেই ধ্রুব সত্য বলে ধরে নেওয়া কারণ নেই। যে এই জিএমও তৈরী করেছে তার সেই বীজ সম্পর্কে ইতিবাচক বক্তব্যই থাকবে, এটা ধরেই নেওয়া যায় কারণ তার নিজের ব্যাবসায়িক স্বার্থ এখানে জড়িত। সুতরাং জিএম বীজ প্রস্তুতকারকের দাবিগুলো সত্যি কিনা তা অন্যান্য ব্যাক্তি ও সংস্থার দ্বারা পরীক্ষিত হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে বলে রাখা দরকার, এ নিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে। সুতরাং মানব শরীরে এর দীর্ঘকালীন প্রভাব এখনও জানা নেই।

 

অতএব একথা বলাই যায় যে জিএম বীজ দিয়ে চাষ এবং এই চাষের ফলে উৎপন্ন খাদ্য - উৎপাদক, গ্রাহক ও পরিবেশ এই তিনের জন্যই অত্যন্ত ক্ষতিকর, অর্থাৎ সার্বিকভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

 

তবুও এই সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে একটা শক্তি যাদের বিগ কর্পোরেট বলা হয় - জিএমও বীজ দিয়েই চাষ করার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার ওপর চাপ তৈরী করে চলেছে। প্রসঙ্গত কিছু দিন আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডাব্লিউ টি ওর(WTO) কাছে অভিযোগ জানিয়েছে যে ভারতে জিএমও খাদ্য আমদানি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় রপ্তানির ক্ষতি হচ্ছে, ভারতকে অবিলম্বে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হোক [১৪]। বলা বাহুল্য, কর্পোরেট লবির অদৃশ্য হাত রয়েছে এই ধরনের চাপ তৈরীর পেছনে।

 

এই সব চাপ সত্ত্বেও ভারতে এখনও অবধি, সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, জিএমও চাষ ও আমদানি নিষিদ্ধ, এক মাত্র ছাড় আছে তুলো চাষে[১৫]। এবার তুলো চাষ নিয়ে দুয়েকটা কথা আলোচনা করা যাক। ভারতে সবচেয়ে বেশি তুলো চাষ হয় মহারাষ্ট্রে। NCRB র তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৫ থেকে ২০১৪ অবধি ভারতে ২৯৬,৪৩৮ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন যার মধ্যে ৬০,৭৫০ জনই মহারাষ্ট্রের[১৬]। একই সঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, তুলো চাষীদের আত্মহত্যার জন্য অনেকেই bt তুলোর চাষকে দায়ী করেছেন[১৭]।

 

ভারতে bt তুলো চাষে ফলন বেশি একথা প্রচার করা হলেও দেখা গেছে তা হয়েছিল প্রথম দিকে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করে। ক্রমশ অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বাড়িয়েও ফলন বাড়ানো যায় নি। দেখা যাচ্ছে যে কোম্পানি(পড়ুন মনসান্টো) bt তুলোর বীজ দিচ্ছে, সেই কোম্পানির পেটেন্ট করা বীজ দিয়ে চাষ না করে অন্য বীজ দিয়ে তুলোর চাষ করলেও তার মধ্যে bt তুলোর জীন পাওয়া যাচ্ছে, যা পরাগ মিলনের ফলে হতেই পারে। এখন দু ধরনের সমস্যা তৈরী হচ্ছে, একদিকে বাস্তুতন্ত্রের বৈষম্য নষ্ট হচ্ছে অন্য দিকে bt তুলোর বীজ দিয়ে চাষ না করলেও যেহেতু সেই জীন অন্য তুলোয় পাওয়া যাচ্ছে সেহেতু সেই কোম্পানি সত্ব দাবি করছে। চাষের খরচের ভারে ন্যুব্জ কৃষক আর এই অতিরিক্ত ভার সহ্য করতে পারছে না, এ শুধু মর্মান্তিকই নয় অনৈতিক ও বটে।

 

তাই প্রশ্ন উঠে যায়, কেনো এই চাষ বন্ধ করা হবে না? ভবিষ্যতে হয়তো কোনো সবজি, ফল, শস্য অথবা অর্থকরী ফসলের এমন কোনো জিএম বীজ আসতেই পারে যা উপকারী ও প্রয়োজনীয় কিন্তু তা ঠিক করার আগে প্রচুর গবেষণা দরকার, দীর্ঘ সময় ধরে সে গবেষণা চলা প্রয়োজন। এই গোটা বিষয়টাই খুব জটিল। আর ভীষণ জটিল একটা সিস্টেমের কোনও একটা অংশে পরিবর্তন আনলে সেটার শেষমেশ ফলাফল পুরোপুরি আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। এইটাই জিএমওকে কৃষিক্ষেত্রে আনার ব্যাপারে সবথেকে বড় আপত্তির জায়গা, কারণ এক্ষেত্রে কৃত্রিম পরিবর্তন তা পরীক্ষাগারে আটকে থাকবে না, প্রকৃতির মাঝে চলে আসবে যার ফলাফল এখনও অনেকটাই অজানা। তাই প্রয়োজন প্রচুর গবেষণা এবং সব ইতি ও নেতি বাচক দিকগুলো খতিয়ে দেখা।

 

এখন প্রশ্ন হলো তাহলে আজ কেনো জিএম চাষকে বার বার আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে? বহু প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও কেন বারবার জিএম চাষের কথা ফিরে ফিরে আসছে। এই যেমন এখন আবার জিএম সর্ষের বীজ দিয়ে চাষের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বহু সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সারা ভারত কিষান সভা ও অন্যান্য অধিকাংশ কৃষক সংগঠন এর বিরোধিতা করছে।

 

এত বিরোধিতা সত্ত্বেও তাহলে ঠিক কি কারণে(কোন অভিসন্ধিতে) জিএমও চাষ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে? প্রথমত জৈব পদ্ধতিতে চাষ করলে কৃত্রিম সার ও কীটনাশকের এই বিপুল প্রয়োজন হয় না। এক বিশাল বাজার পাওয়া সম্ভব যদি কৃত্রিম সার ও কীটনাশকের ওপর কৃষি ব্যাবস্থাকে নির্ভরশীল করে তোলা যায়। দ্বিতীয়ত এমন বীজ যদি বাজারে আনা যায় যা চাষ করার জন্য একজনের কাছ থেকেই বীজ, সার ও কীটনাশক কিনতে হবে তাহলে যে একচেটিয়া বাজার দখল ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব তা আর অন্য কোনো ভাবে সম্ভব হবে না। মনসান্টোর দিকে তাকালে আমরা তা স্পষ্ট ভাবেই দেখতে পাবো। এই প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা গেলে, অর্থাৎ খাদ্য ব্যাবস্থাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলে একটি দেশকেও কব্জা করা সম্ভব। তৃতীয়ত জীন আজ আর শুধু এক বিজ্ঞানে গবেষণার বিষয় নয়, আজ জীনকে সম্পদ বলা হয়, প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদের মতোই আর একটি সম্পদ। আজ এই সম্পদকে কুক্ষিগত করার চেষ্টায় সব বড় বড় কোম্পানি লেগে পড়েছে।

 

সবুজ বিপ্লবের পেছনে ছিল ফোর্ড ফাউন্ডেশন এবং রকেফেলার ফাউন্ডেশন[১৮-১]। আজ জিএমও চাষের যে বাজার তার অধিকাংশের মালিক মনসান্টো। বিগ কর্পোরেট লবি সব কিছুই গিলে খেতে চায়, কৃষি ব্যবস্থা ও জীন সম্পদই বা ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন?

 

যে দেশি ধানের জাতকে এককথায় অনুৎপাদক বলে খারিজ করে দিয়ে সবুজ বিপ্লবের ধান ঢুকলো, তা সংরক্ষণে আমাদের দেশের সরকার কোনও ব্যবস্থা না নিলেও, ইন্টারন্যাশনাল বোর্ড অফ প্ল্যান্ট জেনেটিক রিসোর্সেস (IBPGR) (ফোর্ড ফাউন্ডেশনের টাকায় পরিচালিত একটি সংস্থা) কিন্তু সেই ব্যবস্থার দায়িত্ব নিয়ে নিল সাগ্রহে। সারা পৃথিবী জুড়ে তারা যতরকমের দেশি জাত আছে গম, ভুট্টা বা ধানের তা সংগ্রহ করা আরম্ভ করল ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশনের সাথে যৌথ উদ্যোগে। অর্থাৎ পৃথিবী জুড়ে যত দিশী শস্যের বীজ ও তার জীন তা চলে গেলো একজনের কাছে, আর যেখান থেকে সেই সব বীজ আনা হলো, তারা আর সেই সব বীজ চাষ না করায় এবং সংরক্ষণও না করায় সাধারণ ভাবে পাওয়া সেই বীজ ও বীজের জীনগুলো হারিয়ে ফেললো। অর্থাৎ নিশ্বব্দে মালিকানা ও স্বত্ব বদল হয়ে গেলো জনগণের হাত থেকে কর্পোরেটের হতে।

 

এই জিএম বীজগুলোর পেটেন্টর মালিক সেই কোম্পানি যে এই বীজ তৈরী করেছে। তাদের কাছ থেকে না কিনে সেই বীজ ব্যাবহার করা যায় না, অন্যথায় মামলা মোকদ্দমা থেকে শুরু করে কোম্পানির বলপ্রয়োগ সবই জুটতে পারে। কেউ ধরুন জিএম বীজ দিয়ে চাষ করছেন, আর অন্য কেউ ঠিক তার পাশের জমিতে দিশী বীজ দিয়ে চাষ করছেন। এখন হাওয়া ও পতঙ্গ দ্বারা পরাগ মিলন হলে যিনি দিশী বীজ দিয়ে চাষ করছেন তার ফসলেও জেনেটিকালি মডিফাইড জীনের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে। তাই যিনি জিএমও চাষ করেননি তাঁকেও জিএম বীজের উৎপাদনকারী কোম্পানি চাইলে কোর্ট অবধি নিয়ে যেতে পারে এবং এটা প্রমাণ করা খুব কঠিন যে তিনি ওই জিএম বীজ দিয়ে চাষ করেননি। এ কাল্পনিক গল্প নয়, এঘটনা এই পৃথিবীতে ঘটে গেছে। ম্যানসনটোর মত কোম্পানিগুলোর প্রচুর ক্ষমতা এবং সেই ক্ষমতার অপব্যাবহার করতেও তারা বেশ পটু। জিএমও চাষ শুরু হলে আমাদের দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষীদের পক্ষে এই শক্তির মোকাবিলা করা বস্তুত অসম্ভব। এর অন্য একটা দিকও আছে, পরাগমিলনের ফলে পরিবর্তিত জীন, দিশী ফসলের সঙ্গে মিশে গেলে পরিবর্তিত জীনের সমস্যাগুলো দিশী বীজ দিয়ে চাষ করার পরও প্রতিফলিত হবে, সঙ্গে নষ্ট হবে বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্য।

 

সবুজ বিপ্লব ও তারপরের জিএমও চাষের পেছনে যে শক্তি কাজ করছে তার ব্যাপকতা ও বিশালতা বোঝার জন্য কয়েকটা উদাহরণ দেখা যাক -

১. তাইচুং, আইআরএইট এই সব ধানের চাষ যখন দেশজুড়ে করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তখন কটক সেন্ট্রাল রাইস রিসার্চ ইন্সটিট্যুটের ডিরেক্টর ড. আর.এইচ. রিচারিয়া, যাঁর কথা আমরা আগে আলোচনা করেছি, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তিনি জানতে চান, “এইসমস্ত ধান, যেগুলি গোটা দেশজুড়ে চাষ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেগুলির কোনও কোয়ারেন্টাইন সার্টিফিকেট নেই কেন?” কোয়ারেন্টাইন সার্টিফিকেট ব্যাপারটা এইরকম, যখন বিদেশি কোনও উদ্ভিদ বা প্রাণীর যেকোনও ভ্যরাইটি আমাদের দেশে আনা হবে, তখন আমাদের দেশের রোগপোকা, আবহাওয়া ইত্যাদির প্রতি সে কতটা সংবেদনশীল সেটা একটা বিচ্ছিন্ন জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে তাদের রেখে পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা হবে। তারপর সন্তোষজনক ফলাফল মিললে তবে তাকে দেশে অবাধে চাষের জন্যে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। শুধুমাত্র এইরকম একটি নির্দোষ বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন করার ‘অপরাধে’ তাঁর চাকরি চলে যায়।

২. এরপর তিনি Madhya Pradesh Rice Research Institute (MPRRI) কাজ শুরু করেন। ১৯৭০ থেকে ৭৬ সালের মধ্যে রিচারিয়া শুধু মধ্যপ্রদেশ থেকেই ১৯০০০ দেশীয় জাতের ধান সংগ্রহ করেন এবং তাদের গুনাগুন বৈজ্ঞানিক ভাবে নথীভুক্ত করেন। ১৯৮৬ সালে মালয়েশিয়ার একটি সম্মেলনে রিচারিয়া অভিযোগ করেন যে বিশ্বব্যাঙ্ক তার কাজ কর্ম বন্ধ করে দেবার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে (Krishnakumar 2003)। শেষ পর্যন্ত বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক ধান গবেষনা কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে MPRRI এর এই প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, এর ঠিক আগেই ফিলিপিন্সে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইন্সটিট্যুট (IRRI) রিচারিয়া-কে একটি প্রস্তাব পাঠায় যে, আসুন আমরা আমাদের ধানের ভ্যারাইটির সংগ্রহ বিনিময় করি যা ডক্টর রিচারিয়া সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

৩. সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান পত্রিকায় ২৬ জন গবেষক সম্মিলিতভাবে একটি চিঠি পাঠান, যা ওই কাগজের এডিটোরিয়ালে ছাপা হয়। তাতে তাঁরা বলেন, জীন পরিবর্তিত ফসলের প্রভাব সংক্রান্ত কোনও গবেষণার কাজ প্রকাশিত হবে কি হবে না তা নাকি নির্ভর করে ওই জীন পরিবর্তিত ফসল যারা বানাচ্ছেন সেইসব কোম্পানিগুলোর ইচ্ছের ওপরে।

৪. আর্পাড পুশতাই, রাওয়েট রিসার্চ ইন্সটিট্যুটের গবেষক, জিএম আলু ইঁদুরকে খাইয়ে দেখেছেন ইঁদুরের ক্ষুদ্রান্তের এপিথেলিয়াম কোষে এই আলু ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে ও ইঁদুরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। একথা একটি টিভি সাক্ষাৎকারে বলার পরেই তাঁর সম্পর্কে রটানো হল যে, তাঁর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে এবং তিনি নাকি ভুল স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেথড ব্যবহার করেছেন। তিনি তখন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার তাঁর গবেষক বন্ধুদের এই গবেষণার সব তথ্য-পদ্ধতি যাচাই করতে পাঠালেন। প্রত্যাশিতভাবে তাঁরা সকলেই আর্পাড পুশতাইয়ের গবেষণাকেই সমর্থন জানালেন।

 

এই উদাহরণগুলো কর্পোরেট শক্তির সেই শ্রেণী চরিত্র ও উদ্দ্যেশ্যকে মনে করিয়ে দেয় যা তাদের করে তুলেছে শাসক ও নিয়ন্ত্রক। উল্টোদিকে দাড়িয়ে থাকা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ ও তাদের মৌলিক অধিকারকে তারা নিরবে অস্বীকার করে। তাই খাদ্যের মত মৌলিক অধিকার বদলে যায় মুনাফা আদায় করার বাজারে। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক সব কিছুই তাই চলতে পারে পুরোদমে, কর্পোরেটের কঠোর নিয়ন্ত্রণে।

                                                                                               

তাহলে প্রশ্ন জাগে, এই বিশাল শক্তির সামনে দাড়িয়ে আমরা কি করতে পারি অথবা সত্যিই কি কিছু করা সম্ভব? উত্তর ইতিবাচক হতে পারে, একমাত্র যদি প্রতিরোধের মিছিল দীর্ঘ হয়। এই কর্পোরেট শক্তির অধীনে নিয়ন্ত্রিত না হতে চাওয়ার চাহিদাই পারে সেই সকলকে এক ছাতার তলায় আনতে। চাষীদের সঙ্গে কথা বলা, তাঁদের জৈব চাষে উৎসাহ দেওয়া, তাঁদের থেকে সরাসরি ফসল কিনে তাঁদের সমর্থন করা অথবা যে সব সংগঠন এই ধরনের কাজ করছেন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মধ্যে দিয়েই সংগঠিত হওয়া সম্ভব। একমাত্র সংগঠিত প্রতিরোধ-ই পারে এই বিশাল শক্তির দুরভিসন্ধি রুখে দিতে।

 

উৎস -

ক. https://www.sobujprithibi.in/local-paddy-vs-green-super-rice/

খ. https://janaswasthyajanabarta.blogspot.com/2022/11/blog-post.html?m=1

গ. The World According to Monsanto - https://m.youtube.com/watch?v=ho0BWyZHQ5Y

 

তথ্যসূত্র -

১. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Green_Revolution

 

২. (Flinn & De Datta 1984, Cassman et al.1994, Pingali 1994 and Cassman & Pingali 1995)

 

৩. Flinn et al. 1982

 

৪. Alaev L.B., The system of agricultural production in South India. In Roychowdhury Tapan and Habib Irfan (eds.) The Cambridge Economic History of India. Vol.I, 1982.

 

৫. Deb D., Seeds of tradition, seeds of future, Folk rice varieties of Eastern India. RFSTE. New Delhi.(2005)

 

 

৬. https://ndpublisher.in/admin/issues/IJAEBv10n6f.pdf

 

৭. https://www.downtoearth.org.in/news/punjab-cancer-capital-of-india-40255

 

৮. https://www.nbcnews.com/news/amp/ncna158691

 

৯. https://cban.ca/gmos/issues/environmental-impacts/

 

১০. https://d3n8a8pro7vhmx.cloudfront.net/prop37/pages/67/attachments/original/1348032282/Peer_reviewed_studies_on_GM_food_health_risks.pdf?1348032282

 

১১. https://enveurope.springeropen.com/articles/10.1186/s12302-021-00578-9

 

১২. https://www.globalresearch.ca/ten-scientific-studies-proving-gmos-can-be-harmful-to-human-health/5377054

 

১৩. https://wakeup-world.com/2012/05/18/gmo-alert-startling-new-research/

 

১৪. https://www.thehindubusinessline.com/economy/us-complains-about-indias-non-gmo-certification-requirement-for-food-again-at-the-wto/article65590091.ece

 

১৫. https://www.nature.com/articles/nindia.2014.14

 

১৬. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Farmers’_suicides_in_India

 

১৭. https://www.aljazeera.com/opinions/2013/3/30/seeds-of-suicide-and-slavery-versus-seeds-of-life-and-freedom/

 

লেখক সম্পর্কে

GRAPH_AVATAR_IMG
অমর্ত্য